শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০১:২৪ অপরাহ্ন

বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ব্যবস্থাপনায় করণীয়

এনায়েত চৌধুরী ও ড. একেএম সাইফুল ইসলাম
  • আপডেট টাইম : শনিবার, ৮ আগস্ট, ২০২০
  • ২৯১ বার

গত মে মাসে আঘাতকারী প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আম্পান-পরবর্তী ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার আগেই বাংলাদেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে দেখা দিয়েছে দীর্ঘস্থায়ী বর্ষাকালীন বন্যা। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ইতোমধ্যে দেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। দেশে স্মরণকালের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী বন্যার স্থায়িত্ব ছিল ৬৩ দিন (১৯৯৮ সাল)। ১৯৮৮ সালে টানা ১৫ দিন বন্যা দেখা দিয়েছিল।

বলা হচ্ছে, ১৯৯৮ সালের পর এবারের বন্যা সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী হতে যাচ্ছে। ভারি বৃষ্টিপাতের কবলে পড়েছে দেশের প্রধান দুটি নদী অববাহিকা- গঙ্গা-পদ্মা এবং ব্রহ্মপুত্র-যমুনা। এ অবস্থায় দেশের অর্থনীতির ওপরও বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।

বিশেষত, করোনাকালীন উপর্যুপরি দুটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ জনজীবনকে চরমভাবে ব্যাহত করেছে। আম্পান-পরবর্তী ক্ষয়ক্ষতি ও করোনার প্রাদুর্ভাব মিলিয়ে এবারের বর্ষাকালীন বন্যা বাংলাদেশের জন্য যেন এক অভিশাপ হয়ে এসেছে।

দেশের উপকূলীয় ও উত্তরাঞ্চলীয় মানুষের কাছে বন্যা নিয়ন্ত্রণমূলক কাঠামোগত সমাধান হিসেবে বাঁধ নির্মাণ বড় গুরুত্ব বহন করে। বন্যার কবলে পড়ে বাঁধগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা ওই অঞ্চলের বিপুল পরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

সরকারি হিসাবেই এবারের বন্যায় প্রায় ১ হাজার ২০০ হেক্টর জমির বীজতলা নষ্ট হয়েছে। এলাকাবাসীর মধ্যে যারা গবাদিপশু লালন-পালনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেন, তাদের কষ্টের সীমা নেই। বাঁধ ভেঙে বন্যার পানি ঢুকে অনেক ঘরবাড়ির মূল্যবান জিনিসপত্র নষ্ট হয়েছে।

বাঁধ কেন ভাঙে : বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভাঙনের কারণগুলোকে মোটা দাগে দুই ভাগে ভাগ করা যায়- প্রথমত, প্রাকৃতিক এবং দ্বিতীয়ত, মানবঘটিত। প্রথমে প্রাকৃতিক কারণগুলো নিয়ে আলোচনা করা যাক।

১. মৌসুমি বৃষ্টিপাত : বাংলাদেশে গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১ হাজার ৫০০ মিলিমিটার (দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল, খুলনা জেলা) থেকে ৩ হাজার ৭৫০ মিলিমিটারেরও (দক্ষিণাঞ্চল, কক্সবাজার জেলা) বেশি হয়ে থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে জুলাই মাসে (প্রায় ৩৫০-৮৭৫ মিলিমিটার) (সূত্র : বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতর)। আমাদের দেশের অনেক বাঁধই মাটির তৈরি। বৃষ্টিপাতের ফলে পানির সঙ্গে মাটি অনেক সময় ধুয়ে নিয়ে যায় যাকে ‘সারফেস রানঅফ’ বলে।

বন্যার সময় পরিস্থিতি আরও বেগতিক হয়ে ওঠে। তখন বাঁধের ঢাল ও চূড়া অনেকদিন পানির নিচে থাকে বলে তা মাটিকে নরম করে ফেলে; এর ফলে সহজেই ভূমিক্ষয় ঘটতে থাকে। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও ডেমরাকে ব্রহ্মপুত্র ও শীতলক্ষ্যা নদীর হাত থেকে রক্ষার জন্য নির্মিত ডিএনডি বাঁধ এবং ব্রহ্মপুত্র ডান তীর বাঁধ এরকম মাটির তৈরি।

২. নদীর স্রোতের ক্রিয়া : প্রচণ্ড গতির বাতাসের ফলে দৈনিক-পর্যায়ক্রমিকভাবে সমুদ্রে জোয়ারের ঢেউ সৃষ্টি হয়। এ ঢেউ প্রচণ্ড বলে উপকূলীয় অঞ্চলের বাঁধে আঘাত হানে। বিশেষত, আম্পানের মতো ঘূর্ণিঝড়ের বেলায় এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটতে দেখা যায়।

৩. প্রচণ্ড বেগে ছুটে চলা পানিতে সৃষ্ট ঘূর্ণি : নদীর পানিতে যখন বেগ বেশি থাকে এবং তার সঙ্গে স্থানে স্থানে পানির ‘ঘূর্ণি গতি’ বা ‘ভরটেক্স মোশান’ দেখা যায়, তখন তা আশপাশের নদী তীরে ভূমিক্ষয় ঘটায়। শাখা নদী বা খালের মুখে, বিশেষত যেখানে জলকপাট থাকে, তার আশপাশে পানির করাল স্রোতের জন্য নদী তীর ও বাঁধে ভূমিক্ষয় ঘটে। এছাড়া মাঝে মাঝে নদী বা সমুদ্রতীরের কাছাকাছি জায়গায় বালুমহাল তৈরি করে অনবরত বালু উত্তোলন করা হয়। এর ফলে যখন বর্ষার দিনে বাঁধ বা নদীতীর সম্পূর্ণ পানির নিচে থাকে, তখন তীরের ঢালু অংশ থেকে মাটি ক্ষয় হতে থাকে; একে ‘আন্ডারকাটিং’ বলা হয়।

৪. কিছু নদী ছোট ছোট নালা দ্বারা গঠিত, যা বিভিন্ন ছোট মাটির দ্বীপ দ্বারা পৃথক করা থাকে; এদের বলে ‘ব্রেইডেড রিভার’। এসব নদীর মুখে বা পোতাশ্রয়ে বালুতট গঠিত হয়। ফলে নদীর মূলধারা থেকে প্রবাহের বিচ্যুতি ঘটে এবং তা নদীতীরে ভাঙন ঘটায়। কিছু নদী সর্পিলাকারে এঁকেবেঁকে প্রবাহিত হয়; এদের বলা হয় ‘মেন্ডারিং রিভার’। এ ক্ষেত্রে নদী যখন বাঁক নেয়, তখন বহিঃবাক বা ‘আউটার বেন্ড’ এ সৃষ্ট কেন্দ্রবিমুখী বলের কারণে নদীতীরে ভাঙন দেখা দেয়।

এবার মানবঘটিত কারণগুলো একে একে তুলে ধরা হল।

১. যাতায়াত ও দৈনন্দিন কাজে অধিক পরিমাণে বাঁধ ব্যবহার : আমাদের দেশে অনেক বাঁধই বহুবিধ কাজের উদ্দেশ্যে বানানো হয়। একটি বাঁধ যে একটি গ্রাম বা এলাকাকে বন্যা বা জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকেই বাঁচায়, তা নয়; এটি গ্রামের মানুষের চলাচল ও মালামাল পরিবহনের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে থাকে।

সমস্যাটা হয়, যখন বাঁধের ওপর অতিরিক্ত পরিমাণে মানবসমাগম ঘটতে থাকে। মানুষ ও গবাদিপশুর অবাধ বিচরণের ফলে বাঁধের চূড়া, পার্শ্ব ও সবচেয়ে জরুরি অংশ, বাঁধের গোড়া বা ঢালু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সাধারণত মানুষ বাঁধের গোড়ায় তাদের দৈনন্দিন কাজকর্ম, যেমন- গোসল, গবাদি পশুকে পানি খাওয়ানো ইত্যাদি কাজ করে থাকে বলে এ অংশটি বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

২. কৃষিকাজে পরোক্ষভাবে বাঁধ ব্যবহার : ২০১৭ সালের একটি ঘটনা। কুড়িগ্রামে ধরলা নদীতে থাকা একটি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ হঠাৎ পানির তোড়ে ভেসে যায়। এর ফলে কুড়িগ্রামের টগরাইহাটের একটি রেল সেতুও ভেঙে পড়ে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, বাঁধের গায়ে ইঁদুর ও উইপোকার গর্ত থাকায় সেটি ভেঙে পড়েছে। প্রশ্ন দাঁড়ায়, এত জায়গা থাকতে ইঁদুর কেন বাঁধের মাটিতে গিয়ে গর্ত করল?

কারণ অনুসন্ধানে বের হল, উত্তরাঞ্চলের মানুষ প্রচুর পরিমাণে ধান চাষ করে। ধান কাটা ও মাড়াইয়ের পর তা শুকানোর জন্য প্রচুর পরিমাণ জায়গা লাগে। কৃষকের উঠোনে এত ধানের সংকুলান হয় না। তাই তারা বাঁধের ওপর ধান শুকানো আরম্ভ করে। আর এটাই বাঁধটির জন্য কাল হল। ইঁদুর ধান খেতে বাঁধের মাটিতে তার স্থায়ী বাসস্থান তৈরি করতে শুরু করে। গর্ত খোঁড়ার সময় প্রচুর মাটি বাঁধ থেকে সরে যায়; ফলে বন্যার পানির অবারিত বেগে তা ভেঙে পড়ে।

৩. বাঁধ থেকে মাটি কাটা : উত্তরাঞ্চলের অনেক বাড়িঘর মাটির তৈরি। স্থানীয় বাসিন্দারা অনেক ক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব ঘরবাড়ি তৈরিতে অবাধে বাঁধ থেকে মাটি কাটতে থাকে। ফলে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

৪. বাঁধের ওপর গবাদিপশুর বিচরণ : বাঁধের ঢালে জন্মানো লতাগুল্ম জাতীয় উদ্ভিদের শিকড় মাটির গভীরে গিয়ে তা আঁকড়ে ধরে; ফলে ঢালের মাটির স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পায়। গবাদিপশু যদি অবাধে বাঁধের ওপর বিচরণ করে তাহলে তারা এসব উদ্ভিদ ভক্ষণ করে এবং বাঁধের স্থিতিশীলতা নষ্ট করে।

৫. বাঁধের ওপর অবৈধ বসতি : অনেক মানুষ বাঁধের ওপর অবৈধভাবে বসত গেড়ে পরিবার নিয়ে অস্থায়ী-স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। তবে বেশিরভাগ সময় দেখা যায়, এ মানুষ নদীভাঙনেরই শিকার। তারা বাঁধের ক্ষতি করে থাকে।

এছাড়া আরও বহুবিধ কারণে বাঁধ নষ্ট হতে পারে। আমাদের মনে রাখতে হবে, উপকূলীয় অঞ্চলের একটি বাঁধকে উত্তরাঞ্চলের একটি বন্যা নিয়ন্ত্রণকারী বাঁধের সঙ্গে একই পাল্লায় মাপা মোটেই উচিত নয়। উপকূলীয় অঞ্চলে যেমন ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বাঁধের অকার্যকারিতা বেশি পরিলক্ষিত হয়। অনেক ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে অনবরত সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বাঁধগুলোর বর্তমান উচ্চতা যথেষ্ট হয় না; এর উচ্চতা বৃদ্ধি তখন এক অপরিহার্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায় যেটা সিইআইপি, ফেজ-১-এ করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।

তাছাড়া উপকূলীয় বাঁধগুলো ষাটের দশকে তথা পাকিস্তান আমলে সেচ কাজের জন্য নির্মিত হয়েছিল; এখন সেগুলো দিয়ে আমরা আইলা, আম্পানের মতো ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলার কাজ করছি। স্বভাবতই, বাঁধগুলোর শতভাগ কার্যকারিতা আমরা নিশ্চিত করতে পারব না যদি না প্রতি বছর সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও যে কোনো দুর্যোগ-পরবর্তী এগুলোর পুনর্নির্মাণের প্রতি যথাযথ মনোযোগ দেয়া না হয়।

সমাধান কী হতে পারে : বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক গৃহীত বেশকিছু ভাঙনরোধী উন্নয়ন প্রকল্প বর্তমানে ভাঙনের কবলে পড়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল পাবনা সেচ পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প, মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্প, ভোলা সেচ প্রকল্প, কোস্টাল অ্যামব্যাঙ্কমেন্ট প্রজেক্ট (সিইপি), চাঁদপুর সেচ প্রকল্প এবং ব্রহ্মপুত্র ডান তীর বাঁধ। বাঁধ রক্ষার্থে নিুোক্ত বিষয়াদি মাথায় রাখা প্রয়োজন।

১. মাটির বাঁধগুলোর ঢালের উপরের পৃষ্ঠে প্রাকৃতিক বোল্ডার (বড় পাথরের চাঁই) কিংবা কংক্রিট-ইটের বোল্ডার দিয়ে একটি শক্ত আচ্ছাদন তৈরি করা, যাতে করে নদীর পানির করাল স্রোত বাঁধের মাটিকে সরাসরি এসে আঘাত করতে না পারে। কিছু জায়গায় এখন জিওটেক্সটাইল ব্যবহার করা হচ্ছে, যা পানিভেদ্য। জিওটেক্সটাইল ব্যাগ বা জিওব্যাগের ভেতর বালু ঢুকিয়ে তা দিয়েও বাঁধ রক্ষার কাজ করা হয়; অনেক ক্ষেত্রে জিওব্যাগের পাশাপাশি কংক্রিট ব্লক ব্যবহৃত হয়।

২. নদী বা সমুদ্রের পানির স্রোতের সঙ্গে লম্বাভাবে কাঠ, কংক্রিট বা পাথরের তৈরি কিছু শক্ত হাইড্রলিক কাঠামো থাকে, যাদের ‘গ্রোয়েন’ বলে (উদাহরণ: বগুড়ার কালিতলা গ্রোয়েন)। এগুলো পানির প্রবল স্রোতকে বাঁধাগ্রস্ত করে এবং পানির মধ্য দিয়ে বালুকণার চলাচলকে সীমিত করে দেয়। পরিকল্পিতভাবে গ্রোয়েন নির্মাণের মাধ্যমে বাঁধের ওপর চাপ কমানো সম্ভব।

৩. তুলনামূলক কম খরচে নির্মিত বাঁশের তৈরি কিছু ভাঙনরোধী কাঠামো থাকে যাদের ‘বান্ডেল’ বলে। এগুলোও মূলত পানির স্রোতের তীব্রতা কমিয়ে এনে নদীভাঙন রোধের কাজে ব্যবহৃত হয়। বান্ডেল ব্যবহার করলে বাঁধের ওপর সরাসরি পানির আঘাত থেকে কিছুটা রেহাই পাওয়া যেতে পারে। উদাহরণ : রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার বালাপাড়া ইউনিয়নের তালকু সাহাবাজ এলাকা কিংবা কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার নামাপাড়া গ্রামে নির্মিত বান্ডেল। বাংলাদেশে বান্ডেলের ব্যবহার নিয়ে এখন সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে।

৪. বাঁধের মাটিতে আকারে ছোট কিন্তু লম্বা শিকড়যুক্ত লতাগুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ (যেমন- বিন্নাঘাস বা ভেটিভার) রোপণ করে তার স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি করা সম্ভব। এসব উদ্ভিদের শিকড় বাঁধের মাটির গভীরে গিয়ে তাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে থাকে ফলে ভূমিক্ষয় কম হয়। প্রাণ-প্রকৌশলগত সমাধান বলে এটি পরিবেশবান্ধবও বটে। তবে তীব্র স্রোতযুক্ত নদীতে এটি তেমন একটা ফলপ্রসূ হবে না। যেসব নদীতে মাঝারি থেকে মৃদু স্রোত রয়েছে কিংবা স্থির পানির জলাশয়ের পাড় রক্ষার্থে এটি অধিক উপযোগী। খরচও বেশ কম হয়।

৫. উপকূলীয় এলাকার বাঁধগুলোর উচ্চতা বৃদ্ধি বর্তমানে অত্যাবশ্যক। আম্পানের সময় প্রায় ১০-১৫ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস এসেছে। এ পরিমাপ মাথায় রেখে বাঁধগুলোকে কমপক্ষে ১৮ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট করে নির্মাণ করা উচিত। ৬. বাঁধ নির্মিত এলাকায় মানুষের মাঝে বাঁধের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। কী কী কাজ করলে বাঁধের ক্ষতি হয় এবং বাঁধের ওপর দিয়ে যাতায়াত ও মালামাল পরিবহন কেমন করে করা উচিত এ ব্যাপারে তাদের দিকনির্দেশনা দেয়া যেতে পারে।

নিয়মিত পরিসরে এলাকার মানুষকে কাউন্সেলিং করা প্রয়োজন। এ কাজটিতে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি বিভিন্ন অলাভজনক সংস্থা এগিয়ে আসতে পারে; কাউন্সেলিংয়ের কাজে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের সাহায্য নেয়া যায়।

৭. বাঁধ থেকে মাটি কাটা বন্ধে প্রশাসনকে আইনগতভাবে শক্ত হতে হবে। কোনো সুনির্দিষ্ট গ্রামবাসী একই কাজ বারবার করলে তার কারণ অনুসন্ধান করে তা সমাধানের ব্যবস্থা নিতে হবে। ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে কেউ বাঁধের মাটি কাটলে রাষ্ট্রীয় বিধি মোতাবেক কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

৮. বাঁধের ওপর ধান শুকানো ও গবাদিপশুর অবাধ বিচরণ বন্ধ করতে হবে।

৯. ‘আশ্রয়ণ’ বা ‘গুচ্ছগ্রাম’ প্রকল্পের মতো উদ্যোগের আওতায় বাঁধের ওপর অবৈধভাবে বসবাসরত মানুষদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিতে হবে।

১০. বাঁধের ওপর বৃক্ষ বা তুলনামূলক বড় উদ্ভিদ রোপণ করলে তা পাইপিং ইফেক্টের মাধ্যমে বাঁধের স্থলপার্শ্বে ক্ষতি করে। তাই বাঁধের উভয় পার্শ্বের ৫ মিটারের মধ্যে কোনো প্রকার বৃহদাকার বৃক্ষরোপণ করা যাবে না।

১১. বাঁধের উভয় পার্শ্বে সর্বনিু ১ অনুপাত ৩ ঢাল রাখতে হবে। বাঁধ নির্মাণের সময় এর চূড়াকে পানির সমতল থেকে একটি ন্যূনতম উচ্চতায় রেখে নকশা করা হয়; এ উচ্চতাকে বলা হয় ‘ফ্রি বোর্ড’। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকার নদীগুলোর জন্য ফ্রি বোর্ডের পরিমাণ রাখতে হবে কমপক্ষে ১ দশমিক ৫২ মিটার। অন্যান্য মধ্যম গতির নদীগুলোর জন্য এর পরিমাণ রাখতে হবে ন্যূনতম শূন্য দশমিক ৯১ মিটার।

১২. বাঁধের মাটি যথাযথভাবে সন্নিবিষ্ট বা ‘কমপ্যাক্ট’ করতে হবে। মাটির গুণাগুণ বিশ্লেষণ না করে তা ব্যবহার করা যাবে না। বাঁধের ভিত্তিতে কখনও পিট মাটি ব্যবহার করা যাবে না। পিট মাটিতে ২০ শতাংশের বেশি জৈব বস্তু থাকে। ফলে ক্রমাগত ভার পড়তে থাকলে বাঁধের মাটির দ্রুত অবনমন ঘটে এবং নকশায় নির্ধারিত উচ্চতার চেয়ে বাঁধের উচ্চতা ধীরে ধীরে কমতে থাকে।

এ ধরনের নিচু বাঁধ ঘূর্ণিঝড়ের সময় সৃষ্ট উঁচু জলোচ্ছ্বাসের ঢেউ মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়। কাজেই ঠিকাদারদের ব্যবহারকৃত মাটির গুণাগুণ সম্পর্কে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।

সর্বোপরি আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, বাংলাদেশ এমন একটি বদ্বীপের অন্তর্ভুক্ত যা গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার মতো তিনটি শক্তিশালী নদীর সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে। এ তিনটি নদীর সম্মিলিত ক্যাচমেন্ট ১৭ লাখ ৫৮ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত; যা বাংলাদেশের আয়তনের প্রায় ১২ গুণ। প্রতি বছর প্রায় দুই বিলিয়ন টন বালুকণা এ নদীগুলোর মধ্য দিয়ে এসে বঙ্গোপসাগরে পড়ে, যার পরিমাণ পৃথিবীর অন্য যে কোনো নদীর থেকে অনেক বেশি।

এত শক্তিশালী নদী ব্যবস্থার ক্ষেত্রে তীর রক্ষাকারী বাঁধগুলোকে প্রচণ্ড চাপের মধ্যে থাকতে হয়। এটি বাদে নিয়মিত বিরতিতে বিভিন্ন ঘূর্ণিঝড় তো আছেই। সব মিলিয়ে মাঝে মাঝে অবস্থা খুবই বেগতিক হয়ে পড়ে। তবে সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে এগোলে এত সমস্যার পরও আমরা বাঁধগুলোকে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হব।

দিন শেষে একটি বাঁধ রক্ষার দায়িত্ব কেবল রাষ্ট্রের একার হাতে ছেড়ে দিলে হবে না। ওই এলাকার মানুষেরও বাঁধের প্রতি একটি আলাদা দায়বদ্ধতা রয়েছে। জনসাধারণ, রাষ্ট্র ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যক্তি ও সংস্থার সম্মিলিত প্রয়াসই পারে বাংলাদেশের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলোর সর্বোচ্চ কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে।

এনায়েত চৌধুরী ও ড. একেএম সাইফুল ইসলাম : অধ্যাপক, পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউট, বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com