সহিংস বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের মিনেপোলিস শহর। সম্প্রতি সেখানে পুলিশের হাতে এক নিরস্ত্র কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনার প্রতিবাদে টানা তিন দিন ধরে এ বিক্ষোভ চলছে। ভাংচুর, সমাবেশ ও স্লোগানসহ ঘটেছে পুলিশ স্টেশনে আগুন লাগিয়ে দেয়ার ঘটনাও। বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে শহরজুড়ে ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করেছেন মিনেসোটা গভর্নর টিম ওয়ালজ। এ খবর দিয়েছে বিবিসি।
খবরে বলা হয়, গত সোমবার পুলিশি হেফাজতে থাকাকালীন মারা যান ৪৪ বছর বয়সী জর্জ ফ্লয়েড। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিওতে দেখা যায়, এক শ্বেতাঙ্গ পুলিশকর্মী ফ্লয়েডের ঘাড়ে হাটু চেপে ধরে রেখেছেন। ফ্লয়েডকে শ্বাসকষ্টে ভুগতে দেখা যায়। তিনি বারবার নিজের শ্বাসকষ্টের কথা জানিয়ে আকুতি করলেও শোনেননি ওই শ্বেতাঙ্গ পুলিশকর্মী।
নিরস্ত্র ফ্লয়েডের ঘাড় হাটু দিয়ে চেপে ধরে রাখেন। এ সময় তার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল আরো চার পুলিশকর্মী। এ ঘটনায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন ফ্লয়েড। পরবর্তীতে হাসপাতালে নেয়া হলে সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।
এ ঘটনায় জড়িত পুলিশ সদস্যদের বক্তব্য অনুসারে, তাদের কাছে খবর ছিল যে ফ্লয়েড জাল নোট ব্যবহার করছেন। সোমবার তাকে ধরতে ঘটনাস্থলে যায় তারা। তাকে তার গাড়ি থেকে নেমে আসতে বলা হয়। তিনি নেমে আসলে তাকে হাতকড়া পড়ানো হয়। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায় যে, ফ্লয়েডের ঘাড়ের উপর চেপে বসেছেন এক শ্বেতাঙ্গ পুলিশকর্মী। ফ্লয়েড বারবার বলছেন, প্লিজ, আমি শ্বাস ‘নিতে পারছি না’, ‘আমায় মেরে ফেলবেন না’। এ ঘটনায় জড়িত পুলিশকর্মীদের চিহ্নিত করা হয়েছে ও চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
স্থানীয় গণমাধ্যম অনুসারে, ফ্লয়েডের মৃত্যুতে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে পুরো মিনেপোলিস। বিক্ষোভকারীরা ফ্লয়েডের হত্যাকারী ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে যথাযথ্য আইনি ব্যবস্থা ও শাস্তির দাবি জানিয়েছে। বিক্ষোভকারীরা শহরের পুলিশ বিভাগের একটি স্টেশনে ঢুকে ভাঙচুর চালিয়েছে। বিক্ষোভকারীদের তোপের মুখে ভবন ছেড়ে পালিয়েছেন পুলিশ সদস্যরা। পরবর্তীতে ভবনটিতে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। জানা গেছে, ফ্লয়েডের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংলিষ্ট পুলিশকর্মীরা ওই স্টেশনে কাজ করতেন। এর আগে বুধবার বহু দোকানপাট ভেঙে লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশ্যে কাঁদানে গ্যাস ছুড়েছে পুলিশ। মিনেপোলিস ছাড়া শিকাগো, লস এঞ্জেলস ও মেমফিসেও বিক্ষোভ হয়েছে।
মঙ্গলবার শান্তিপূর্ণ সমাবেশ দিয়ে শুরু হলেও, দ্রুতই বিক্ষোভ সহিংস আকার ধারণ করে। এর মধ্যে সবচেয়ে সহিংস বিক্ষোভ দেখা গেছে বুধবার। সেদিন দাঙ্গা পুলিশের সঙ্গে বারবার ইট-পাথর নিয়ে সংঘর্ষে নেমেছে বিক্ষোভকারীরা। সবচেয়ে বেশি উত্তেজনা দেখা যায়, থার্ড প্রিসিঙ্কট পুলিশ স্টেশনের নিকটে। ফ্লয়েডের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত পুলিশকর্মীরা ওই স্টেশনে কর্মরত ছিল বলে জানা যায়। বিক্ষোভকারীরা স্টেশনের বাইরে জড়ো হলে তাদের উদ্দেশ্য করে কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট ছুঁড়ে পুলিশকর্মীরা। এতে সাময়িকভাবে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলেও পরবর্তীতে ফের জড়ো হয়ে ভবনটিতে হামলা চালায় তারা।
ভবনে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়। তাদের হামলার মুখে ভবন ত্যাগ করে পালায় পুলিশ সদস্যরা। এছাড়া ভবনটির পাশে একটি গাড়ি ও অন্য আরো দুটি ভবনেও আগুন লাগানো হয়। নিকটবর্তী একটি দোকান থেকে মালামাল লুট করে নেয় বিক্ষোভকারীদের অনেকে। দমকলকর্মীরা জানান, বুধবারজুড়ে শহরের অন্তত ১৬টি ভবনে আগুন লাগানো হয়েছে।
এদিকে, মিনেপোলিসের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে শহরটিতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করেছেন মিনেসোটার গভর্নর ওয়ালজ। তবে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত শহরে তাদের তেমন উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়নি বলে জানিয়েছে রয়টার্স।
ওয়ালজ বৃহস্পতিবার বলেন, গত রাতে লুটপাট, ভাংচুর ও অগ্নিকাণ্ডে বহু ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। বিক্ষোভকারীদের শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ফ্লয়েডের মৃত্যু ঘিরে ন্যায় বিচার ও বিদ্যমান ব্যবস্থায় পরিবর্তন নিয়ে কাজ করা উচিৎ, আরো মৃত্যু ও ধ্বংস করা উচিৎ নয়। বুধবার ফ্লয়েডের হত্যাকারী পুলিশকর্মীরে বিরুদ্ধে অপরাধ মামলা দায়েরের আহ্বান জানান মিনেপোলিসের মেয়র জ্যাকব ফ্রে।মিনেপোলিস পুলিশ বিভাগ জানিয়েছে, এ বিষয়ে ন্যায় বিচার নিশ্চিতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে তারা।
ফ্লয়েডের মৃত্যুর ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। তবে তিনি জানান, মিনেসোটা মেয়র যদি ব্যর্থ হন, তাহলে প্রয়োজনে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ন্যাশনাল গার্ড সেনাদের পাঠাবেন তিনিও।
প্রসঙ্গত, যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের বিরুদ্ধে আফ্রিকান-আমেরিকানদের নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ বহু পুরনো। সম্প্রতি পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান কেনটাকির কৃষ্ণাঙ্গ বাসিন্দা ব্রেওনা টেইলর।এর আগে ২০১৪ সালে অপর এক কৃষ্ণাঙ্গ এরিক গারনারও পুলিশ নির্যাতনের স্বীকার হয়ে প্রাণ হারান। ফ্লয়েডের মতো তিনিও নিরস্ত্র ছিলেন। নিউ ইয়র্ক সিটির ওই বাসিন্দাও ফ্লয়েডের মতো পুলিশের নির্যাতনে শ্বাসকষ্টে মারা যান। মৃত্যুর আগে তাকেও বলতে শোনা গিয়েছিল, আমি শ্বাস নিতে পারছি না। ফ্লয়েডের মৃত্যু সে ঘটনার শোক ফিরিয়ে এনেছে। গারনারের মৃত্যুর পর পুরো যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে `ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ কৃষ্ণাঙ্গদের জীবনের মূল্য রয়েছে স্লোগান দিয়ে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল।