শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৩৪ অপরাহ্ন

অতি ভয়ঙ্কর সময়ে দেশ

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : বৃহস্পতিবার, ১৮ জুন, ২০২০
  • ২১৯ বার

করোনা সংক্রমণের ১০০ দিন পর মহাবিপর্যয়ের মুখে পড়েছে দেশ। প্রতিদিনই আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে আক্রান্ত রোগী ও মৃতের সংখ্যা। সংক্রমণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগ। আক্রান্ত লাখ ছুঁইছুঁই করছে। আজ সংক্রমণ লাখ ছাড়াতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এমন কঠিন পরিস্থিতিতেও জরুরিভিত্তিতে সংক্রমণ রোধে কৌশল কী হবে তাও স্পষ্ট নয়।

গতকাল একদিনে রেকর্ড ৪ হাজার ৮ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এদিনে মৃত্যু আগের দিনের চেয়ে কিছুটা কম। গেল ২৪ ঘণ্টায় ৪৩ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এর বাইরে প্রতিদিনই করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যাচ্ছেন অনেকে, যাদের অধিকাংশই সরকারি হিসাবের বাইরে থাকছেন।

করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু প্রথম দিকে কম থাকলেও দিনে দিনে ভয়ঙ্কর থেকে অতিভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছে। অনেকে বলছেন, করোনা আক্রান্তের সর্বোচ্চপর্যায়ে পৌঁছেছে দেশ। সংক্রমণ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, ঘর থেকে বের না হয়েও আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সমন্বয়হীনতা ও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। আবার কার্যকর ব্যবস্থাও সে রকম নেওয়া হচ্ছে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেভাবে সংক্রমণ বাড়ছে এবং তা প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, তাতে দেশে জাতীয় বিপর্যয় নেমে আসবে। যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি ও স্পেনের

মতো ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরির আশঙ্কাও করছেন অনেকেই। সে রকম হলে বাংলাদেশের বর্তমান নাজুক স্বাস্থ্যব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়বে। হাসপাতালে মানুষ চিকিৎসাও পাবে না।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, প্রথম থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও আইইডিসিআরের কর্তাব্যক্তিরা বিষয়টিকে গুরুত্ব দেননি। তারা সরকারকে ভুল বার্তা দিয়েছেন। যার কারণে সরকার সেভাবে প্রস্তুতি নেয়। এখন যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে, তাতে বাংলাদেশে কোথায় গিয়ে করোনার থাবা থামবে তা কেউ বলতে পারছেন না।

সংক্রমণের চতুর্থ মাসে এসে করোনা শনাক্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। গত ৯ জুন সংক্রমণের চতুর্থ মাসে এসে দৈনিক গড়ে ৪২ জনের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্ত হয়েছেন গড়ে ৩ হাজারের বেশি রোগী। গতকালই সংক্রমণের সংখ্যা ৪ হাজার ছাড়িয়েছে। যেভাবে সংক্রমণ বাড়ছে, সেভাবে ঊর্ধ্বমুখী থাকলে সপ্তাহখানেকের মধ্যে তা ৫ হাজার ছাড়াতে পারে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

অবশ্য কেউ কেউ বলছেন, প্রতিদিনই ২০ হাজার নমুনা পরীক্ষা করা হলে এখনই ৫ হাজার আক্রান্ত শনাক্ত করা যাবে। কিন্তু পরীক্ষার সংখ্যা এখনো সীমিত। এ সময় প্রতিদিন অন্তত ২৫ হাজার পরীক্ষা করা দরকার ছিল।

গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের কথা জানায় সরকার। এর পর ১০ দিনের মাথায় ১৮ মার্চ প্রথম মৃত্যুর কথা নিশ্চিত করা হয়। প্রথম দিকে প্রতিদিন মৃত্যুর খবর আসেনি। তবে তখন উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া গেছে অনেক। ওই সময়ে আক্রান্তের সংখ্যা ঊর্ধ্বগতি প্রতিদিনই ছিল না। কখনো বেড়েছে, কখনো কম রোগী শনাক্তের খবর দেওয়া হয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, গত এক সপ্তাহে সবচেয়ে বেশি নতুন রোগী বাড়ার দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১১তম। জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যমতে, আক্রান্তের সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে ১৮তম। মৃত্যুর দিক থেকে ৩১তম।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক আমাদের সময়কে বলেন, যে হারে সংক্রমণ বাড়ছে, তাতে সরকার সময়োপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যু বাড়তে থাকবে। আমাদের নমুনা পরীক্ষার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। নমুনা সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানো যাচ্ছে না। বেশি পরীক্ষা করা হলে আরও বেশি সংক্রমণ ধরা পড়ত। তিনি বলেন, আক্রান্তের ১৫ শতাংশ লোককে হাসপাতাল নিতে হবে। সংক্রমণ এই হারে বাড়তে থাকলে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা সেই চাপ নিতে পারবে না। সুতরাং জরুরি ভিত্তিতে স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ বাড়াতে হবে। জীবন রক্ষাকারী ন্যাসাল ক্যানুলা, অক্সিজেন মাস্ক ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি জেলা হাসপাতালগুলোয় আইসিইউ ও ভেন্টিলেটর ব্যবস্থা করতে হবে। নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সিস্টেম স্টোরেজসহ স্থাপন করতে হবে।

ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, আমাদের আইসিইউ বেডের সংখ্যা অত্যন্ত কম। ভেন্টিলেটর অন্যগুলো অপ্রতুল। তাই জরুরিভিত্তিতে জরুরি মেডিক্যাল উপকরণের জোগান দিতে না পারলে ‘জাতীয় বিপর্যয়’ ঘটবে এবং বহুলোকের প্রাণহানি হবে।

সংক্রমণ ঠেকাতে ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। সেটি কার্যত লকডাউনই ছিল। কিন্তু কয়েক দিন পর তা ঢিলেঢালা হয়ে পড়ে। ২৬ এপ্রিল থেকে পোশাক কারখানা এবং রমজানে ইফতারি বিক্রির দোকান ও শপিংমল খুলে দেওয়া হয়। তখন থেকেই মূলত লকডাউন ব্যবস্থা ঢিলেতামে চলতে থাকে, ঘর থেকে বের হয়ে আসতে শুরু করেন মানুষ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঈদের ছুটির আগে থেকে সংক্রমণ রোধে ঢিলেভাবে সংক্রমণ ব্যাপকহারে বাড়িয়েছে। তখনই সংক্রমণ ব্যাপকহারে বাড়ার আশঙ্কা করা হয়েছিল। গত এক সপ্তাহে সংক্রমণের হার টের পাওয়া যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার জোনভিত্তিক লকডাউনের প্রস্তুতি নিলেও তা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নয় বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা।

ডা. মোজাহেরুলসহ অনেকেই এপ্রিলের শেষের দিকে জোন ভাগ করে লকডাউনের ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে বাস্তবসম্মত নয়। এ প্রসঙ্গে ডা. মোজাহেরুল বলেন, বর্তমানে যেভাবে টুকরো টুকরো অঞ্চলে লকডাউন দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে, তা সংক্রমণ রোধে কোনো সুফল আসবে না। তার পরামর্শÑ লকডাউন জেলাওয়ারি জোনভাগ করে দেওয়া উচিত। টেস্টের আওতা বাড়াতে হবে। সংক্রমিতদের আইসোলেশন এবং তাদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের কঠোরভাবে কোয়ারেন্টিনে নিয়ে আসতে হবে।

পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছেÑ এমন প্রশ্নর জবাবে প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী আমাদের সময়কে, ‘আমরা সর্বোচ্চ চূড়ার দিকে। পুরো জুন মাসে এটি বাড়তে থাকবে। তার পর কিছু দিন স্থির থেকে তা কমতে থাকবে। এটি হচ্ছে ধারণাগত পদ্ধতি। তিনি বলেন, সরকার জোন বিভাজনের দিকে যাওয়ার কথা বললেও তা নিয়ে ব্যাপক ধোঁয়াশা রয়েছে। শুধু জোন বিভাজন করলেই হবে না, জোনভিত্তিক এলাকায় হাজারে হাজারে নমুনা পরীক্ষা করতে হবে। কার উপসর্গ আছে, কার নেই, তা বিবেচনায় আনা যাবে না। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, শেষ পর্যন্ত জোন বিভাজন সফলভাবে করতে না পারলে করোনার বিরুদ্ধে হেরে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।

আক্রান্ত লাখ ছুঁইছুঁই : গত ২৪ ঘণ্টায় এই ভাইরাসে ৪ হাজার ৮ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে, যা একদিনে সর্বোচ্চ শনাক্তের রেকর্ড। এ নিয়ে দেশে করোনা শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল ৯৮ হাজার ৪৮৯ জনে। ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আরও ৪৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে করোনায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল এক হাজার ৩০৫ জনে। ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন এক হাজার ৯২৫ জন। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত মোট সুস্থ হয়েছেন ৩৮ হাজার ১৮৯ জন।

গতকাল বেলা আড়াইটায় দেশের কোভিড-১৯ সম্পর্কিত সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত স্বাস্থ্য বুলেটিনে এসব তথ্য জানান প্রতিষ্ঠানটির অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা।

তিনি জানান, দেশের ৬১টি ল্যাবরেটরির মধ্যে ৫৯টিতে নমুনা পরীক্ষার তথ্য পাওয়া গেছে। এসব ল্যাবে ২৪ ঘণ্টায় ১৮ হাজার ৯২২টি নমুনা জমা পড়েছে এবং পরীক্ষা করা হয় ১৭ হাজার ৫২৭টি নমুনা। এসব নমুনা পরীক্ষায় রোগী শনাক্ত হয়েছে চার হাজার আটজন। দেশে এখন পর্যন্ত পরীক্ষা করা হয়েছে পাঁচ লাখ ৫১ হাজার ২৪৪টি। এসব নমুনা পরীক্ষায় করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে ৯৮ হাজার ৪৮৯ জন।

অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা জানান, ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন ৪৩ জন। এর মধ্যে পুরুষ ২৮ জন ও নারী ১৫ জন। মৃত্যুবরণকারীদের ২৭ জন হাসপাতালে, ১৫ জন বাসায় এবং একজনকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। অঞ্চল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ঢাকা বিভাগে ২১ জন, চট্টগ্রামে ১২, রাজশাহীতে চারজন, খুলনা বিভাগে দুজন, সিলেটে একজন, ময়মনসিংহে দুজন এবং রংপুর বিভাগে একজন রয়েছেন।

অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা বলেন, ২৪ ঘণ্টায় আইসোলেশনে নেওয়া হয়েছে ৭১৮ জন এবং আইসোলেশন থেকে ছাড়া পেয়েছেন ২৬৮ জন। এখন পর্যন্ত ছাড়া পেয়েছেন ৬ হাজার ৪৪৫ জন। তা ছাড়া তিন লাখ ২৯ হাজার ৮২০ জনকে কোয়ারেন্টিন করা হয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় কোয়ারেন্টিন থেকে ছাড়া পেয়েছেন তিন হাজার ৯৭ জন, এখন পর্যন্ত ছাড়া পেয়েছেন দুই লাখ ৬৭ হাজার ৩৩০ জন। বর্তমানে কোয়ারেন্টিনে আছেন ৬২ হাজার ৪৯০ জন।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com