শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৩৬ অপরাহ্ন

অন্তঃসারশূন্য কল্পনাপ্রসূত বাজেট মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : শুক্রবার, ১২ জুন, ২০২০
  • ২০১ বার

করোনাভাইরাসের মতো মহাদূর্যোগকালে ২০২০-২১ অর্থবছরের সরকারের প্রস্তাবিত বাজেটকে ‘সাধারণ বাজেট’ বলে আখ্যা দিয়েছে বিএনপি। দলটির ভাষ্য অন্তঃসারশূন্য কল্পনাপ্রসূত বাজেট মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য।

বিএনপি বলছে, মানুষের জীবন ও অর্থনীতিকে এ মহাসংকট থেকে উদ্ধারে প্রয়োজন ছিল ‘বিশেষ করোনা বাজেট’। তা না করে অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার একটি গতানুগতিক অবাস্তবায়নযোগ্য বাজেট ঘোষণা করেছেন। এ বাজেট জাতিকে হতাশ করেছে, এটি কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে দুর্নীতিকে চলমান রাখার আরেকটি প্রয়াস মাত্র বলে মনে করে দলটি।

আজ শুক্রবার ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বিএনপির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় এ সব কথা বলেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

ফখরুল বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা সমৃদ্ধ তিন বছরের একটি মধ্যমেয়াদি বাজেট রূপরেখা দিয়েছিল বিএনপি। তাদের সুপারিশ ও দেশের অধিকাংশ শীর্ষ অর্থনীতিবিদদের অভিমতকে উপেক্ষা করে প্রত্যাশিত ‘অসাধারণ বাজেটের’ স্থলে নিতান্তই একটি ‘সাধারণ বাজেট’ প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ভবিষ্যৎ পথ পরিক্রমা-শিরোনামের এই বাজেট প্রকৃত অর্থে একটি অন্তঃসারশূন্য কল্পনাপ্রসূত কথার ফুলঝুরি ছাড়া আর কিছুই নয়। বাজেট জনবান্ধব হয়নি।’

বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘এই বাজেটে করোনা কাটিয়ে একটি টেকসই অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে তোলার কোনো সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব নেই। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক সুরক্ষা এবং খাদ্য নিরাপত্তার জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে প্রত্যাশিত অর্থ বরাদ্দ করা হয়নি। জাতি আশা করেছিল এবারের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেওয়া হবে। কিন্তু সবাইকে হতাশ করে অর্থমন্ত্রী স্বাস্থ্য সেবা ও স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য চলতি অর্থবছরের তুলনায় ৩ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা বাড়িয়ে ২৯ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেন। এছাড়া করোনা মোকাবিলায় ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হলেও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দেওয়া হলো জিডিপির মাত্র ১ দশমিক ৩ শতাংশ মাত্র। অথচ, স্বাস্থ্য খাতে আমরা জিডিপির ৫ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করেছিলাম। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সক্ষমতা সৃষ্টি করে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করাই ছিল প্রত্যাশিত।’

মির্জা ফখরুল আরও বলেন, ‘সবচেয়ে বড় কথা বরাদ্দ যা-ই হোক না কেন, প্রয়োজন স্বচ্ছ দুর্নীতিমুক্ত ব্যবহার। এ বিষয়ে বাজেটে কোনো দিকনির্দেশনা নেই। বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে প্রকৃত অর্থে কোনো গঠনমূলক ব্যবস্থা কিংবা সংস্কার প্রস্তাবও নেওয়া হয়নি।’

বিএনপির ভাষ্য

পরিবহন ও বিদ্যুৎ খাতসহ বেশ কিছু খাত রয়েছে যাতে অনেক বেশি পরিমাণ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, যা এ মুহূর্তে প্রয়োজন ছিল না বলে মনে করে বিএনপি। দলের পক্ষে ফখরুল বলেন, ‘সরকারি ভাষ্য মতে, বর্তমানে বিদ্যুতের স্থাপিত ক্ষমতা ২০ হাজার ২৭৯ মেগাওয়াট। তাই এ অসময়ে তোড়জোড় করে রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য বিপুল অর্থ বরাদ্দের কোনো দরকার ছিল না। ১২০০ মেগাওয়াট রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ১ লক্ষ ১৩ হাজার কোটি টাকায় দেশের সবচেয়ে একক ব্যয়বহুল চাপযুক্ত জল-চুক্তি প্রকল্প। এটি রাশিয়ান এক কোম্পানি কর্তৃক বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর বাস্তবায়ন কিছু সময়ের জন্য পিছিয়ে দিয়ে ওই অর্থ স্বাস্থ্য খাতসহ কর্মসংস্থান ও খাদ্য নিরাপত্তা খাতে ব্যয় করা যেত। তা করা হয়নি। কারণ, রূপপুর কেন্দ্রের দুর্নীতির সুযোগ বন্ধ করতে চায়নি সরকার।

বাজেটে করোনার ঝুঁকি মোকাবিলায় যে কাঠামো থাকা দরকার সেটি পরিপালিত হয়নি

বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘বাজেটের আয় ও ব্যয়ের গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। বাজেটে কেবল ‘সংখ্যার’ হিসাব মেলানো হয়েছে। রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ৩ লক্ষ ৮২ হাজার ১১ কোটি টাকা। এরমধ্যে এনবিআরকেই আয় করতে হবে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা (অর্থাৎ ৫০% এর অধিক প্রবৃদ্ধি) যা বাস্তবতা বিবর্জিত। এনবিআর অর্থ আহরণ করতে ব্যর্থ হবে এবং তাতে বাজেট ঘাটতির পরিমাণও বেড়ে যাবে। ব্যাংকগুলোর পক্ষে প্রস্তাবিত ডেফিসিট ফিন্যানসিংর (ঘাটতি অর্থায়ন) ৮৫ হাজার কোটি টাকা যোগান দেওয়া সম্ভব হবে না। এনবিআরের পক্ষে এত বিপুল রাজস্ব আহরণে ব্যর্থতা ও বাংকগুলোর পক্ষে ঘাটতি অর্থায়নে অক্ষমতার কারণে বাজেট মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য।’

মির্জা ফখরুল আরও বলেন, ‘বাজেটে ব্যাংকিং খাতসহ অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারের কোনো সুনির্দিষ্ট সংস্কার প্রস্তাব নেই। বরং শীর্ষ ঋণখেলাপিদের ঋণ পরিশোধে আরও সময় বৃদ্ধি করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এটা তো কোনো সংস্কার নয়। যা ব্যাংকিং খাতকে আরও সংকটের দিকে ঠেলে দেবে। আর্থিক শৃঙ্খলা আরও ভেঙে পড়বে।’

সরকার বলছে চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৫%

সম্প্রতি বিশ্ব ব্যাংকের ‘গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টাস ২০২০’ শিরোনামের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, চলতি বছরে প্রবৃদ্ধি ১.৬% নেমে আসবে এবং ২০২০-২১ বছরে হবে মাত্র ১ শতাংশ’। অর্থমন্ত্রী এ বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার নির্ধারণ করেছেন ৮.২%। আমদানি, রপ্তানি, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ইত্যাদি ম্যাকক্রো ইকোনমি ইন্ডিকেটরগুলো আলোচনা করলেই স্পষ্ট যে ৮.২% প্রবৃদ্ধি অর্জন নিতান্তই কল্পনাপ্রসূত। বিনিয়োগ দরকার ৩২-৩৪ শতাংশ। যা কঠিন এবং অসম্ভব। জিডিপি ও রাজস্ব আহরণে প্রবৃদ্ধিও যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা দৃশ্যমানভাবেই প্রতারণার শামিল। করোনায় সাধারণ মানুষের আয়ের ঝুঁকি বাড়লেও সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণে বরাদ্দ আগের অর্থবছরের তুলনায় কমেছে ০.২ শতাংশ। পল্লী সমাজসেবা কার্যক্রমের জন্য প্রণোদনা দেয়া হবে মাত্র ১০০ কোটি টাকা- যা নিতান্তই অপ্রতুল- যোগ করেন ফখরুল।

বাজেটে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে মন্তব্য করেছে বিএনপি

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বাজেটের বড় অংশ মেগা প্রকল্পগুলোকে দেওয়া হয়েছে যেগুলো এরই মধ্যে দুর্নীতির কারণে প্রশ্নবিদ্ধ। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এসব প্রকল্পকে বাজেটে আনয়নের প্রয়োজন ছিল না। দুর্নীতির চলমান ধারা অব্যাহত রাখাই এর কারণ বলে আমরা মনে করি। তা ছাড়া কালো টাকা সাদা করার যে সুযোগ এ বাজেটে দেওয়া হয়েছে সেটাও দুর্নীতিকে চলমান রাখার আরেকটি প্রয়াস মাত্র। আবাসন খাতের ফ্ল্যাটের পাশাপাশি এবার ১০% বাড়তি শুল্কে জমি কেনা ও উন্নয়ন, বিল্ডিং, নগদ টাকা, ব্যাংকে রক্ষিত টাকা এবং স্টক ডিভিডেন্ড, বন্ড ও শেয়ার বাজারে বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করে অনৈতিকতাকে বৈধতা দেয়া হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রশ্ন করার বিধানটিও উঠিয়ে দিতে যাচ্ছে, যা অসাংবিধানিক এবং কোনোভাবেই কাম্য নয়।’

উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ ধরা হয়েছে দুই লাখ পাঁচ হাজার কোটি টাকা উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘অথচ করোনা সংকট মোকাবিলায় মাত্র ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এই উন্নয়ন খাত থেকে এক লাখ কোটি টাকা করোনা সংকট মোকাবিলায় দেওয়া যেত। কারণ, উন্নয়ন খাতে শুধু লুটপাট হয়।’

বিএনপি মহাসচিব আরও বলেন, ‘বাজেটে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা খাতে বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ এখনও আম্পানের ধকল চলছে। কৃষকদেরও উৎপাদনের উপকরণ যেমন-বীজ, সার ইত্যাদির মূল্য হ্রাসের তেমন কিছুই বলা হয়নি। রাসায়নিক সারের মুল্য গত বছরের মূল্যই বহাল রাখা হয়েছে। কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করাসহ কৃষিখাতকে যথাযথ গুরুত্বের সাথে মূল্যায়ন করা হয়নি। ব্যাংকে ১০ লক্ষ টাকার উপরে রাখলেই ৩ হাজার টাকা, এক কোটি টাকার উপরে থাকলে ১৫ হাজার টাকা ট্যাক্স দিতে হবে। এতে আমানত ক্ষতিগ্রস্ত হবে, কারণ আমানতকারীরা নিরুৎসাহিত হবে।’

অনলাইন কেনাকাটা ও মোবাইল-ইন্টারনেট সেবার বর্তমান ব্যয় বহাল রাখার আহ্বান

বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘মোবাইল ফোনের মাধ্যমে কেউ যদি ১০০ টাকার সেবা নিতে চান তাহলে ৭৫ টাকার সেবা নিতে পারবেন। ২৫ টাকা যাবে সরকারের পকেটে। মোবাইল সেবার ওপর কর প্রায় প্রতিবছরই বাড়ছে। করোনা সংকটকালে অবরোধ অবস্থায় আমরা দেখছি এসব সেবা কত প্রয়োজনীয়। এ সময় অনলাইন বেচাকেনা এবং মোবাইল ও ইন্টারনেট সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক আরও ৫% বাড়ানো সঠিক হবে না।’

৩০ জুনের মধ্যে গ্যাস ও বিদ্যুতের বিল পরিশোধ না করলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে-এই সিদ্ধান্ত থেকে সরকারকে সরে আসার আহ্বানও জানান মির্জা ফখরুল। এ ছাড়া ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহীতাদের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা বৃদ্ধি করার আহ্বান জানান তিনি। বর্তমান পরিস্থিতিতে একটি আপদকালীন বাজেট করা উচিত ছিল বলেও মন্তব্য করেন বিএনপি মহাসচিব।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com