স্তন ক্যান্সার নিরাময়ের প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে রোগ দ্রুত শনাক্ত করা। কিন্তু রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থার কারণে অনেক নারী এ নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনাও করতে চান না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তানে স্তন ক্যান্সারের হার সর্বোচ্চ। প্রতি বছর দেশটিতে ১৭ হাজারের বেশি নারী স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। যদিও পাকিস্তানের চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য সংক্রান্ত দাতব্য সংস্থাগুলোর হিসাবে এ সংখ্যা ৪০ হাজারের বেশি বলে বিবিসি বাংলা’র প্রতিবেদনে বলা হয়।
দেশটির প্রতি ৯ জনে একজন নারী স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন, কিন্তু সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ট্যাবুর কারণে নারীদের পক্ষে নিজের শরীরের একটি প্রত্যঙ্গ নিয়ে কথা বলা, কিংবা নিজের অসুস্থতা নিয়ে কথা বলা ভীষণ কঠিন। অথচ প্রকাশ না করলে সাহায্য পাওয়া যাবে না, আর তাতে আক্রান্ত রোগীর সেরে ওঠার সম্ভাবনা শূন্যতে নেমে আসে।
পাকিস্তানের ব্রেস্ট ক্যান্সার বিষয়ক দাতব্য সংস্থা পিংক রিবন ফাউন্ডেশনের ওমর আফতাব বলেন, ‘স্তন ক্যান্সার যেহেতু নারীর যৌন বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সম্পর্কিত, সে কারণে পাকিস্তানে এটি এক প্রায় নিষিদ্ধ আলোচনা। স্তন ক্যান্সারকে রোগ হিসেবে না দেখে লোকে একে যৌনতাবিষয়ক কিছু বলে মনে করে।’
এ রোগ থেকে আরোগ্য লাভ হওয়া রোগীরা জানিয়েছেন, যারই স্তন ক্যান্সার হয়, শারীরিক, আর্থিক এবং মানসিক-সমস্ত ধকল আক্রান্ত ব্যক্তির একলাই সামলাতে হয়।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সিলভাত জাফরের বয়স যখন কুড়ির কোঠায়, তিনি হঠাৎ আবিষ্কার করলেন তার স্তনের মধ্যে একটি আলাদা মাংস পিন্ড রয়েছে। বাড়ির সবাই তখন ডিজনী ওয়ার্ল্ডে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছে, ফলে পরিবারের কাছে প্রকাশ করলেন না ব্যাপারটি।
‘তাছাড়া আমাদের সমাজে নিজেদের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে মেয়েরা তেমন একটা কথাবার্তা বলে না,’ যোগ করেন সিলভাত।
তিনি বলেন ‘নিজের সমস্যা নিয়ে কোনো কথাই বলি না। আমি ‘ব্রেস্ট ক্যানসার’ শব্দটি মুখেই আনতে পারতাম না। আমার মা ছিলেন না, তিনি আগেই মারা গেছেন। ফলে বাড়ির একমাত্র নারী সদস্য হিসেবে আমি চুপ করে ছিলাম।’
ফোলানো নকশা করা, লেস আর কুচি দেয়া জামাকাপড় পড়ে সিলভাত নিজের বুকের ভেতরের বাড়ন্ত মাংসপেশীকে লুকিয়ে রাখতেন। ক্রমে বাড়তে থাকা শারীরিক যন্ত্রণার কথাও কাউকে বলতে পারতেন না। কিন্তু চুপচাপ ছয় মাস কাটিয়ে দেওয়ার পরে, সিলভাত যখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন, ততদিনে তিনি ক্যানসারের তৃতীয় ধাপে মানে স্টেজ থ্রিতে পৌঁছে গেছেন।
স্তনের ভেতরকার টিউমারটি আকারে বড় হয়েছে, এবং সারা শরীরে ক্যানসার ছড়িয়ে পড়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। কিন্তু এমন অবস্থা হওয়ার পরেও তার চিকিৎসা কার্যকরভাবে চলছে।
পাকিস্তানের অন্যতম প্রধান স্তন ক্যানসার বিশেষজ্ঞ ডা. হুমা মাজিদ সিলভাতের চিকিৎসা করছেন। লাহোরে ইত্তেফাক হাসপাতালে একটি ক্লিনিক চালান হুমা, যেখানে শত শত স্তন ক্যানসার আক্রান্ত রোগীকে চিকিৎসা দেন তিনি।
ডা. হুমা মাজিদ বলেন, ‘মেয়েরা পরিবারের কথা ভাবে, নিজের কথা কখনো আগে ভাবে না।’
পাকিস্তানি নারী রোগীদের ক্যান্সার চিকিৎসায় প্রধান বাধা ‘লজ্জা’। এছাড়া স্তন যেহেতু শরীরের একটি স্পর্শকাতর প্রত্যঙ্গ, বহু নারী এবং তাদের স্বামী চান না কোন পুরুষ চিকিৎসক নারীদের স্তন পরীক্ষা করে দেখুক।
ডা. মাজিদ বলেন, এর বাইরে আরও কারণের মধ্যে রয়েছে, সমাজের পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো, যার কারণে নারীর স্বাস্থ্যের গুরুত্ব এখনো অনেক কম।
এছাড়া দেশটির বড় শহরগুলো ছাড়া ক্যানসারের চিকিৎসা সহজে পাওয়া যায় না, যে কারণে অনেক নারী পরিবারের পুরুষ সদস্যের সহযোগিতা ছাড়া চিকিৎসা নিতে পারে না।
পাকিস্তানে স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত দরিদ্র রোগী বিশেষ করে যারা গ্রামে থাকেন তাদের ভোগান্তি বেশি।
সামাজিক বাধা : স্তন ক্যানসার আক্রান্ত ২০ বছর বয়সী সাবিয়া অপারেশনের পরে প্রথম চেক আপে এসেছেন ডা. মাজিদের কাছে।
গত বছর সাবিয়ার বাবা মারা গেছেন। যে কারণে বাড়িতে ভাইবোনদের খরচ যোগানোর জন্য পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে একটি চাকরি নিয়েছেন তিনি।
বাসে চড়ে আড়াই ঘন্টার যাত্রা করে ক্লিনিকে এসেছেন, এখানে তার চিকিৎসা চলছে, সে কথা দূরে থাক, তার বাড়ির কেউ এখনো জানে না তার স্তন ক্যানসার হয়েছে।
সাবিয়া বলেন, ‘খুবই অস্বস্তিকর ব্যাপারটা, সবার কাছে বলাও যায় না। আর সবাই জানলে ধরে নিন আপনার আর কোনো বিয়ের প্রস্তাব আসবে না। স্তন ক্যানসার হয়েছে, এমন কাউকে এ সমাজে কেউ মেনে নেবে না।’
‘শারীরিক অসুস্থতার সঙ্গে মানিয়ে চলার পর আপনার ওপর মানসিক নির্যাতন চলবে যে কেনো কোন বিয়ের প্রস্তাব আসছে না,’ যোগ করেন তিনি।
সিলভাতের ক্যানসার ভালো হয়ে গেছে এক দশকের বেশি সময় আগে, কিন্তু এখনো তার ভালো বিয়ের প্রস্তাব আসে না কেবল এই কারণে।
প্রসঙ্গত, অক্টোবর মাস সারা পৃথিবীতে স্তন ক্যানসার নিয়ে সচেতনতার মাস হিসেবে পালিত হয়। পাকিস্তানের পিংক রিবন ফাউন্ডেশন গত ১৫ বছর ধরে স্তন ক্যানসার নিয়ে কাজ করছে। কিন্তু অতি সম্প্রতি প্রথমবারের মতো তারা খোলাখুলি এ নিয়ে একটি আলোচনার আয়োজন করেছে।
রোগী, চিকিৎসক, সচেতনতার কাজে নিয়োজিত দাতব্য সংস্থা এবং উদ্যোক্তা সবাই একমত যে এ রোগ নিরাময়ে পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তন করতে হবে। অসুখ হলে গোপন না রেখে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। এটি নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে বুঝতে হবে।