শনিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৩৫ পূর্বাহ্ন

বাড়ছে সংক্রমণের ঝুঁকি ফল পেতে বিলম্ব

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : বুধবার, ২৪ জুন, ২০২০
  • ২৩৫ বার

করোনা শনাক্তে নমুনা সংগ্রহ করার একদিন পর রিপোর্ট পাওয়ার কথা থাকলেও দেশের কোথাও কোথাও ১০ থেকে ১২ দিন সময় লেগে যাচ্ছে। কখনো আবার রিপোর্টই মিলছে না। পরীক্ষার রিপোর্টে সন্দেহ হওয়ায় কেউ কেউ দ্বিতীয় দফা টেস্ট করেছেন। করোনার শনাক্তকরণ পরীক্ষায় চলছে হ-য-ব-র-ল অবস্থা। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিলম্বে রিপোর্ট দেওয়ায় সংক্রমণ ঝুঁকি আরও বাড়ছে।

শ্রীপুর উপজেলার বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন (ছদ¥নাম) জ্বর ও ব্যথা নিয়ে করোনার পরীক্ষার জন্য গত ৩১ মে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নমুনা দেন। নমুনা দেওয়ার ২ দিন পর জ্বর ভালো হয়ে যায় এবং তিনি টেস্টের রিপোর্ট না পেয়ে পরিবারের অন্য সদস্যের সঙ্গে একত্রে থাকেন। প্রায় ১১ দিন পর গত ১০ জুন ফোন করে জানানো হয় তার করোনা পজিটিভ। এরপর থেকে তিনি প্রতিনিয়ত মোবাইল ফোনে লক্ষ্য রাখছেন কিন্তু কোনো এসএমএস দেওয়া হয়নি। টেস্টের রিপোর্ট পেতে বিলম্ব হওয়ায় তিনি পরিবারের কেউ সংক্রমিত হয়েছেন কিনা সেটি অজানাই রয়ে গেছে। রিপোর্ট নিয়ে তার সন্দেহ থাকায় ১৪ জুন ঢাকার একটি হাসপাতালে নমুনা দেন। কিন্তু সেখান থেকেও কিছু জানানো হয়নি।

রাজধানীর সুবজবাগ এলাকার মিনহাজুল ইসলাম সর্দি ও জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পরীক্ষার জন্য মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সামনে টানা তিন দিন লাইনে দাঁড়ান। কিন্তু প্রতিদিন তার সামনে বেশি সংখ্যক মানুষ থাকায় সিরিয়াল পাননি। পরীক্ষার চেষ্টা করতে করতে জ্বর ভালো হয়ে যাওয়ায় তিনি আর পরীক্ষা করাননি। পরিবারের সঙ্গে একত্রে বসবাস শুরু করেন।

রাজধানী ও রাজধানীর বাইরে করোনা পরীক্ষার এমন অনেক উদাহরণ আছে। কেউ কেউ পরীক্ষা করাতে পারছেন না, আবার কেউ পরীক্ষা করিয়ে সময়মতো রিপোর্ট পাচ্ছেন না। নমুনা দেওয়ার ১০ থেকে ১২ দিন পর রিপোর্ট পাচ্ছেন। ফলে বাধ্য হয়ে পরিবারের সঙ্গে একত্রে বাস করতে শুরু করছেন। এতে সংক্রমণে ঝুঁকি বাড়ছে। অথচ সরকার সংক্রমণ ঠেকাতে পিসিআর ল্যাবের সংখ্যা একটি থেকে বাড়িয়ে ৬৫টিতে উন্নীত করেছে। তারপরও রোগীর অতিরিক্ত চাপ, টেস্টিং সুবিধার ঘাটতি ও দক্ষ জনবলের অভাবে রিপোর্ট সময়মতো সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না।

অভিযোগ রয়েছে, করোনা পরীক্ষার ফল পেতে বিলম্বের কারণে দেশে অনেকেই বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন। কারণ টেস্ট রিপোর্ট দেখাতে না পারলে করোনার চিকিৎসায় সরকার নির্ধারিত হাসপাতালগুলোয় রোগীদের নেওয়া হচ্ছে না। আবার করোনার নেগেটিভ রিপোর্ট না থাকলে নন-কোভিড হাসপাতালে ভর্তি নিচ্ছে না। করোনা সংক্রমিত হয়ে জ্বর বা অন্য উপসর্গ দেখা দেওয়ার পর যারা সুস্থ হয়ে নিজের অজান্তেই পরিবার ও আশপাশের মানুষদের সংক্রমিত করছেন।

জানা গেছে, গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। তখন দেশে ল্যাবরেটরি ছিল মাত্র একটি, আইইডিসিআর। রোগী বেড়ে যাওয়ায় বিশেষজ্ঞদের সমালোচনার মুখে মার্চ মাসের শেষ দিকে ল্যাবরেটরির সংখ্যা বাড়ানো শুরু করে সরকার। বর্তমানে ৬৫টি ল্যাবে করোনা পরীক্ষা হচ্ছে। এর মধ্যে ৩৫টি ল্যাবরেটরি রাজধানীতে আর ৩০টি রাজধানীর বাইরে। বর্তমানে দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ২১ জেলায় ল্যাবরেটরি চালু আছে, বাকি ৪৩টিতে ল্যাব নেই। ওইসব জেলা-উপজেলার মানুষকে পরীক্ষার ক্ষেত্রে গিয়ে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। তারা স্থানীয় জেলা-উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নমুনা দেওয়ার পর সেগুলো ঢাকা বা নিকটবর্তী ল্যাবে পাঠানো হয়ে থাকে। এসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে এবং ল্যাবে নমুনা বেশি জমা পড়ায় টেস্টের রিপোর্ট সময়মতো পাচ্ছেন না। আবার অনেকে পরীক্ষার রিপোর্ট নিয়ে সন্দেহ থাকায় দ্বিতীয় দফা টেস্ট করছেন।

জানা গেছে, করোনা টেস্ট করাতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি সংকটে রয়েছে উপজেলা বা প্রত্যন্ত এলাকার সাধারণ মানুষ। জরুরি টেস্ট করাতে তাদের দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে জেলা বা উপজেলা শহরের স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যেতে হয়। নমুনা দেওয়ার পর সেখান থেকে নিকটবর্তী ল্যাব বা ঢাকার ল্যাবে পাঠানো হয়। নমুনা সংগ্রহ, সংরক্ষণ, ল্যাবে ও পরীক্ষাকরণের মধ্যে ১০-১২ দিন পার হয়ে যায়। এরই মধ্যে রোগীর উপসর্গ সেরে গেলে তিনিও পরিবার, পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে ওঠাবসা করছেন, যাচ্ছেন হাটে-বাজারেও। ফলে সংক্রমণ বাড়ছে। আবার যে টেকনোলজিস্টরা নমুনা সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও পরীক্ষা করেন, তাদের দক্ষতা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। করোনা ভাইরাসের লকডাউনের সময়ে তাদের বেশির ভাগের প্রশিক্ষণ হয়েছে অনলাইনে, ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে। দক্ষতার অভাব থাকায় টেস্টের ফল ভুল আসার আশঙ্কা থেকে যায়।

আইইডিসিআরের প্রিন্সিপাল বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এএসএম আলমগীর বলেন, এখন পরীক্ষার চাপ কয়েক গুণ বেড়েছে। ফলে রিপোর্ট পেতে ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লেগে যাচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষে এর চেয়েও বেশি সময় লাগছে। রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় পরীক্ষার রিপোর্ট পেতে বিলম্ব হচ্ছে। অনেক ল্যাবে একটি করে মেশিন রয়েছে। একটি মেশিনে এক শিফটে ৯২টি নমুনা পরীক্ষা করা যায়। দুই বা তিন শিফট পর্যন্ত কাজ করতে পারলে প্রায় ৩০০ নমুনা পরীক্ষা করা সম্ভব। কিন্তু ল্যাবগুলোয় নমুনা জমা পড়ছে অনেক বেশি। আবার অনেক সময় মেশিনে একটু সমস্যা দেখা দিলে সেদিন কাজ বন্ধ, তখন নমুনা জমা হয়ে যায়। তা ছাড়া করোনা পরীক্ষা পদ্ধতি নতুন। সব মিলিয়ে রিপোর্ট পেতে বিলম্ব হচ্ছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, পরীক্ষার জন্য যারা নমুনা দিচ্ছেন তাদের রিপোর্ট পেতে ১০-১২ দিন বিলম্ব হচ্ছে। করোনা উপসর্গ চলে যাওয়া রোগীরা অনেকের সঙ্গে মিশে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। এই বিলম্বের কারণে সংক্রমণ ঝুঁকি বাড়ছে। এখন পর্যন্ত দেশে সঠিকভাবে লকডাউন পালিত হয়নি।

অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৪৩টিতে পিসিআর ল্যাব নেই। এতে বুঝা যায় সারাদেশের অধিকাংশ মানুষ পরীক্ষার আওতায় নেই। করোনা সংক্রমণ রোধে তিনটি ব্যবস্থা গ্রহণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমটি হচ্ছে পরীক্ষা করা, দ্বিতীয়টি পরীক্ষায় যাদের পজিটিভ হবে তাদের আইসোলেশনে নেওয়া এবং তৃতীয়টি হচ্ছে রোগীর সংস্পর্শে যারা আসছেন তাদের কোয়ারেন্টিনে নেওয়া। যেখানে টেস্ট কম হচ্ছে সেখানে শনাক্ত কম হচ্ছে। যারা শনাক্ত হচ্ছে তাদের আইসোলেশন ব্যবস্থা দরকার সেটি ঠিকমতো নেই এবং প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থা নেই। এই অবস্থায় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বর্তমানে ৬৫টি ল্যাবে প্রতিদিন ১৮ হাজার নমুনা পরীক্ষা করা সম্ভব। কিন্তু প্রতিদিন তার থেকে কয়েকগুণ বেশি মানুষ নমুনা দিচ্ছে। ফলে অনেক পরীক্ষা কেন্দ্রের সামনে লম্বা লাইন ধরে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়।

যেসব জেলায় যে ল্যাব আছে

ঢাকা জেলায় ১টি, চট্টগ্রাম জেলায় ৫টি, কুমিল্লা জেলায় ১টি, নোয়াখালী ২টি, কক্সবাজার ১টি, ময়মনসিংহ ১টি, জামালপুর জেলায় ১টি, রাজশাহী জেলায় ২টি, সিরাজগঞ্জ ১টি, বগুড়া ২টি, রংপুর ১টি, দিনাজপুর ১টি, সিলেট ২টি, খুলনা ১টি, যশোর ১টি, কুষ্টিয়া ১টি, বরিশাল ১টি, কিশোরগঞ্জ ১টি, ফরিদপুর ১টি, নারায়ণগঞ্জ ২টি এবং গাজীপুর জেলায় ২টি ল্যাব রয়েছে। আর বাকি ৪৩টি জেলায় কোনো ল্যাব নেই।

গত ১৮ জুন দুপুরে স্বাস্থ্য বুলেটিনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, কোভিড পরীক্ষার কাজ সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সম্প্রসারিত হবে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় যে পর্যায়ে পর্যন্ত আরটি-পিসিআর পরীক্ষা যত দ্রুত সম্ভব সম্প্রসারিত হবে। আরও নতুন নতুন সহজে করা যায় এমন পরীক্ষা চালু করা হবে। উপজেলা হাসপাতাল পর্যন্ত এই ধরনের পরীক্ষা চালু করার প্রচেষ্টা নেওয়া হবে।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com