করোনার ব্যাপক সংক্রমণে দেশের মানুষের জীবন-জীবিকা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। মৃত্যুর মিছিলে যোগ হচ্ছে প্রতিদিন প্রায় অর্ধশত মানুষ। আক্রান্তের হারের কোনো কমতি নেই। এমন নাকাল পরিস্থিতির মধ্যে মাস দুয়েক আগে ঘূর্ণিঝড় আম্পান লণ্ডভভন্ড করে দেয় দক্ষিণাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা, যার রেশ এখনো কাটেনি। এ দুই বিপদ সামাল দেওয়ার চেষ্টার মধ্যেই বন্যা ভাসিয়ে নিয়েছে দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে বুধবার রেডক্রস শুনিয়েছে আরও বড় বিপদের খবর। এক বিবৃতিতে তারা জানিয়েছে, করোনার কারণে অর্থনৈতিকভাবে বিপদে থাকা মানুষের বড় একটি অংশ দীর্ঘস্থায়ী বন্যার কবলে পড়তে যাচ্ছে। এতে গ্রামীণ জনপদে দারিদ্র্য আরও বেড়ে খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে। এই তিনটি দুর্যোগ মোকাবিলা করে অর্থনীতির চাকা সচল করতে সময়ও লাগবে অনেক। করোনার আঘাতে অনেক মানুষ বেকার হয়ে পড়েছেন। স্থবির হয়ে পড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প খাত। প্রতিষ্ঠানের খরচ কমাতে গিয়ে তারা শ্রমিক ছাঁটাই ও বেতন কমিয়েছেন। এ অস্বাভাবিক সময় কবে পার হবে তা এখনো বলা যাচ্ছে না। কারণ বিশ্বব্যাপী প্রাণঘাতী করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ঊর্ধ্বমুখী। দ্বিতীয়বার সংক্রমণও শুরু হয়েছে অনেক দেশে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, করোনায় ব্যাপক বিস্তার ও ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর শীর্ষ তালিকায় বাংলাদেশও আছে।
সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস বলছে, করোনা মহামারীর আঘাতে অন্তত এক কোটি ৬০ লাখ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ব্র্যাক ও পিপিআরসি বলছে, আগে দেশের ২০ শতাংশ মানুষ দরিদ্র ছিল। এখন সেটি আরও ৫ শতাংশ বেড়ে ২৫ শতাংশে উঠেছে। সামনের দিনে এ সংখ্যা আরও বাড়বে বলে মনে করে সংস্থা দুুটি। ফলে করোনাপরবর্তী মানুষের কাজের সুযোগ বাড়াতে হবে। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষকে কাজ দিতে না পারলে দারিদ্র্যসীমার ভয়াবহতার দিকে এগিয়ে যাবে। এতে সব ধরনের উন্নয়ন কার্যক্রমই বাধাগ্রস্ত হবে।
করোনা মহামারীর মধ্যেই ঘূর্ণিঝড় আম্পানে উপকূলবাসীর কষ্টের সীমা আরও বাড়িয়ে দিয়ে গেছে। ঘরবাড়ি গাছপালার সঙ্গে অনেকে হারিয়েছেন বেঁচে থাকার শেষ আশ্রয়টুকুও। আম্পানের আঘাতে উপকূলবাসীসহ দেশের অন্তত ১৬ জেলার মানুষ আম ও লিচুর বড় আয় থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। ক্ষতি হয়েছে কলা, পানের বরজসহ নানা ফসল। এ ক্ষতির ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই বন্যা দেশের বিস্তীর্ণ জনপদের মানুষের জীবনকে পানিবন্দি করে ফেলেছে। এ অবস্থায় এখন বন্যাকবলিত জেলাবাসীর টিকে থাকার লড়াইকে আরও কঠিন করে তুলেছে।
এদিকে কোভিড ১৯-এর প্রভাবে অচল হয়ে পড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প খাত। বিপুল পরিমাণ মানুষ লোকসান গুনছেন উদ্যোক্তারা। ফলে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখতে খরচ কমানোর পথে হাঁটছেন অনেকেই। ফলে চাকরি হারাচ্ছেন অনেকেই। আবার রোজগার কমে যাওয়ায় যেমন বিপাকে পড়েছেন মানুষ, তেমন চাকরি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী। অনেকেই নিয়মিত বাসাভাড়াও পরিশোধ করতে পারছেন না। ইতোমধ্যে বিপুলসংখ্যক বাসা খালি হয়ে গেছে। কেউ কেউ বাসাবদলে অপেক্ষাকৃত কম খরচের বাসায় যাচ্ছেন। অনেকে ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে যাচ্ছেন। বাড়িভাড়ার ওপর নির্ভরশীল অনেক বাড়ির মালিকও পড়েছেন বিপাকে।
করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত অনেক পরিবারের যারা গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন, তাদের সঙ্গে আমাদের সময়ের কথা হয়। তাদের একজন গাজীপুরে একটি পোশাক কারখানার শ্রমিক সিরাজগঞ্জের জাকিরুল। তিন হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে সপরিবারে থাকতেন। করোনার কারণে কাজ হারিয়ে তিনি গ্রামে চলে গেছেন। তিনি বলেন, ‘ঘরভাড়া দিতে না পেরে বাড়ি থেকে টাকা এনে রুমভাড়া শোধ করেছি। খাওয়াদাওয়া সমস্যা। কিন্তু বাড়ি এসে আরেক বিপাকে পড়েছি। এখানে কোনো কাজ নেই, বন্যায় আটকে আছি। আবার কাজের সুযোগ পেলে ঢাকায় ফিরে আসব বলেও জানান।
উত্তরায় পরিবার নিয়ে থাকেন মাসুমা শিল্পী। তিনি রিয়েল এস্টেট কোম্পানিতে চাকরি করতেন। গত তিন মাস ধরে বেতন পান না। এ তিন মাস বাড়িভাড়া দিতে পারেননি। বাড়িওয়ালা নোটিশ দিয়েছেন টাকা দিয়ে বাড়ি ছেড়ে দিতে। এখন পরিবার নিরুপায়।
মুন্সীগঞ্জের বাসিন্দা শাহ আলম। আগে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। করোনার আগে ও পরে তার ২৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা আয় ছিল। কিন্তু করোনায় সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর বদলে গেছে জীবন। বন্ধের সময় বেতন পাননি। ফলে তিন মাসের ঘরভাড়াও দিতে পারেননি। পরিবার বাড়িতে রেখে ঢাকায় পান বিক্রি করছেন। এদের মতো লাখ লাখ মানুষ আজ দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোভিড ১৯-এর প্রকোপে গত কয়েক মাসে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। স্বাস্থ্যবিধি মানতে গিয়েও বেড়েছে খরচও। অথচ আয় বাড়েনি। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিপিআরসির হিসেবে করোনা মহামারীর কারণে ৭০ শতাংশ মানুষের আয় কমে গেছে। দারিদ্র্যের হার অন্তত ৫ শতাংশ বেড়েছে বলে ধারণা করছে পিপিআরসি।
করোনার প্রভাবে কাজ হারানোর পর এখন বাসস্থানও হারানো শুরু করেছেন মানুষ। অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের হাত ধরে মানবিক বিপর্যয় নিয়ে এসেছে করোনা। অনিশ্চিত জীবন নিয়ে ঢাকা ছেড়েছেন বহুজন। ভাড়ার আয় বন্ধ হওয়ায় বিপাকে আছেন অনেক বাড়িওয়ালা। তবে এ বিপদ শুধু ভাড়াটিয়া আর বাড়ির মালিকেরই নয়, গোটা অর্থনীতির।
অন্যদিকে বন্যা আর অনবরত নদীভাঙনের কারণে দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের চরের মানুষগুলো এখন এক মহাবিপদাপন্নতার মধ্যে পতিত হয়েছেন। লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, জামালপুর জেলার বেশিরভাগ চরাঞ্চলই এখন বন্যায় প্লাবিত। রাজবাড়ী, ফরিদপুর, মানিকগঞ্জের অনেক চরেও অথৈ পানি। বন্যার পানির কারণে বসতির সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার একর হেক্টর ক্ষেত পানির নিচে চলে গেছে। অনেকের ঘরবাড়ি চিরতরে বিলীন হয়ে গেছে নদীতে। করোনাকালে এই সীমাহীন দুর্ভোগ চরের মানুষের ওপর যেন একেবারেই ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।’
এমনিতে করোনায় চরাঞ্চলে কর্মসংস্থান এবং আয়ের উৎস কমে আসায় প্রায় প্রতিটি পরিবারকেই নতুন বিপদের মুখে পড়তে হয়। এর পর আবার বন্যা। এ যেন নিয়তির এক নির্মম পরিহাস। বন্যার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মাঝে যে ক্ষতি ও ক্ষত তৈরি হলো তা কীভাবে কাটিয়ে উঠবেÑ এই প্রশ্ন এখন বড় আকারে দেখা দিয়েছে। কেননা হাজার হাজার চরবাসী নিজ বসতি ও কষ্টের বাড়িঘর সব হারিয়ে ফেলেছেন। আয় উপার্জনের অন্যতম উৎস ফসলের মাঠ হারিয়েছেন। কষ্ট করে যে সম্পদ গড়ে তুলছিলেন, সেটি হয় নষ্ট হয়ে গেছে অথবা পানিতে ভেসে গেছে। পানি সরে যাওয়ার পর পরই তাই চরের মানুষের জীবন ও জীবিকা রক্ষায় যে বিষয় জরুরি ভিত্তিতে করা প্রয়োজন, সেগুলো হলোÑ ঘরে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে চরের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সঠিক তালিকা করে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করা। চরে বীজ ও সারের সরবরাহ কম। এ কারণে চরাঞ্চলে বীজ ও সারের সরবরাহ সুনিশ্চিত করা। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি পরিবারকে ক্যাশ ইনসেনটিভ দেওয়া হবে। এ দুরবস্থায় তারা ঘরবাড়ি পুনর্নির্মাণের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করতে পারে। চরের বাজারব্যবস্থা সচল করা। দুর্গম চরে উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের ফসল ও দুধ বর্তমানে বিক্রির জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে সঠিক উদ্যোগ গ্রহণ করা। বন্যার পর পরই চরে এই বিভিন্ন অবকাঠামোর উন্নয়ন শুরু জরুরি। এটি করা হলে যারা শহরে কাজ করতে যেতে পারছেন না, তারা কিছুটা হলেও কাজ করার সুযোগ পাবেন এবং আর্থিকভাবে লাভবান হবেন। চরে উৎপাদিত ফসল-সবজি সেনাবাহিনী, পুলিশ, সরকারি হাসপাতাল, আনসারদের কিনতে স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগী হওয়া।
চরের জীবন ও জীবিকাকে চলমান রাখতে হলে মানুষকে শুধু সাহায্য নয়, তাদের কর্মের জায়গাও অবশ্যই সচল রাখতে হবে। সেটি করতে না পারলে চরাঞ্চলে কেবলই হাহাকার বাড়বে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেশ আগে ঘোষণা দিয়েছিলেন চরের মানুষের জন্য একটি বিশেষ তহবিল গঠনের। আজ পর্যন্ত সেই তহবিল গঠন করা হয়নি। চরের মানুষের জীবন-জীবিকার সুরক্ষায় সেই তহবিল গঠনও এখন জরুরি এজেন্ডা হওয়া উচিত।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, মানুষ বহুমাত্রিক সংকটের মধ্যে রয়েছে। সবচেয়ে বড় সংকট হলোÑ জীবন ও জীবিকার। যারা কর্ম হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছেন, আর কর্ম হারিয়েছেন, তারা আবার নতুন করে দরিদ্র্যের খাতায় নাম লেখাচ্ছেন। ফলে সামনের দিকে দারিদ্র্যের হার বেড়ে যাবে। এটি থেকে বের হতে অনেক সময়ের প্রয়োজন।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর আমাদের সময়কে বলেন, করোনার কারণে জনজীবনের হিসাব উল্টাপাল্টা হয়ে গেছে। এখন বেঁচে থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে অনেকেই জীবিকা হারিয়েছেন। তারা গ্রামে ফিরে গেছেন। কিন্তু বন্যার কারণে গ্রামেও কাজ নেই। ফলে বিরাট সংকট তৈরি হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আবার যারা ঢাকায় আছেন, তাদের বাড়িভাড়া নিয়ে বিপাকে পড়তে হচ্ছে। অনেকের বেতন নেই। আবার অনেকেই বেতন কম পাচ্ছেন। ফলে তাদের টিকে থাকাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ জন্য বাড়িভাড়া অর্ধেক করে নীতিমালা করে দেওয়া উচিত। অন্যদিকে বড় ধরনের বন্যার কারণে আউস নষ্ট হয়ে গেছে। লাখ লাখ মানুষের বাড়িঘর বানের পানিতে তলিয়ে গেছে। রাস্তাঘাট ভেঙে গেছে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। অনেক জায়গায় পাট নষ্ট হয়েছে। এসব বিষয়ে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।