এক বুজুর্গ ছিলেন আফগানিস্তানের গজনিতে ইলম ও আমলে পাকা৷ নাম তার মুহাম্মদ, উপনাম সাররাযি৷ ‘রায’ মা েআঙুর৷ ‘সার’ মা েমাথা৷ এ বুজুর্গ আঙুরের লতাপাতা খেয়ে জীবন কাটিয়েছেন একটানা বহু বছর৷ সেই সুবাদে তার নাম ‘সাররাযি’৷ সাত বছর একটানা সাধনায় বহু বিস্ময় রহ্যের সাক্ষাত্ পান৷ কিন্তু কোনো কিছুতে তার মন মজেনি৷ আল্লাহর পরম সত্তার পরিচয় মারেফত লাভ করাই তার জীবনের লক্ষ্য৷ লক্ষ্য অর্জনের সাধনায় ত্যক্তবিরক্ত হয়ে একদিন চলে গেলেন পাহাড়ের চূড়ায়৷ বললেন, সাক্ষাত্ দাও, নচেত লাফ দিয়ে প্রাণ দেব নিচের খাদে৷ গায়েবি আওয়াজ হলো, আমাকে দেখার যোগ্যতা তোমার হয়নি৷ আর যদি লাফ দাও, প্রাণে মরবে না, বলছি৷
সাররাযি নিজেকে ছেড়ে দিলেন পাহাড় চূড়া থেকে নিচের দিকে৷ গড়িয়ে পড়লেন পানির এক গভীর খাদে৷ মরলেন না বটে; মরতে না পারার আফসোস তার পিছু নিল৷ এ গড়িয়ে পড়া নিজের ব্যক্তিত্ব আমিত্ব পদমর্যাদা তুচ্ছজ্ঞান করে বাইরের খোলস ছুড়ে ফেলার প্রতীক৷ সাররাযি আমিত্ব বিসর্জন দিয়ে নতুন জীবন উপলব্ধির বেলাভূমিতে অজোরে কাঁদতে লাগলেন৷ জীবন-মরণ এখন তার কাছে একাকার৷ বেঁচে আছেন; তবে মৃত্যুর সঙ্গে অকথিত গভীর সখ্য নিয়ে৷ হজরত আলীর জীবনে যেমন তরবরি-খঞ্জর আর ফুলের পসরার মাঝে ফারাক ছিল না, সাররাযির নতুন জীবনেও জীবন-মরণ এক সমান, যেন মরার জন্যই জীবন৷ কান্নায় হা-হুতাশে তার দিন চলে যায়৷ জানে না জীবন-মরণের হকিকত কোথায়? মরু বিয়াবানে তার কাছে গায়েবি আওয়াজ আসে, যাও ভবঘুরে জীবন ছেড়ে শহুরে জীবনে ফিরে৷ সাররাযি জানতে চায়, শহরে লোকালয়ে গিয়ে আমি কী করব, কোথায়?
নির্দেশ এলো, সেখানে গিয়ে নিজের আমিত্বকে ধুলায় মেশাতে ভিক্ষার পেশা বেছে নাও৷ কিছুদিন ধনীদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা নাও, আর তা ফকির মিসকিনদের মাঝে বিলাও৷ জানতে চাইলেন, এ পেশায় থাকতে হবে কতদিন? প্রশ্নোত্তরের সূত্রে নুরের বিচ্ছুরণে আলোকিত হলো সাররাযির দিলের জমিন৷ ঘরের জানালা যদি খুলে যায়, বাতাস, আলো, বৃষ্টির ঝাপ্টা, জ্যোত্স্নার হাসি ঘরের ভেতরে আসা-যাওয়ায় বাধা নেই৷ বুজুর্গের মনের বাড়ির অবস্থাও ঠিক তাই৷
গায়েবি নির্দেশে বুজুর্গ ফিরে আসে মরু বিয়াবান ছেড়ে লোকালয়ে৷ সর্বস্তরের বিপুল জনতা জড়ো হয় তাকে স্বাগত জানাতে৷ ধনিরা সুরম্য বাড়ি নির্মাণ করে দেয় হুজুরের জন্য৷ হুজুর বললেন, আপনারা আমার জন্য এসব করছেন, আমি তো এসবের জন্য এখানে আসিনি৷ আমি এসেছি আপনাদের দুয়ারে ভিক্ষা করার জন্য৷ ভিখারি সেজে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে যাব, তারপর জনকল্যাণে গরিবদের মাঝে বিলাব৷ সিদ্ধান্ত নিলেন, কোথাও আমার বুজুর্গি প্রকাশ পায় মতো কথাবার্তা বলব না৷ কারণ ওসব কথাও এক ধরনের অহংকার৷ অহংকারকে পদদলিত করতেই আমি পাহাড়-জঙ্গল ছেড়ে লোকালয়ে এসেছি৷ আল্লাহ যেখানে চান, আমি তুচ্ছ নিঃস্ব হয়ে থাকি; সেখানে আমি কি সর্দারি খুঁজে বেড়াতে পারি৷
যেই কথা সেই কাজ৷ সাররাযি ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে নিয়ে ঘোরেন, এ বাড়ি থেকে ও বাড়িতে যান৷ মানুষের কথার খোঁচা হজম করেন মনের উদারতায়৷ দুনিয়ায় নবী-রাসুলরাও এ পেশায় নিয়োজিত ছিলেন৷ তাই তারা মানুষের কাছে গিয়ে বলেছেন-
আকরেযুল্লাহ আকরেযুল্লাহ মী যানান্দ
বাযগুন বর উনসুরুল্লাহ মী তানান্দ
কর্জ দাও আল্লাহকে কর্জে হাসানা, ডাক দিয়ে যান
উল্টো, আল্লাহকে সাহায্য কর, এ আহ্বান জানান৷
আল্লাহ তো সবকিছুর ঊর্ধ্বে৷ তিনি বেনিয়াজ কারও মুখাপেক্ষী নন৷ সব সম্পদের একচ্ছত্র তিনিই মালিক৷ এরপরও আল্লাহর পক্ষ থেকে নবীজি আহ্বান জানান, তোমরা আল্লাহকে কর্জ দাও৷ ‘কে আছে যে আল্লাহকে উত্তম ঋণ দেবে? তাহলে তিনি তা বহুগুণে বৃদ্ধি করে দেবেন তার জন্য এবং তার জন্য সম্মানজনক পুরস্কার রয়েছে৷’ (সূরা হাদিদ : ১১)৷
কোাে কিছুর চাহিদা আল্লাহপাকের নেই৷ এরপরও তিনি নামাজের জন্য তাগাদা দেন৷ অভাবীদের জন্য জাকাত চান; অথচ নিজে চাইলে দিতে পারেন সাত রাজার ধন৷ হেকমত কী? তিনি বান্দার জন্য জাকাত প্রার্থনা করেন৷ তার হয়ে নবীরা দারিদ্র্য বিমোচনে কর্জুল হাসানা দানের ডাক দিয়ে গেছেন৷ তাদের সবসময়কার আহ্বান- ‘অতএব নামাজ কায়েম কর, জাকাত দাও এবং আল্লাহকে দাও উত্তম ঋণ৷’ (সূরা মুযযাম্মিল : আয়তাংশ-২০)৷
‘হে মোমিনরা! যদি তোমরা আল্লাহ েসাহায্য কর, আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করবেন এবং তোমাদের অবস্থানকে সুদৃঢ় করবেন৷’ (সূরা মুহাম্মদ : ৭)৷
সব শক্তির মালিক আল্লাহ েসাহায্য করার আহ্বানে কী রহস্য নিহিত?
শেখ সাররাযি মানুষের দুয়ারে দুয়ারে সাহায্য চেয়ে বেড়ান; অথচ আসমান থেকে সাহায্য চাওয়ার ও সাহায্য আসার শত দুয়ার তার সম্মুখে উন্মুক্ত৷ তার এ ভিক্ষাবৃত্তি, সাহায্য প্রার্থনা আল্লাহর জন্য, নিজের জন্য মোটেও নয়৷ আল্লাহর দ্বীনের উদ্দেশ্য ছাড়া তার সামনে দুনিয়াবি কোনো মকসুদ নেই৷ তার কথা ও কাজ সাক্ষ্য দেয়-
শেখ গোফতা খালেকা মন আশেকাম
গর বজুয়াম গাইরে তো মন ফাসেকাম
শেখ বলেন, প্রভু হে আমি তোমার আশেক
তুমি ছাড়া আর কাউকে চাইলে আমি ফাসেক৷
আমি ইবাদত করি না আট বেহেশত লাভের আশায়; কিংবা সাত দোজখের ভয় ও শঙ্কায়৷ আমি এমন মোমিন, যে চূড়ান্ত পরিণতির আশায় বাঁচে, দিন গুনে, শুধু তোমার সন্তুষ্টি চায়৷ বেহেশতের আশা, দোজখের শঙ্কা তো দৈহিক সুখের চাহিদা, ভোগের দাবি৷
আশেকী কায ইশকে ইয়াযদান খোর্দ কুত
সদ বদন পীশাশ নায়ার্যদ তাররা তুত
যে প্রেমিক করে নিত্য আল্লাহর প্রেমের আহার
তার সামনে দাম নাই দেহের শত চাহিদার৷
মজনু লাইলার জন্য পাগলপারা৷ তাই দুনিয়ার রাজত্ব তার সামনে তুচ্ছ মূল্যহারা৷ মজনুর সামনে স্বর্ণ ও মাটি এক সমান৷ তার কাছে নিজের জানেরও কোনো মূল্য নেই৷ তার এ অবস্থা বনের বাঘ-ভল্লুকও জানে৷ এজন্য বন্যপশুরা আত্মীয়ের মতো জট পাকায় তাকে ঘিরে৷ কারণ সে পশুত্বের স্বভাব থেকে মুক্ত হয়েছে৷ তার অস্থি মাংসে প্রেম আর প্রেম একাকার হয়ে আছে৷
বন্দেগী কুন তা শওয়ী আশেক লাআল
বন্দেগী কসবীস্ত আয়দ দর আমল
বন্দেগি কর যাতে হতে পার নিখাদ প্রেমিক
বন্দেগি ও আমলের সূত্রে হবে প্রেমের পথিক৷
বন্দেগি কর আল্লাহর, যাতে তুমিও হতে পার খাঁটি আশেক তাঁর৷ বন্দেগি এক ধরনের আয়-উপার্জন৷ আমলের মাধ্যমে, আল্লাহর হুকুম-আহকাম বাস্তবে পালনের মাধ্যমে এ উপার্জন হাতে আসে৷ চেষ্টা-সাধনার বলে এ যোগ্যতা অর্জিত হয়৷ ধীরে ধীরে তা আল্লাহর প্রেমে পরিণত হয়৷ এখানে পার্থক্য হলো, আবেদ বান্দা, যে নিছক আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি করে, তার সামনে থাকে বেহেশতের আশা, দোজখের ভয়৷ কিন্তু আশেক বান্দা এসবের পরওয়া করে না৷ সে ইবাদত করে আল্লাহকে পাওয়ার, আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায়৷ আবেদ বান্দা সবসময় আল্লাহর কাছ থেকে রহমত চায়, পুরস্কার পেতে আগ্রহী, না পেলে মন খারাপ হয়ে যায়; কিন্তু আশেক শুধু আল্লাহর দিদার ও সাক্ষাত্ লাভের আশায় অধীর৷
দর নগুঞ্জদ এশক দর গোফত ও শনীদ
ইশক দরইয়ায়ীস্ত কা’রাশ না পদীদ
প্রেম সে আ েনা মানুষের কথাবার্তার আওতায়
প্রেম এমন সাগর, যার কোনো কূলকিনারা নাই৷
প্রেম সাগরকে উত্তপ্ত করে ডেকচিতে পানি ফোটার মতো৷ প্রেম বালুর মতো ধুলায় মিশিয়ে দেওয়া সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গ৷ প্রেম চৌচির করে ঊর্ধ্ব আকাশ৷ প্রেম প্রচণ্ড কম্পনে পৃথিবী করে ছারখার৷ সৃষ্টিজগতের সবকিছুতে পরিব্যাপ্ত প্রেমের উপাদান৷ বাতাসে ইথার ভাসে৷ সেই ইথারে ভেসে ভেসে রেডিও-টিভিতে খবর আসে, ছবি হাসে৷ হাতে হাতে মোবাইল নীরব হয়ে যায় যদি ইথারের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়৷ অনুরূপ সৃষ্টির সর্বত্র বিরাজমান প্রেমের শক্তি৷ সে প্রেমের সংযোগ যে পেয়েছে তার জীবন ধন্য, প্রকৃত জীবনের অধিকারী সে হতে পেরেছে৷ যে সংযোগ পায়নি, তার জীবন পশুত্বের স্তরে ঘুরপাক খায়৷
নবী মুস্তফা (সা.) একাকার ছিলেন পবিত্র প্রেমে৷ এ কারণে আল্লাহ বলেছেন-‘হাবীব! আপনাকে প্রেরণের উদ্দেশ্য না হলে এ সৃষ্টিজগতের কিছুই আমি সৃষ্টি করতাম না৷’
তুমি সাধনা কর, যা েZোমার মনের গৃহে এ প্রেমের সংযোগ লাভ করতে পার৷ আমি আসমানকে সমুন্নত করেছি, যাতে প্রেমের মহিমা তুমি অনুধাবন কর৷ জমিনকে অবনত করে রেখেছি, যাতে বুঝতে পার, যে লোক প্রেমিক সে নিজেকে পরম প্রেমাষ্পদ আল্লাহর সামনে বিনীত সমর্পিত মাটির সঙ্গে মিশিয়ে রাখে৷ সেই উপলব্ধিতেই বান্দা সিজদায় লুটিয়ে পড়ে৷ মাটিকে আমি সাজিয়েছি উদ্ভিদ তরুলতায়, যাতে আল্লাহর পথের ফকিরদের মাহাত্ম্য সহজে অনুধাবন করা যায়৷ বিশালকায় পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে দেখ৷ তোমাকে বলে দেবে, প্রেমিকরা এভাবেই অনড় অবিচল শির উন্নত সব অবস্থায়৷ ‘আগর কুহ টল্লত ন টল্লত ফকির৷’ পাহাড় টল েপারে ফকির টলে না৷ কোনো অবস্থাতেই সত্যের পথ থেকে বিচ্যুত হয় না৷ (মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, ৫খ. বয়েত-২৬০০-২৮৮৬)৷