ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের ছাত্র মৃত্যুর ঘটনায় ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ইনস্টিটিউট হাসপাতাল, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল সরকারি কলেজে হামলা ও ব্যাপক ভাঙচুর চালিয়েছে রাজধানীর ৩৫টি কলেজের শিক্ষার্থীরা। এ ঘটনায় সাংবাদিকসহ ২০ জন আহত হয়েছেন। আজ রবিবার দুপুর থেকে কয়েক দফায় এ সংঘর্ষ হয়।
প্রতক্ষ্যদর্শীরা জানিয়েছে, আজ দুপুর ১টার পর রাজধানীর প্রায় ৩৫টি কলেজের শিক্ষার্থীরা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালের সামনের ফটক অবরোধ করে গেট ও নেমপ্লেট ভাঙচুর করে ভেতরে প্রবেশ করে। পরে তারা সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের ভেতরে প্রবেশ করে হামলা ও ভাঙচুর করেন। এ সময় সোহরাওয়ার্দী ও কবি নজরুল কলেজের দিক থেকে কিছু শিক্ষার্থী লাঠিসোটা নিয়ে এগিয়ে আসলে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ধাওয়া দিয়ে সোহরাওয়ার্দী কলেজের দিকে যায়। এ সময় উভয় পাশ থেকে ইটপাটকেল নিক্ষেপে শিক্ষার্থীরা আহত হন।
জানা গেছে, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ডা. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের ছাত্র অভিজিৎ হালদার গত ১৬ নভেম্বর সকালে ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ইনস্টিটিউট হাসপাতাল ভর্তি হয়। গত ১৮ নভেম্বর হাসপাতালে চিকিৎধীন অবস্থায় সে মারা যায়। অভিজিৎ ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের এইচএসসি ২৪ ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিল।
তার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে গত ২০ ও ২১ নভেম্বরে হাসপাতাল অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা। তাদের অভিযোগ ওই দুইদিন ন্যাশনাল মেডিকেলের পক্ষ নিয়ে কবি নজরুল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থী ও দুই কলেজের ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা তাদের ওপর আক্রমণ করেছে।
বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘অভিজিৎকে হাসপাতাল কতৃপক্ষ ভুল চিকিৎসা দিয়ে মেরেছে। আমরা বিচার চাইতে এসেছিলাম। আমাদের কেনো ছাত্রদল মারল। আমরা এর বিচার চাই। এই প্রতিবাদেই আমরা অন্য সকল কলেজের শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ জানাইতে এসেছি। আজ দুপুরে পূর্বঘোষিত ‘‘সুপার সানডে’’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের সামনে প্রায় ৩৫ কলেজের শিক্ষার্থীরা জড়ো হই। ফেসবুকে গ্রুপ ‘‘ইউনাইটেড কলেজ অব বাংলাদেশ” নামক গ্রুপে মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজসহ অন্যান্য কলেজগুলোর শিক্ষার্থীরা এই আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে একত্রিত হয়।’
আন্দোলনে আসা কলেজগুলো হলো, ডা.মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজ, ঢাকা কলেজ, ঢাকা আইডিয়াল কলেজ, সিটি কলেজ, গিয়াসউদ্দিন কলেজ, সরকারি তোলারাম কলেজ, ইমপেরিয়াল কলেজ, বোরহানউদ্দিন কলেজ, বিজ্ঞান কলেজ, ধনিয়া কলেজ, লালবাগ সরকারি কলেজ, উদয়ন কলেজ, আদমজী, নটরডেম, রাজারবাগ কলেজ, নূর মোহাম্মদ, মুন্সি আব্দুর রউফ কলেজ, সিদ্ধেশ্বরী কলেজ, গ্রিন লাইন পলিটেকনিক, ঢাকা পলিটেকনিক, মাহবুবুর রহমান ইন্সটিটিউট অব সাইন্স এন্ড টেকনোলজি, ঢাকা দনিয়া কলেজসহ রাজধানীর বিভিন্ন কলেজ অংশ নেয়।
ডা. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীরা জানান, ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় মারা গেছেন কলেজের ছাত্র অভিজিৎ। এর প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ জানাতে আসলে হামলা চালান কবি নজরুল সরকারি কলেজ ও সরকারি শহীদ সোহরাওয়ারদী কলেজের ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। এর জেরে ৩৫টির কলেজের শিক্ষার্থীরা একজোটে এ কর্মসূচি পালন করেন।
অভিজিৎতের এক বন্ধু বলেন, ‘আমাদের ওপর কেনো হামলা হলো? আমরা এখানে এসে কারও সঙ্গে কথা বলব তেমন কেউ নেই। সবাই পালিয়েছে। কথা বলার কেউ থাকলে আমরা আমাদের দাবি জানিয়ে চলে যেতে পারতাম। কিন্ত একজন গার্ডও নেই। আমরা অভিযুক্ত ডাক্তারের লাইসেন্স বাতিল করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানাই। এ ছাড়া আমাদের ওপর যারা হামলা করেছে তাদের বিরুদ্ধে পুলিশের পদক্ষেপ নিতে হবে।’
শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় ছাত্রদলের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই বলে জানিয়েছেন কবি নজরুল কলেজের ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক কাওসার হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমরা শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীদের পক্ষে। আমরা কোনো হামলা করিনি।’
কলেজ ভাঙচুরের বিষয়ে সোহরাওয়ার্দী কলেজের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমি তাদের একবার বুঝিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি। পরে দলবল নিয়ে আবার আসছে। অনেক কম্পিউটার নিয়ে গেছে, ভেঙে ফেলেছে। বিএনসিসির রাইফেল নিয়ে গেছে। ১৭টি বিভাগে তারা ভাঙচুর করেছে। এক শিক্ষকের কার, ৪টা মোটরসাইকেল ভেঙেছে।’
সোহরাওয়ার্দী কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল ড. ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, ‘কাল ওই কলেজের প্রিন্সিপাল ও আমাদের প্রিন্সিপাল একটা সমঝোতায় এসেছিলেন। আমরা আশ্বস্ত ছিলাম যে এমন কিছু হবে না। কিন্ত তারপরও হামলা হলো। পুরো কলেজে হামলা চালয়েছে। আমার রুম পর্যন্ত ভেঙে ফেলেছে।’
সোহরাওয়ার্দী কলেজের প্রিন্সিপাল অধ্যাপক ড. কাকলী মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘আজ পরীক্ষা ছিল। গতকাল রাত পর্যন্ত ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের প্রিন্সিপালের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা আমাদের জানিয়েছিল কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু আজ সোয়া ১টার দিকে সিসিটিভিতে দেখি প্রচুর ছেলেমেয়ে এসেছে। গেট ভেঙে ঢুকেছে। ইচ্ছামত ভাঙচুর করেছে। গাড়ি ভাঙচুর করেছে। গ্যাস লাইন ছেড়ে দিছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের মার্কশিট, খাতা, ল্যাপটপ কিছুই নাই। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জানিয়েছে। উপউপাচার্য বলেছেন এপ্লিকেশন পাঠাতে। ভাঙচুরের জন্য তাও পাঠাতে পারিনি। এরা কি ছাত্র হতে পারে? এতো নাশকতা তো ছাত্র করতে পারে না।’
লালবাগ জোনের ডিসি জসিম উদ্দিন বলেন, ‘গত ১৮ তারিখে মাহবুবুর রহমান কলেজের একজন ছাত্র মারা যান। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যান বলে আমরা জানতে পেয়েছি। গত বুধবার কলেজের শিক্ষার্থীরা হাসপাতালে এসেছিল। এ ঘটনায় একটা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার শিক্ষার্থীরা আবারও অধিক সংখ্যায় আসে। শিক্ষার্থীদের দাবি ওই ছাত্রের অবহেলাজনিত মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বারবার বলেছে তারা শিক্ষার্থী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সঙ্গে নিয়ে তদন্ত করবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আজ ছাত্র প্রতিনিধি, মৃত ছাত্রের বাবা হাসপাতালে আসার কথা ছিল। আজ মিটিং ছিল। কিন্তু তারা আসেনি বলে আমরা জানতে পেয়েছি। আজ ফের সকালে শিক্ষার্থীরা হাসপাতালে এসেছে। তারা যাত্রাবাড়ি থেকে অনেক সংখ্যায় এসেছে। আজ সকাল বেলা থেকে আমরা চেয়েছি তাদের বুঝাতে। অবশেষে আমরা সংখ্যা বাড়িয়ে বিকেলে তাদের বুঝাতে সক্ষম হই। তারা চলে গেছে।’
ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) ডা. ইফফাত আরা বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা যে অভিযোগ করছে ভুল চিকিৎসায় মারা গেছে এটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। আমরা কলেজ শিক্ষার্থী, মৃত ছাত্রের পরিবারের সঙ্গে বসেছি। একটি তদন্ত কমিটিও গঠন হয়েছে।’
কবি নজরুল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজ কিভাবে জড়াল এই প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা জানি না তারা কিভাবে আসলো। আমরা তাদের কোনো হেল্প চাইনি। আসতেও বলিনি।’