শনিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:৫৩ পূর্বাহ্ন

আগস্টের আগে পুরোপুরি নামবে না বন্যার পানি

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : বুধবার, ২২ জুলাই, ২০২০
  • ২০৯ বার

টানা ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে দেশের নদনদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে বেশিরভাগ জেলায় তৃতীয় দফার বন্যার আরও অবনতি হয়েছে। ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকতে পারে আরও তিন দিন। সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, তৃতীয় দফার এ বন্যা আরও ১০-১৫ দিন স্থায়ী হতে পারে। আগামী আগস্টের প্রথম সপ্তাহের আগে বন্যার পানি পুরোপুরি নেমে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, সারাদেশে মৌসুমি বায়ু সক্রিয় রয়েছে। বঙ্গোপসাগরের উত্তরাংশে প্রবল সক্রিয় অবস্থায় রয়েছে। এ কারণে দেশের প্রায় সব জায়গাতেই ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। আরও তিন দিন থাকতে পারে ভারী বর্ষণ। মঙ্গলবার সকালে আবহাওয়া অধিদপ্তরের ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, রংপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, সিলেট, ঢাকা, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের বেশিরভাগ জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টি হতে পারে।

গত ২৭ জুন থেকে ৭ জুলাই পর্যন্ত ছিল বন্যার প্রথম দফা। এর পর ধীরে ধীরে পানি কিছুটা কমতে থাকে। তবে ১১ থেকে ১৫ জুলাই পর্যন্ত আরেক দফা ঢলের কারণে বন্যার পানি বেড়ে যায়। এর পর চার দিন ধরে পানি কমছিল। কিন্তু সোমবার থেকে তৃতীয় দফায় আবারও পানি বাড়তে শুরু করে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া জানান, তৃতীয় দফার বন্যা পরিস্থিতি আগের চেয়ে মারাত্মক হতে পারে। উজানের ঢলের সঙ্গে দেশে ভারী বৃষ্টিও হচ্ছে। সব মিলিয়ে এ দফায় ২০ থেকে ২৫টি জেলা বন্যাকবলিত হতে পারে।

জামালপুরে তিন দফা বন্যায় দীর্ঘ ২৫ দিন দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন জেলার প্রায় ১০ লাখ মানুষ। খাদ্য সংকটে রয়েছে লাখো দিনমজুর ও নিম্নআয়ের পরিবার। রোজগার বন্ধ থাকায় খাদ্য সংকটে থাকলেও প্রয়োজনীয় সরকারি ত্রাণ সহায়তা পাচ্ছেন না তারা।

জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবু সাঈদ জানিয়েছেন, ২৮ জুলাই পর্যন্ত যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। এতে জামালপুরের বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হবে। তৃতীয় দফার বন্যা গত বছরের মতো ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে মনে করছেন তিনি।

সুনামগঞ্জে মাত্র ২০ দিনের ব্যবধানে দুই দফা বন্যার কারণে দুর্ভোগে পড়েছেন পানিবন্দি অনেক মানুষ। সড়ক দিয়ে পানি উপচেপড়ায় সুনামগঞ্জ-ছাতক, সুনামগঞ্জ-জামালগঞ্জ, সুনামগঞ্জ-বিশ্বম্ভরপুর ও তাহিরপুর সড়কে সরাসরি যান চলাচল বন্ধ রয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের সুনামগঞ্জ কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সবিবুর রহমান জানান, কয়েকদিন ধরে সুনামগঞ্জ ও ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। ভারতে আরও দুই দিন ভারী ও অতিভারী বৃষ্টিপাত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ কারণে সুনামগঞ্জ অঞ্চলে নদীর পানি বৃদ্ধি হয়ে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।

এদিকে কুড়িগ্রামে বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। তবে এখনো দুর্ভোগ পোহাচ্ছে দুই লক্ষাধিক বানভাসি মানুষ। সরকারি-বেসরকারিভাবে ত্রাণ বিতরণ করা হলেও তা দীর্ঘদিন ধরে বানের পানিতে ভেসে থাকা মানুষদের তুলনায় অপ্রতুল। মানুষ ত্রাণের দিকে ছুটলেও সবার ভাগ্যে ত্রাণ জুটছে না। রাজারহাট উপজেলার বুড়িরহাটে তিস্তার ভাঙন অব্যাহত রয়েছে।

সিরাজগঞ্জে যমুনার পানি ধীর গতিতে কমলেও কমছে না নদীপারের অসহায় বন্যার্ত মানুষের আতঙ্ক। বসতবাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় বানভাসি মানুষেরা বিভিন্ন ওয়াবদা বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। এসব বাঁধে শৌচাগার ও টিউবওয়েল না থাকায় বিপাকে পড়েছেন তারা। বন্যায় জেলার কাজিপুর, সিরাজগঞ্জ সদর, বেলকুচি, চৌহালী ও শাহজাদপুর উপজেলা প্রায় ২ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

প্রথম ধাপের রেশ কাটতে না কাটতে দ্বিতীয় দফা বন্যায় টাঙ্গাইল সদরে নতুন নতুন গ্রাম প্লাবিত হয়ে হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সরকারি বা বেসরকারি কোনো ত্রাণ না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে এসব বানভাসি মানুষের। পানির তোড়ে ভেঙে যাচ্ছে স্থায়ী নদী প্রতিরক্ষা বাঁধসহ একের পর এক কাঁচা-পাকা রাস্তা ও ব্রিজ। এতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে বিভিন্ন জনপদ। বন্যাদুর্গত এলাকাগুলোতে দেখা দিয়েছে গোখাদ্য, বিশুদ্ধ পানি আর শুকনা খাবার সংকট।

মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই পানি আর পানি। বানের পানিতে ভাসছে উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা। দিন দিন লৌহজংয়ের বন্যার পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের ৪৬টি গ্রামে পানি প্রবেশ করেছে। এতে হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছে। একই সঙ্গে প্রমত্তা পদ্মার ভাঙনে উপজেলার মানচিত্র পাল্টে যেতে বসেছে।

শেরপুরে ব্রহ্মপুত্র নদের পানির বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নদীর ভাঙন দেখা দিয়েছে। অন্তত ছয়টি স্পটে নদীভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। এর মধ্যে নকলার নারায়ণখোলায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি ভবন নদী গর্ভে চলে গেছে। এ ছাড়া চন্দ্রকোনা, নামাপাড়া, শেরপুরের শেরীরচর, তালুকপাড়ায় নদীভাঙনে একটি কাঁচা সড়ক, বাড়িঘর, আবাদি জমি বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

গত তিন দিনের ভারী বর্ষণ আর উজানের পাহাড়ি ঢলে তিস্তার পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মঙ্গলবার বিকাল ৩টায় তিস্তার পানি নীলফামারীর ডালিয়া তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে বিপদসীমার ৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ফলে তিস্তাসংলগ্ন নিম্নাঞ্চল প্ল­াবিত হয়ে পড়েছে। ক্রমাগত পানি বৃদ্ধির কারণে এরই মধ্যে চরম আতঙ্ক দেখা দিয়েছে তিস্তাপারের মানুষের মধ্যে।

পানির গতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুলে রাখা হয়েছে। তিস্তার পানি বৃদ্ধির ফলে তিস্তা অববাহিকার ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার বিভিন্ন চর এবং নিম্নাঞ্চল পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে।

কুড়িগ্রামের রাজারহাটে বেশ কয়েক দিন ধরে প্রচ- বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে পানি বৃদ্ধি পেয়ে তিস্তা নদীতে প্রবল ¯্রােতের সৃষ্টি হয়। কয়েকদিন ধরেই রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙ্গা বিদ্যানন্দ ও নাজিমখান ইউনিয়নের নদীতে ভাঙন দেখা দেয়। এরই মধ্যে গত ২০ জুলাই সন্ধ্যায় ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়নের বুড়িরহাট এলাকায় ক্রসবাঁধটিতে ধস সৃষ্টি হয়। প্রায় আধাঘণ্টার মধ্যে পুরো বাঁধটি বিলীন হয়ে যায়। একই সময়ে বিদ্যানন্দ গাবুর হেলান ক্রসবাঁধটিও বিলীন হয়ে যায়। ক্রস বাঁধ দুটি বিলীন হয়ে যাওয়ায় নদীর তীরবর্তী মানুষ ভাঙন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে।

এদিকে অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে সিলেটের কানাইঘাট বাজারে বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। ফের লোভা ও সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় পৌরসভাসহ উপজেলার নিম্নাঞ্চলগুলো আবারও বানের প্লাবিত হয়েছে। এতে অনেক মৎস্য খামার, আমন ধানের বীজতলা পুরোপুরি পানির নিচে তলিয়ে গেছে।

উজানের ঢল ও অতিবৃষ্টির কারণে কালনী, কুশিয়ারাসহ বিভিন্ন নদনদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। ইতোমধ্যে হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে নিচু এলাকার বাড়িঘর তলিয়ে গেছে। বন্যার পানি বৃদ্ধির কারণে বানিয়াচংয়ের সঙ্গে হবিগঞ্জসহ সারাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন জামালপুর থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক আতিকুল ইসলাম রুকন, কুড়িগ্রাম থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক মোল্লা হারুন উর রশীদ, সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি বিন্দু তালুকদার, সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি আমিনুল ইসলাম, টাঙ্গাইল সদর প্রতিনিধি মো. আবু জুবায়ের উজ্জল, শেরপুর প্রতিনিধি সাবিহা জামান শাপলা, মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি নাদিম হোসাইন, নীলফামারী প্রতিনিধি রেজাউল করিম রঞ্জু, রাজারহাট (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি প্রহলাদ ম-ল সৈকত, বানিয়াচং (হবিগঞ্জ) প্রতিনিধি মোতাব্বির হোসেন।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com