করোনায় অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবিলায় ১৯টি প্যাকেজের আওতায় ১ লাখ ৩ হাজার ১১৭ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছে সরকার। এর মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ঋণ বিতরণ করা হবে ৭৬ হাজার কোটি টাকা। এসব ঋণ গ্রহণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী এবং উদ্যোক্তাদের আগ্রহ অনেক বেশি। ব্যাংকগুলোয় আবেদনও জমা পড়েছে।
কিন্তু ব্যাংকগুলোর অনীহার কারণ ঋণ বিতরণ হচ্ছে না। রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের বাড়তি ১৩ হাজার কোটি টাকা বাদ দিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর যে ৬৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করার কথা তার মধ্যে করেছে মাত্র ৯ হাজার কোটি টাকা। এমনও প্যাকেজ আছে যে কেনো ঋণ বিতরণ শুরুই হয়নি। শুধু একটি প্যাকেজ ছাড়া অন্যগুলোর ঋণ বিতরণ একেবারেই তলানিতে। উদ্যোক্তারা বলছেন, ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে চাচ্ছে না। আর ব্যাংকগুলো বলছে, যাচাই-বাছাই করে ঋণ দেওয়া হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রণোদনা প্যাকেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের জন্য সর্বমোট ৮টি প্যাকেজের আওতায় ৭৮ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা দেওয়া হবে। এর মধ্যে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) আকার ১২ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা বৃদ্ধি এবং এপ্রিল ও মে মাসের স্থগিত সুদের ভতুর্কি হিসেবে ২ হাজার কোটি টাকা সরকারিভাবে বিশেষ পদ্ধতিতে দেওয়া হবে। বাকি ৬টি প্যাকেজের আওতায় ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ঋণ বিতরণ করা হবে ৬৩ হাজার কোটি টাকা। এই অর্থের মধ্যে ব্যাংকগুলোকে পুনঃঅর্থায়ন
হিসেবে ৩৩ হাজার কোটি টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং সরকার দেবে ৫ হাজার কোটি টাকা। শুধু বেতন প্যাকেজের ঋণ বরাদ্দের তুলনায় বেশি বিতরণ হয়েছে। কয়েকটির শুরুই হয়নি এবং দুয়েকটির ঋণ বিতরণ একেবারে যৎসামান্য।
করোনার কারণে সবার আগে ঘোষণা করা হয় রপ্তানিমুখী শিল্পের ৫০ লাখ শ্রমিকের বেতন দিতে ৫ হাজার কোটি টাকার তহবিল। এককালীন ২ শতাংশ সার্ভিস দিয়ে বিনা সুদে এই ঋণ নিচ্ছেন রপ্তানিকারকরা। এপ্রিল, মে ও জুন মাসের বেতন দিতে গঠিত এই তহবিলের অর্থ দুই মাসেই ফুরিয়েছে ৪ হাজার ৮২১ কোটি টাকা। ১ হাজার ৯৯২টি প্রতিষ্ঠান ৪৭টি ব্যাংকের মাধ্যমে এপ্রিলে ২ হাজার ৭২৬ কোটি এবং মে মাসে ২ হাজার ৯৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। জুন মাসের বেতন দিতে সরকারের কাছে অর্থ চেয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে সরকার থেকে কোনো অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। বড় শিল্প সেবা খাতের জন্য গঠিত ৩০ হাজার কোটি টাকার তহবিল থেকে বেতন প্যাকেজে আড়াই হাজার কোটি দেওয়া হচ্ছে। আবার এই প্যাকেজ থেকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেওয়া হচ্ছে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা।
করোনার প্রণোদনা ঋণের সবচেয়ে বড় ৩০ হাজার কোটি টাকা প্যাকেজে থেকে অন্য দুটি খাতে ঋণ দেওয়ায় এই প্যাকেজের আকার দাঁড়িয়েছে ২৬ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। উদ্যোক্তারা সাড়ে ৪ শতাংশ সুদে ঋণ পাবেন আর বাকি সাড়ে ৪ শতাংশ সুদ ভর্তুকি হিসেবে সরকার পরিশোধ করবে। ব্যাংকগুলোকে অর্থসহায়তা তহবিলের অর্ধেক পুনঃঅর্থায়ন করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই ২৬ হাজার ৩০০ কোটি টাকার মধ্যে গতকাল পর্যন্ত বিতরণ হয়েছে মাত্র ৪ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা। সর্বমোট ২৮৯টি প্রতিষ্ঠান এই ঋণ পেয়েছে। গত এপ্রিলে এই তহবিল গঠন করা হয়।
করোনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এসএমই খাত। এই খাতের উদ্যোক্তাদের জন্য গঠন করা হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল। ৪ শতাংশ সুদে চলতি মূলধন হিসেবে ঋণ পাবেন উদ্যোক্তারা। এই তহবিলের অর্ধেক অর্থের জোগান দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু এপ্রিল পর থেকে গতকাল পর্যন্ত বিতরণ হয়েছে মাত্র ২০০ কোটি টাকা। সারাদেশে এসএমই উদ্যোক্তা রয়েছে। কিন্তু এই প্যাকেজের আওতায় ঋণ দিতে ব্যাংকগুলো শাখাগুলোকে জানায়নি। উদ্যোক্তারা শাখায় যোগাযোগ করলে শাখা ম্যানেজাররা এ বিষয়ে কিছু জানেন না বলে বলছেন।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, করোনার ক্ষতি কটিয়ে উঠতে প্রণোদনা যথেষ্ট ছিল। কিন্তু ব্যাংকগুলো ঋণ দিচ্ছে না। ব্যাংকগুলো যে প্রক্রিয়ার কথা বলছে তা পরিপালন করে কোনো ক্ষুদ্র ও মাঝরি ব্যবসায়ীর পক্ষে ঋণ নেওয়া সম্ভব নয়। আসলে ঋণ না দেওয়ার জন্য ব্যাংকগুলো জটিলতা বাড়াচ্ছে।
রপ্তানিকারকদের প্রি-শিপমেন্ট ঋণ দিতে ৫ হাজার কোটি টাকা এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ঋণ দিতে ৩ হাজার কোটি টাকার তহবিল রয়েছে। এই দুটি তহবিল থেকে কোনো ঋণ বিতরণ শুরু হয়নি। এ দুটির তহবিলের পুরো টাকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুনঃঅর্থায়ন করবে।
এদিকে ব্যাংকগুলোর এ অনীহার কারণে দুই দফায় নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার রাতে সার্কুলার জারি করে জুলাইয়ের মধ্যে বেশিরভাগ এবং আগস্টের মধ্যে প্যাকেজের পুরো টাকা বিতরণের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকগুলোকে আগেই লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। গভর্নর ফজলে কবির অনলাইনে বৈঠকে করে লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে ঋণ দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। এর আগে ঋণ বিতরণের অগ্রগতি জানতে তদারকি বাড়ানোর অংশ হিসেবে প্রতি ১৫ দিন পর পর তথ্য জানাতে নির্দেশনা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগে মাসিকভিত্তিতে জানানোর নির্দেশনা ছিল।
এই ঋণ বিতরণ না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম। তিনি বলেন, অনেক ব্যাংক এগিয়ে এলেও কিছু ব্যাংক অনাগ্রহী। যারা ঋণ দিচ্ছে না সেসব ব্যাংক থেকে সরকারি আমানত তুলে নিতে হবে। যারা ঋণ দিচ্ছে তাদের বিভিন্ন সহযোগিতা দেওয়া যেতে পারে।
এদিকে ঋণ দেওয়ার বিষয়ে বেসরকারি একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ঋণের জন্য অনেকেই আবেদন করেছেন। এর মধ্যে কিছু গ্রাহক আছে যারা আগের ঋণ নিয়মিত ফেরত দেয়নি। তাদের ঋণ দিলে ফেরত না পাওয়ার ঝুঁকি আছে। আবার কিছু গ্রাহক করোনার আগে ঋণ নিয়েছেন কিন্তু করোনা সংকট শুরু হলে সেই ঋণ অব্যবহৃত অবস্থায় ফেলে রেখেছে। তারাও আবেদন করেছেন। অপ্রয়োজনে কাউকে ঋণ দিলে তা ফেরত পাওয়া নিয়ে ঝুঁকি আছে। কারণ ঋণ বিতরণ ব্যাংক করবে আদায়ও ব্যাংকগুলোকেই করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুনঃঅর্থায়ন করলেও তারা গ্রাহকের কাছ থেকে নয় ব্যাংকের কাছ থেকে অর্থ আদায় করবে। তাই যাচাই-বাছাই করে ঋণ দেওয়া হচ্ছে। তবে ভালো গ্রাহকদের ঋণ দিতে সমস্যা নেই। তারা চাইলেই ঋণ পাচ্ছেন।