সিলেটে করোনা উপসর্গ সন্দেহে নমুনা সংগ্রহ করা দুটি পিসিআর ল্যাবে কুলোচ্ছে না। প্রয়োজনের তুলনায় ল্যাব কম থাকায় যেমনি মানুষদের দীর্ঘসময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে, তেমনি নমুনা পরীক্ষার ফলাফল পেতেও লাগছে সময়। এক সপ্তাহ থেকে ১০-১২ দিনও সময় লাগছে। এতে নমুনা দেয়া ব্যক্তিদের ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হচ্ছে। আর ফলাফল আসতে বিলম্ব হওয়ায় তারা করোনায় আক্রান্ত কিনা স্বল্প সময়ে জানতে না পারায় এসব ব্যক্তিরা বেড়াচ্ছেন যত্রতত্র। আক্রান্ত ব্যক্তির সংর্স্পশে আসা ব্যক্তিরা নিজে যেমন সংক্রমিত হচ্ছে, তেমনি অন্যদেরও সংক্রমিত করছেন। এতে সিলেটে প্রতিদিনই বাড়ছে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের সংখ্যা।
রোগী শনাক্তকরণে বিলম্ব হওয়ায় সংক্রমণ আরো ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিও বাড়ছে এমনটি জানিয়ে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে প্রথম কাজ হচ্ছে সন্দেহভাজনদের পরীক্ষা করে যারা সংক্রমিত তাদের আইসোলেশনে নেয়া। তাদের সংস্পর্শে যাওয়া ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা। দ্বিতীয়ত, সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। এই দুটি কাজ সর্বত্র টিলেঢালাভাবে হওয়াতে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি সংক্রমণে ঝুঁকি বেড়েই চলেছে।
বিশেষজ্ঞরা আরো বলছেন, সিলেটে আক্রান্তের তুলনায় শনাক্তকরণ পিসিআর মেশিনের সংখ্যা খুবই কম। বিভাগের চারটি জেলায় মাত্র দুটি মেশিন দিয়েই চলছে কার্যক্রম। ল্যাব ও মেশিন বাড়াতে হবে। পাশাপাশি দক্ষ জনবলও দরকার।
নগরীর একটি সামাজিক সংগঠনের নেতা দিদার হোসেন রুবেল বলেন, সিলেট নগরীসহ বিভাগের কোথায় মানুষ স্বাস্থবিধি মানছে না ফলে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ঝুঁকি যেমন বাড়ছে তেমনি আক্রান্তের সংখ্যা। সে তুলনায় পরীক্ষা হচ্ছে খুবই কম।
সিলেটে পিসিআর ল্যাব আরো বাড়ানো এখনই দরকার, না হয় এর পরিণতি ভয়াবহ হবে জানিয়ে তিনি রুবেল আরো বলেন, এখন অধিকাংশ রোগীর শরীরে উপসর্গ ছাড়াই করোনা শনাক্ত হচ্ছে। যারা নমুনা দিচ্ছেন তাদের ফলাফল আসতে দেরি হওয়ায় ওই ব্যক্তিরা নমুনা দেয়ার পর হাটে-বাজারে ও আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে যাচ্ছেন। এছাড়া অনেক মানুষ তাদের নমুনা পরীক্ষার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করলেও সীমাবদ্ধতার কারণে করতে পারছেন না বলেও জানান তিনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় কার্যালয় সূত্র জানায়, করোনা পরীক্ষায় ব্যবহৃত একটি পিসিআর কিটের মূল্য ২৫০০ থেকে ২৮০০ টাকা। পরীক্ষা কিট, ল্যাবরেটরি ফ্যাসিলিটি ও জনবলের ব্যয়সহ একজন রোগীর পরীক্ষার পেছনে ব্যয় হয় প্রায় সাড়ে ৩ হাজার টাকা। তবে সরকার এই পরীক্ষা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে করছে। সিলেটে করোনার সন্দেহভাজন মানুষের সংখ্যা বাড়ায় পরীক্ষা করতে সময় লাগছে। তাই রিপোর্ট প্রদানে বিলম্বিত হচ্ছে। সিলেট জেলায় পরীক্ষার জন্য নমুনা প্রদান করে গত ২ জুন থেকে অপেক্ষারত রোগীর সংখ্যা প্রায় দেড় হাজারের কাছাকাছি। বিভাগজুড়ে যার সংখ্যাটা আরো বেশি। দুটি ল্যাবে জমা পড়া এসব অতিরিক্ত নমুনার ফল জানতে পাঠানো হয়েছে ঢাকায়। এজন্য ফল পেতে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে।
অপর একটি সূত্রে জানা গেছে, সিলেটে করোনা ভাইরাস শনাক্তকরণে ব্যবহৃত পিসিআর মেশিন সংখ্যা প্রয়োজনীয় তুলনায় কম। রয়েছে দক্ষ জনবলেরও অভাব। যার কারণে ভাইরাস শনাক্তকরণ পরীক্ষার রিপোর্ট সময়মতো দেয়া যাচ্ছে না। নমুনা সংগ্রহ করেও মেশিন এবং জনবল সংকটে তা পরীক্ষা করা যাচ্ছে না। বিভাগের চারটি জেলার মধ্যে শুধু সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে করোনাভাইরাস শনাক্তের জন্য পিসিআর ল্যাবে নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। এই দুটি ল্যাবে এখন চলছে নমুনা সংগ্রহের কাজ। প্রথম দিকে নমুনা পরীক্ষার ফলাফল পেতে সময় একদিন লাগলেও এখন নমুনা সংগ্রহ করে ফলাফল আসতে এক সপ্তাহ থেকে ১০-১২ দিন সময় লাগছে। ফলাফল দেরিতে আসার কারণে সম্ভাব্য করোনা ব্যক্তিরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন প্রকাশ্যে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আক্রান্তদের শরীরে তেমন উপসর্গ না থাকায় অনেকে বুঝতেও পারছেন না তিনি করোনা পজিটিভ কি না। ফলে, ওই ব্যক্তি নিজের পরিবারসহ অন্যদের সংর্স্পশে গিয়ে সংক্রমণ ছড়াচ্ছেন।
সিলেট বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সর্বশেষ সিলেট বিভাগে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ২ হাজার ৯৮৬ জন। এর মধ্যে সিলেট জেলায় ১ হাজার ৬৮৮, সুনামগঞ্জে ৭৮৫, হবিগঞ্জে ২৭৬ এবং মৌলভীবাজারে ২৩৭ জন। এরমধ্যে হাসপাতালে ভর্তি আছেন সিলেট জেলায় ৬৪, সুনামগঞ্জে ৯৮, হবিগঞ্জে ৩৪ এবং মৌলভীবাজারে ৩ জন। আর করোনায় আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত সিলেট বিভাগে মারা গেছেন ৫৬ জন। এরমধ্যে সিলেটে ৪৪, মৌলভীবাজারে ৪ জন, সুনামগঞ্জে ৪ জন এবং হবিগঞ্জে ৪ জন।
এ ব্যাপারে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা: হিমাংশু লাল রায় বলেন, সিলেটের দুটি পিসিআর ল্যাবে দৈনিক প্রায় ৪০০টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। তবে এতেও কুলোচ্ছে না এখন। প্রথমদিকে আমাদের নমুনার রেজাল্ট একদিনের মধ্যে পাওয়া যেতো। দিনে দিনে সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ফলাফল আসতে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। অতিরিক্ত নমুনা ঢাকায় প্রেরণ করে ফল জানতে সময় লাগছে ৭ থেকে ৮ দিন।
তিনি বলেন, নমুনা দেয়ার পর ফলাফল না আসা পর্যন্ত ওই ব্যক্তি বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। এতে করে কমিউনিটিতে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে।
সার্বিক বিষয় নিয়ে কথা হয় সিলেট বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ডা: আনিসুর রহমানের সাথে। ফলাফল দেরিতে আসার কথাটি স্বীকার করে তিনি বলেন, নমুনা সংগ্রহের চাপ কমাতে উপসর্গবিহীন কাউকে পরীক্ষা না করতে নির্দেশনা রয়েছে। গত দুই জুন থেকে নমুনা পরীক্ষার চাপ বেড়েছে। এ কারণে সিলেট বিভাগের বেশ কিছু নমুনা ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। কিছু রিপোর্ট পেলেও এখনো অনেক রিপোর্ট পাওয়া যায়নি।