রাজধানীর মিরপুর-১২ বুড়িরটেক এলাকার বাসিন্দা মাহমুদা আক্তার প্রাণে বাঁচতে সম্প্রতি স্বামীর ঘর ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন পল্লবীর কালাপানির মায়ের বাসায়। দীর্ঘদিন ধরে স্বামী শাহিনুদ্দিনেরর সঙ্গে কলহ চলে আসছিল তার। তবে মহামারী করোনায় দমবন্ধ পরিস্থিতিতে এটি মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। শ্বশুরালয়ে ছোটখাট নানা বিষয়ে কটূক্তি থেকে শুরু করে, মিথ্যা অপবাদ এমনকি অমানবিকভাবে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ মাহমুদার। শেষ পর্যন্ত বিবাহ বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। এ সংক্রান্ত আইনানুগ প্রক্রিয়াও শুরু করেছেন। গতকাল রবিবার আমাদের সময়কে জানিয়েছেন এ গৃহবধূ।
পারিবারিক কলহে অতিষ্ঠ হয়ে গত শনিবার রাজধানীর হাজারীবাগের ১০৯ গজমহল রোডের বাসায় গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মঘাতী হন গৃহবধূ সাহেলা আক্তার। স্থানীয়রা বলছেন, মৃত্যুর আগে স্বামী আব্দুল্লাহ আল মামুনের সঙ্গে সাহেলার কথা কাটাকাটি ও হাতাহাতি হয়েছিল। পারিবারিক কলহ থেকে মুক্তি পেতে ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকেও চিরবিদায় নিতে এ পথ বেছে নিয়েছেন এ নারী।
শুধু মাহমুদা ও সাহেলাই নন, প্রতিনিয়তই তাদের মতো নির্যাতন-নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন বিভিন্ন নারী। মহামারী করোনাকালে দমবন্ধ পরিস্থিতিতে বরং পারিবারিক সহিংসতা-নির্যাতনের ঘটনা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরাও উদ্বেগের সঙ্গে এমনটাই জানাচ্ছেন। তারা বলছেন, আগে যারা নির্যাতনের শিকার হতেন তারা এখন আরও বেশি নির্যাতিত হচ্ছেন। এমনকি যারা কখনই নির্যাতিত হননি, তারাও এখন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। প্রতি ৪ নারীর মধ্যে ১ জনেরও বেশি নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছেন।
সব মিলিয়ে পরিস্থিতি ভয়াবহ। গত মে মাসের ৩১ দিনে দেশের ৫৩ জেলায় সহিংসতার শিকার হয়েছেন ১৩ হাজার ৪৯৪ নারী-শিশু। এদের মধ্যে ৪ হাজার ১৬০ জন আগে কখনই সহিংসতার শিকার হননি। নারী-শিশু নির্যাতনের হার বেড়ে গেছে ৩১ শতাংশ। নতুনভাবে সহিংসতার শিকার নারী ও শিশুর মধ্যে ১ হাজার ৩১৯ জন শিশু (৬১ শতাংশ) এবং ২ হাজার ৮৪১ নারী (২৫ শতাংশ)। সেই হিসাবে প্রতি ১০ শিশুর ৬টি এবং প্রতি ৪ নারীর মধ্যে ১ জনেরও বেশি নতুন আক্রান্ত। ৫৩ হাজার ৩৪০ নারী-শিশুর সঙ্গে কথা বলে তৈরি মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের (এমজেএফ) প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য। এতে বলা হয়েছেÑ নারী-শিশু নির্যাতনের অভিন্ন চিত্র দেশের সব জেলাতেই।
এর উল্টো চিত্রও আছে। অর্থাৎ নারী কর্তৃক পুরুষ নির্যাতনের ঘটনাও দেশে নেহায়েত কম নয়। নির্যাতিত পুরুষের অধিকার রক্ষায় কাজ করা বেসরকারি সংগঠন বাংলাদেশ ম্যানস রাইটস ফাউন্ডেশন (বিএমআরএফ) বলছে, লকডাউন পরিস্থিতিতে নারী নির্যাতনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে পুরুষ নির্যাতনের ঘটনাও। শতকরা হিসাবে ৪৫ ভাগ। করোনা পরিস্থিতির আগে প্রায় প্রতিটি জেলা থেকে দৈনিক যেখানে এক-দুটি অভিযোগ পাওয়া যেত, সেখানে গত ৩ মাসে প্রায় প্রতিদিনই গড়ে ৪ থেকে ৫ জন পারিবারিক সহিংসতার শিকার হওয়া পুরুষ মোবাইল ফোনে তাদের অভিযোগ জানিয়েছেন। গত মে মাসেই অভিযোগ এসেছে দুইশর মতো। আগের তুলনায় সংসারের ব্যয়ভার মেটাতে না পারার কারণে স্ত্রীর দ্বারা লাঞ্ছনা-গঞ্জনার শিকার হওয়া পুরুষদের কাছ থেকে এসেছে বেশিরভাগ অভিযোগ। করোনা ভাইরাস আক্রান্ত সন্দেহে অসুস্থ গৃহকর্তাকে নিজের ঘরেই স্ত্রী-সন্তানরা ঢুকতে দেয়নি বা পাশের ঘরে আটকে রেখেছে-এমন অভিযোগও মিলেছে। স্ত্রীর মারধর সইতে না পেরে গত মঙ্গলবার লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন আহাম্মদ শরিফ নামে এক কাপড়ব্যবসায়ী।
বর্তমানে নারী ও পুরুষ নির্যাতনের জন্য গৃহবন্দি জীবনের একঘেয়েমি, অস্থিরতা, টেনশন, কর্মহীনতা ও অভাবকেই দায়ী করছেন মানবাধিকারকর্মী ও বিশিষ্টজনরা। তাদের মতে, বর্তমান কঠিন পরিস্থিতিতে এক ধরনের পুরুষদের কাছে স্ত্রীরা হয়ে উঠেছেন তাদের রাগ দেখানোর সহজ উপাদান। একটু বেশি সময় নিয়ে মোবাইল ফোনে কথা বলার মতো ছোটখাটো বিষয়েও মিথ্যা অপবাদ এমনকি চলে শারীরিক নির্যাতনও। আগে থেকেই যারা স্ত্রীর ওপর নির্যাতন চালাতেন, বর্তমানে গৃহবন্দি অবস্থায় সেসব স্বামী নির্যাতনের আরও নতুন নতুন ছুঁতো খুঁজে হামলে পড়ছেন সহধর্মিণীর ওপর। এ প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে মদ্যপায়ীদের মধ্যে।
এদিকে সারাক্ষণ ঘরে থাকা, করোনা পরিস্থিতি সামাল দিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যস্ত থাকা, পারিবারিক নিরাপত্তাহীনতা ইত্যাদি কারণে বেড়ে গেছে নারী নির্যাতন ও বাল্যবিবাহের মতো ঘটনা। আবার বেকার অবস্থায় আর্থিক দৈন্যের কারণ ছাড়াও গৃহবন্দি অবস্থায় দীর্ঘক্ষণ শুয়ে-বসে কাটানো, মোবাইল ফোনে গেমস খেলার মতো তুচ্ছ ঘটনায়ও স্বামীদের শারীরিক না হলেও মানসিক যন্ত্রণা দিচ্ছেন নারীদের কেউ কেউ। স্বামীর গায়ে হাত তুলছেন, এমন নারীর সংখ্যাও কম নয়। এভাবে চলতে থাকলে দেশে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন বিশেষজ্ঞরা।
বিএমআরএফ চেয়ারম্যান শেখ খায়রুল আলম গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, পুরুষশাসিত এ সমাজে নিজ ঘরেই নির্যাতিত পুরুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তাদের কেউ শারীরিকভাবে, কেউবা মানসিকভাবে, আবার কেউ কেউ আর্থিক নতুবা সামাজিকভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন। সামান্য বিষয়েও স্বামীকে সহ্য করতে পারছেন না স্ত্রী। গতকাল রবিবারও রাজধানীর মিরপুর ও রামপুরা থেকে দুটি এবং নারায়ণগঞ্জের ভূঁইগড়, কুমিল্লার দেবিদ্বার, বিক্রমপুর, সিলেট থেকে ৯ নির্যাতিত পুরুষ ফোনে যোগাযোগ করে জানতে চেয়েছেন, এখন তাদের কী করণীয়।
অবসরপ্রাপ্ত এক সরকারি কর্মকর্তা অভিযোগ জানান মিরপুর-১০ থেকে। তিনি বলেন, শুধু কাশি থাকায় কোনো ধরনের পরীক্ষা ও চিকিৎসা না দিয়ে ৮ দিন একটি ঘরে তাকে আটকে রাখেন তার স্ত্রী। হবিগঞ্জ থেকে একজন জানিয়েছেন, তার স্ত্রী পুলিশে চাকরি করেন। আগেও তাকে শারীরিক নির্যাতন করতেন স্ত্রী। করোনা পরিস্থিতিতে এটি মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। এর পরও সন্তানের কথা চিন্তা করে মুখবুজেই সব নির্যাতন সহ্য করছেন তিনি। নারায়ণগঞ্জের ভূঁইগর থেকে ভুক্তভোগী এক পুরুষ জানান, ১০ বছর দুবাই ছিলেন। করোনার প্রাদুর্ভাবের আগে দেশে ফেরেন তিনি। এর কিছুদিন পর স্ত্রীর পরকীয়ার বিষয়টি বুঝতে পারেন। একদিকে সন্তানের ভবিষ্যৎ, অন্যদিকে স্ত্রীর কাছে গচ্ছিত সম্পদের কথা চিন্তা করে মুখ বুজেই ছিলেন তিনি; কিন্তু করোনাকালে তার সামনেই পরকীয়া প্রেমিকের সঙ্গে কথা বলেন ওই স্ত্রী। কিছু বললেই মারধর করেন এবং মামলার ভয় দেখান স্বামীকে। লোকলজ্জা ভুলে বিষয়টি এলাকার মসজিদের ইমামের কাছে জানিয়েছেন ভুক্তভোগী স্বামী। রামপুরা থেকে এক গার্মেন্ট ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, রামপুরায় ২৮ হাজার টাকা ভাড়া ফ্ল্যাটে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে থাকেন তিনি। করোনাকালের আগে ভালোই চলছিলেন। করোনা পরিস্থিতির কারণে তার ব্যবসায় ধস নামে; কিন্তু তার স্ত্রী আগের মতো চাহিদা অনুযায়ী টাকা না পেয়ে প্রায়ই মানসিক নির্যাতন করে আসছিলেন। সম্প্রতি এ নিয়ে ঝগড়া বাধলে দুই সন্তানকে ফেলে বিবাহ বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন ওই ব্যবসায়ীর স্ত্রী। সংসার বাঁচাতে এখন কী করবেন তা জানতে চেয়ে ফোন করেছিলেন ওই ব্যবসায়ী। এ ধরনের পাঁচ শতাধিক ঘটনা গত তিন মাসে পেয়েছে সংস্থাটি।
খায়রুল আলম আরও জানান, মূলত সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, নৈতিক স্খলন, লোভ-লালসা, উচ্চাবিলাস, পরকীয়া, মাদকাসক্তি, অর্থনৈতিক দৈন্য, বিশ্বায়নের ক্ষতিকর প্রভাব, অবাধ আকাশ সংস্কৃতির প্রবাহসহ নানা কারণে পুরুষ নির্যাতনের ঘটনা বাড়ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সন্তানের ভবিষ্যৎ, সামাজিক মর্যাদা, চক্ষলজ্জা, থানাপুলিশ আর উল্টো মামলার ভয়ে নীরবে সব সহ্য করছেন ভুক্তভোগীরা। তা ছাড়া পুরুষ নির্যাতন প্রতিরোধে দেশে সুনির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। নারী ও শিশু নির্যাতন বিচারে ট্রাইব্যুনাল থাকলেও পুরুষদের জন্য এখনো তা করা হয়নি বলে ভুক্তভোগীরা সঠিক আইনি সেবা পাচ্ছেন না।
অন্যদিকে এমজেএফের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম জানান, মহামারী করোনা পরিস্থিতিতে নিজ ঘরে সুরক্ষা ও নিরাপত্তার পরিবর্তে দেশের অনেক স্থানে নারী ও মেয়ে শিশুরা নানা ধরনের সহিংসতার শিকার হচ্ছে। আগে যারা নির্যাতনের শিকার হতেন তারা আরও বেশি নির্যাতিত হচ্ছেন। আবার যারা আগে নির্যাতিত হননি, তারাও এখন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, যা উদ্বেগজনক। এটা প্রমাণ করে লকডাউনের মধ্যে নির্যাতন বাড়ছে। আর এ নির্যাতনে স্বামীরাই প্রধানত জড়িত। কারণ তাদের অনেকেরই কোনো কাজ নেই, আয় নেই; ঘরে খাবার নেই। তারা বাইরে যেতে পারছেন না, আড্ডা দিতে পারছেন না। এ সব কিছুর জন্য কেউ কেউ ঘরের নারীকেই দুষছেন। নারীকে দায়ী করার এ মানসিকতার পেছনে নির্যাতনের প্রচলিত মানসিকতাই কাজ করছে। এর বাইরে শ্বশুর-শাশুড়ি এবং পরিবারের অন্য সদস্যদেরও ভূমিকা রয়েছে।
দুর্বৃত্তায়নের পাশাপাশি গৃহবন্দি জীবনে অস্থিরতা, টেনশন ও অভাবের কারণে এখন বেড়ে গেছে নারী-শিশু ধর্ষণ ও পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা। গৃহ সহিংসতার শিকার এসব নারী চলমান করোনা পরিস্থিতির কারণে আইনি সহায়তা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। আবার অনেককে উদ্ধার করার চেষ্টা করা হলেও করোনার কারণে আশ্রয়কেন্দ্রে জায়গা মিলছে না। এ সময়ে নারীর অভিযোগ জানানোর সুযোগ কমে গেছে। কারণ ঘরের বাইরে যেতে পারেন না অনেকেই। আবার স্বামীসহ সবাই ঘরে থাকায় টেলিফোনেও অভিযোগ করতে পারেন নাÑ এটাও বাস্তবতা। তাই নারী, শিশুর প্রতি সহিংসতা রোধে আইনি ব্যবস্থার পাশাপশি সচেতনতামূলক কর্মসূচির প্রয়োজন বলেও মনে করেন এমজেএফের নির্বাহী পরিচালক।
মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ডা. মালেকা বানু বলেন, করোনায় অনেক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ায় অলস সময় অতিবাহিত করছে। অর্থনৈতিক টানাপড়েন, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে হতাশা ও অস্থিরতাবোধ করায় পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সহিংস আচরণের ঘটনা ঘটছে। করোনা পরিস্থিতিকালে পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে অন্য সময়ের তুলনায় পারিবারিক সহিংসতা বেশি বেড়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মানুষকে ঘরে রাখতে ব্যস্ত থাকায় সুযোগ নিচ্ছে দুষ্কৃতকারীরা।