পাঁচ বছর আগে সাবরিনা আরিফ চৌধুরীকে (সাবরিনা শারমিন হুসাইন) বিয়ের পর আরিফুল হক চৌধুরী অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে জেকেজি হেলথ কেয়ার গড়ে তোলেন। এমনকি সাবরিনাকে বিয়ের পরই তিনি স্বাস্থ্য খাতের ব্যবসায় আসেন। আরিফুলের ইভেন ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান ওভাল গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবেই জেকেজি পরিচালিত হচ্ছিল।
আরিফুল প্রধান হলেও প্রতিষ্ঠান দুটির চেয়ারম্যান হিসেবে পরিচয় দিতেন সাবরিনা। তার মাধ্যমেই স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন দিবসের কাজ পেয়ে আসছিল ওভাল গ্রুপ। এমনকি করোনার প্রাদুর্ভাব শুরুর পর বিনামূল্যে করোনা পরীক্ষার নমুনা সংগ্রহের কাজ পাওয়ার নেপথ্যেও রয়েছেন ডা. সাবরিনা।
এই দম্পতির উদ্দেশ্যই ছিল করোনা প্রাদুর্ভাবে নমুনা সংগ্রহে সরকারকে সহযোগিতার নাম করে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া। এ সময়ে প্রতিষ্ঠানটি সাধারণ মানুষের কাছ থেকে প্রায় সাড়ে ৭ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। জেকেবির প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে নমুনা সংগ্রহের অনুমতি পাওয়া পর্যন্ত সব কিছুতেই সাবরিনার হাত রয়েছে। এমনকি করোনার ভুয়া রিপোর্ট তৈরির বিষয়েও সব ধরনের টেকনিক্যাল সাপোর্ট দিয়েছেন সাবরিনা। জালিয়াতির অভিযোগে তেজগাঁও থানায় দায়ের করা মামলার তদন্ত করতে গিয়ে এসব তথ্য পেয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এই মামলায় সাবরিনাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল সোমবার ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত এই রিমান্ডের আদেশ দেন। এদিকে গত রবিবার এই মামলা তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। যে কোনো সময় থানা পুলিশের কাছ থেকে মামলার ডকেটসহ সবকিছু বুঝে নেবেন ডিবির কর্মকর্তারা।
ডিবির তেজগাঁও বিভাগের ডিসি গোলাম মোস্তফা রাসেল আমাদের সময়কে বলেন, জেকেজির মাধ্যমে কারা নমুনা পরীক্ষার সার্টিফিকেট নিয়েছে আমরা এসব বিষয়ও খতিয়ে দেখব। শুধু সাধারণ মানুষ ভুক্তভোগী হয়েছেন নাকি অন্য উদ্দেশ্যে তাদের কাছ থেকে সার্টিফিকেট নিয়েছেন তা-ও খতিয়ে দেখব। সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েই মামলাটি তদন্ত করা হবে।
পুলিশ জানিয়েছে, সাবরিনা ও তার স্বামী আরিফুল হক করোনার মহামারীতে তার জমানো টাকা খরচের নাম করে নমুনা পরীক্ষার কাজ নেন। মানবিক কাজ হওয়ায় অনেকেই তাদের সহযোগিতা করেন। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য সেবা করা ছিল না, সাধারণ মানুষের কাছ অর্থ হাতিয়ে নেওয়াই ছিল উদ্দেশ্য। সাবরিনার চেষ্টায়ই ৪৪টি বুথ থেকে নমুনা সংগ্রহের কাজ শুরু হয়। প্রায় ১৫ হাজার নমুনার ভুয়া রিপোর্ট দেয় প্রতিষ্ঠানটি। বিনামূল্যে নমুনা পরীক্ষার কথা থাকলেও প্রতিজনের কাছ থেকে তারা ৫ হাজার করে টাকা নিত। এই হিসেবে প্রায় সাড়ে সাত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে সাবরিনা জানিয়েছেন, জুনের শুরু থেকে সাবরিনা ও আরিফুলের মধ্যে পারিবারিক কলহ শুরু হয়। আরিফুল জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে গিয়ে সাবরিনাকে মারধরও করেন। এ ঘটনায় সাবরিনা শেরেবাংলানগর থানায় গত ৮ জুন স্বামীর নামে একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। তার পর বিবাহবিচ্ছেদের প্রক্রিয়া শুরু করেন। পরে তিনি সবাইকে জানিয়ে দেন, তিনি আর জেকেজির সঙ্গে নেই। পরে জুনের তৃতীয় সপ্তাহে পুলিশ জেকেজিতে অভিযান চালায়।
গত রবিবার দুপুরে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হৃদরোগ ইনিস্টিটিউট থেকে ডা. সাবরিনাকে পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের ডিসির কার্যালয়ে ডেকে নেয় পুলিশ। পরে তাকে তেজগাঁও থানায় দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পুলিশ বলছে, অনেক প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে না পারায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদিকে গ্রেপ্তারের পর গতকাল রবিবার জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের কার্ডিয়াক সার্জন ডা. সাবরিনাকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এর আগে বিনা মূল্যে পরীক্ষার অনুমতি নিয়ে জাল-জালিয়াতি করছিল জেকেজি। গ্রেপ্তার হন আরিফুল হক চৌধুরীসহ প্রতিষ্ঠানের আরও চার কর্মকর্তা-কর্মচারী। এমন পরিস্থিতিতে সাবরিনা পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানান, তিনি সরকারি কাজের অবসরে প্রতিষ্ঠানটিতে স্বেচ্ছাশ্রম দিয়েছেন।
তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ২০১৫ সালে সাবরিনাকে বিয়ে করার পর আরিফুল স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন ব্যবসায় আসেন। ওভাল গ্রুপের আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আছে। তাদের একটি বুটিক হাউসও আছে। করোনার এই সময় তাদের অন্য কাজ নেই। শুধু জেকেজি হেলথ কেয়ারের ওপর নির্ভর করেই সব চলছে। এই প্রতিষ্ঠানটিকে নমুনা সংগ্রহের দায়িত্ব দেওয়ার পেছনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তরের কেউ কেউ অতি উৎসাহী ছিলেন। তারা কেন, কী উদ্দেশ্যে তাদের নমুনা সংগ্রহের অনুমতি দিয়েছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
তেজগাঁও থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন বলেন, জেকেজির করোনার নমুনা পরীক্ষার ফল যে ভুয়া, সেটি আমরা নিশ্চিত হয়েছি। তারা জালিয়াতি করে ভুয়া পরীক্ষার ফল দিয়েছে।