করোনা মহামারীতে বিপর্যস্ত দেশের মানুষ। এর মধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা দিয়েছে বন্যা। বন্যাদুর্গত এলাকার মানুষ যখন আবাসন ও খাদ্য সংকটে দিশেহারা, তখন তার সাথে যোগ হয়েছে নানা রোগব্যাধি। এর সঙ্গে আছে পানিতে ডোবা, সাপের দংশন ও বজ্রপাতের ভয়। বন্যাদুর্গত ২৩ জেলায় গত দুই মাসে মারা গেছেন ১২২ জন এবং আক্রান্ত হয়েছে ১২ হাজারের বেশি মানুষ।
জানা গেছে, চলতি মৌসুমে বন্যা শুরু হয়েছে গত ২৬ জুন থেকে। প্রথম পর্যায়ে ১০টি জেলায় বন্যা দেখা দেয়। বর্তমানে ৩১টি জেলার নিম্মাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এসব অঞ্চলের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ফলে সেসব এলাকার লাখো মানুষ ক্ষুধা ও রোগব্যাধি নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। বন্যাকবলিত এলাকায় মানুষের বিশুদ্ধ পানি, খাবার, ওষুধ ও চিকিৎসাসেবা পেতে সমস্যা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ডা. আয়শা আক্তার বলেন, বর্তমানে দেশের ৩১ জেলার ২১২ উপজেলার মধ্যে ৮১টি উপজেলা বন্যাকবলিত। বন্যাপীড়িত মানুষের আশ্রয় প্রদানে ৫০২টি আশ্রয়কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। এ ছাড়া বন্যাদুর্গত মানুষের চিকিৎসার জন্য দুই হাজার ৫৮টি মেডিক্যাল টিম কাজ করছে। বন্যাদুর্গত এলাকায় আমাদের ওরস্যালাইন, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেটসহ বিভিন্ন ধরনের পর্যাপ্ত ওষুধ রয়েছে। আমাদের মেডিক্যাল টিম আশ্রয়কেন্দ্রসহ বিভিন্ন এলাকায় চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। আমরা চিকিৎসার বিষয়টি নজরদারি করছি। কোথাও কোনো সমস্যার খবর পেলে সেটি দ্রুত সমাধান করা হচ্ছে।
জানা গেছে, বন্যাদুর্গত এলাকার পানিবন্দি সব মানুষ চিকিৎসা সুবিধা পাচ্ছেন না, নেই বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা। বিশুদ্ধ পানির অভাবে বাড়ছে ডায়রিয়া রোগী। মানুষ পানিতে থাকতে থাকতে অনেকেরই চর্মরোগ দেখা দিচ্ছে, পায়ে ঘা হয়ে যাচ্ছে। বাড়ছে শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ, চোখের প্রদাহসহ অন্যান্য পানিবাহিত রোগ। তবে পানিবাহিত রোগী মৃত্যু কম হলেও অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে পানিতে ডুবে, সাপের দংশন ও বজ্রপাতের কবলে পড়ে। বন্যাদুর্গত ৩১টি জেলার মধ্যে ২৩ জেলায় এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ১২২ জন। এর মধ্যে পানিতে ডুবে ৯৮ জন, সাপের দংশনে ১৪ জন, ব্রজপাতে ৮ জন, ডায়রিয়ায় ১ জন ও অন্যান্য রোগী ১ জন রয়েছেন।
এদিকে গত ৩০ জুন থেকে দেশের বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। বন্যাপীড়িত মানুষদের চিকিৎসাসেবা প্রদানে দুই হাজার ৫৮টি মেডিক্যাল গঠন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এসব মেডিক্যাল টিম চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় যোগাযোগব্যবস্থায় বিপর্যয়ের কারণে সবার চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত হচ্ছে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বন্যাদুর্গত ৩১ জেলার মধ্যে ২৩টিতে বিভিন্ন রোগব্যাধিতে আক্রান্তের একটি চিত্র পাওয়া গেছে। বাকি ৮ জেলায় বন্যাজনিত রোগব্যাধির প্রাদুর্ভাবের খবর পাওয়া যায়নি। বন্যাদুর্গত এলাকার মধ্যে বেশি রোগব্যাধি ছড়াচ্ছে মাদারীপুর জেলায়। এই জেলায় গতকাল সোমবার পর্যন্ত বন্যাজনিত রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছেন তিন হাজার ৭৫ জন মানুষ। এর পরই রয়েছে টাঙ্গাইল জেলায় এক হাজার ৬৬৭ জন, নেত্রকোনা জেলায় এক হাজার ৮৯ জন, সিরাজগঞ্জে এক হাজার ১২ জন। বাকি জেলায়গুলো আক্রান্তের সংখ্যা ২২ জন থেকে ৮২৬ জন পর্যন্ত।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে বন্যাদুর্গত এলাকায় ২৪ ঘণ্টায় পানি ডুবে দুইজন ও সাপের দংশনে একজনসহ মোট তিনজন মারা গেছেন। একই সময়ে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে এক হাজার ৫৬৮ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে ডায়রিয়া রোগী ৫০৫ জন, শ্বাসতন্ত্রের রোগী ২০৮ জন, চর্মরোগী ৩৬৮ জন, চোখের প্রদাহ ৩৫ জন, সাপে কাটা ১ জন, পানিতে ডুবে ৭ জন ও আঘাতপ্রাপ্ত ১৭ জন রয়েছেন।
কন্ট্রোল রুমের তথ্যমতে, গত ৩০ জুন থেকে গতকাল দুপুর পর্যন্ত বন্যাদুর্গত এলাকায় মারা গেছেন ১২২ জন। এর মধ্যে বেশি মারা গেছেন পানিতে ডুবে, ৯৮ জন। এ ছাড়া সাপের দংশনে ১৪ জন ও ব্রজপাতে ৮ জন, ডায়রিয়ায় ১ জন ও অন্য রোগে ১ জন মারা গেছেন। একই সময়ে অসুস্থ হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন ১২ হাজার ২৫১ জন। এর মধ্যে ডায়রিয়া রোগী পাঁচ হাজার ১২৬ জন, শ্বাসতন্ত্রের রোগী এক হাজার ৪৫১ জন, চর্মরোগী দুই হাজার ৯৪ জন, চোখের প্রদাহের রোগী ৩০৯ জন, আঘাতপ্রাপ্ত ৩৪০ জন, পানিতে ডুবে ১০৬ জন, বজ্রপাতের রোগী ৩৮ জন, সাপে কাটা ৩১ জন ও অন্যান্য রোগী ৪২৬ জন রয়েছেন।