বিদেশী ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে সরকারি খাতকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে বেসরকারি খাত। গত ৫ বছরের ব্যবধানে বেসরকারি খাতে ৬৩ শতাংশ বিদেশী ঋণ বেড়েছে। সরকারি খাতে এই বৃদ্ধির হার ৫৬ শতাংশ। গত বছর শেষে দেশে সামগ্রিক বিদেশী ঋণ বেড়ে হয়েছে ৬ হাজার ২৯ কোটি ডলার, যা স্থানীয় মুদ্রায় প্রায় ৫ লাখ সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা হিসেবে)। এর মধ্যে বেসরকারি খাতেই ১ লাখ সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা। বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নিয়ে নির্ধারিত মেয়াদ শেষে বৈদেশিক মুদ্রায় সুদে-আসলেই পরিশোধ করতে হয়। সঠিক কাজে বৈদেশিক মুদ্রার ঋণ ব্যবহার না হলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ বেড়ে যায়। এ কারণে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে বেসরকারি খাতে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ অনুমোদনের পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম রোববার নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, বেসরকারি খাতে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ অনুমোদনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কারণ এসব ঋণ বৈদেশিক মুদ্রায় নেয়া হয় আর সুদে আসলে বৈদেশিক মুদ্রায় পরিশোধ করতে হয়। এ কারণে যে খাতে ঋণ অনুমোদন করলে বৈদেশিক মুদ্রা আয় বাড়ে ওই খাতেই বৈদেশিক মুদ্রার ঋণ অনুমোদন দিতে হবে। এটা না করা হলে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের ওপর চাপ বেড়ে যাবে।
তিনি বলেন, হংকং, কোরিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশ এর আগে সমস্যায় পড়ে গিয়েছিল। তাদের বেসরকারি খাত এক সময় বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নিয়ে আবাসন খাতসহ নানা স্থানীয় ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছিল। কিন্তু এক সময় ওইসব খাতে সমস্যা দেখা দেয়ায় বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ ফেরত দিতে সমস্যায় পড়ে যায়। এর ফলে ওইসব দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ বেড়ে যায়। বর্তমানে আমাদের দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ভালো অবস্থানে রয়েছে। আপাতত বৈদেশিক মুদ্রায় দায় পরিশোধের ক্ষেত্রে সমস্যা না থাকলেও ভবিষ্যতে সমস্যায় পড়তে হতে পারে। এ কারণে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ অনুমোদনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ রোববার এ বিষয়ে নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, বেসরকারি খাতে বৈদেশিক মুদ্রার ঋণ নেয়ার মধ্যে নানা ধরনের ঝুঁকি থাকে। প্রথমত, যাকে বা যে শিল্প গ্রুপকে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ আনার অনুমোদন দেয়া হবে, ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ঋণ ফেরত দেয়ার সক্ষমতা কতটুকু রয়েছে সেটা আগে যাচাই করতে হবে। কী উদ্দেশ্যে ঋণ নেয়া হবে, সেটা বৈদেশিক মুদ্রা আয় বর্ধক খাত কি না তা আগে দেখতে হবে। যদি ঋণ ফেরত দেয়ার সক্ষমতা না থাকে, বা যে উদ্দেশ্যে ঋণের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে সেটা থেকে যদি বৈদেশিক মুদ্রা আয় না হয় তাহলে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ ফেরত দিতে পারবে না। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ বেড়ে যাবে। দ্বিতীয়ত, ডলারের সাথে বিনিময় মূল্যের ঝুঁকি বেড়ে যায়। কারণ যখন ঋণ অনুমোদন দেয়া হচ্ছে তখন প্রতি ডলার ছিল ৭৭ টাকা। এখন প্রতি ডলার ৮৫ টাকা। এতে আপাতত সুদ কম হলেও পরিশোধের সময় এসে প্রকৃত সুদ বেড়ে যাচ্ছে। কারণ বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নিয়ে বৈদেশিক মুদ্রায় ফেরত দিতে হবে। যিনি ঋণ ফেরতে দেবেন, তাকে স্থানীয় মুদ্রায় ডলার কিনেই ফেরত দিতে হবে। ফলে প্রকৃত সুদ অনেক বেড়ে যায়। তৃতীয় ঝুঁকি হলো বৈদেশিক মুদ্রা পাচার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অনেকেই বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নিয়ে প্রকৃত পণ্য না কিনে অথবা কম দামের পণ্য এনে বেশি দাম দেখিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করে থাকে। এ রকম কয়েকটি ব্যাংকের বিরুদ্ধে এমন ঘটনা উদঘাটন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ কারণে এক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হয় নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে। আবার অনেকেই বৈদেশিক মুদ্রায় যে উদ্দেশ্যে ঋণ আনেন ওই কাজে আর ব্যবহার করেন না। কেউবা স্থানীয় ঋণ পরিশোধ করেন বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নিয়ে। এভাবে বৈদেশিক মুদ্রায় বেসরকারি খাতে ঋণ ঝুঁকি হয় সবচেয়ে বেশি। এ কারণে গভর্নরের নেতৃত্বে একটি কমিটি রয়েছে। ওই কমিটিকে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে ঋণ অনুমোদন দিতে হয়।
তিনি মনে করেন, এসব ঝুঁকি কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি বাড়াতে হবে। তা না হলে বৈদেশিক মুদ্রায় দায় বেড়ে যাবে। চাপ বেড়ে যাবে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের ওপর।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ২০১৩ সালের আগে বেসরকারি খাতে ঋণ অনুমোদন দেয়া হতো খুবই সীমিত আকারে। কিন্তু ২০১৩ সাল থেকে ঢালাওভাবে বেসরকারি খাতে ঋণ অনুমোদন দেয়া শুরু হয়। মাত্র তিন বছরেই বেসরকারি খাতে বৈদেশিক মুদ্রায় দায় ২০১৫ সালে বেড়ে হয় ৮০০ কোটি ডলার। এরপর প্রতিবছরই বাড়তে থাকে। ২০১৬ সালে ৯২৫ কোটি ডলার, ২০১৭ সালে ১২২৮ কোটি ডলার, ২০১৮ সালে ১২৫২ কোটি ডলার এবং ২০১৯ সাল থেকে তা বেড়ে হয় ১৩১১ কোটি ডলার। এ সুবাদে ৫ বছরের ব্যবধানে বেসরকারি খাতে বৈদেশিক মুদ্রায় দায় বেড়েছে ৬৩ শতাংশ। বেসরকারি খাতের তুলনায় সরকারি খাতে বিদেশী ঋণ কম হারে বেড়েছে। ২০১৫ সালে সরকারের বিদেশী ঋণ যেখানে ছিল তিন হাজার ২১ কোটি ডলার, সেখানে ২০১৯ সালে এসে তা হয়েছে ৪ হাজার ৭১৮ কোটি ডলার। ৫ বছরের ব্যবধানে সরকারের বিদেশী ঋণ বেড়েছে প্রায় ৫৬ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিদেশী ঋণ আনার ক্ষেত্রে কিছুটা কড়াকড়ি করা হচ্ছে। এ জন্য অফশোর ইউনিটের জন্য পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা দেয়া হয়েছে। এ নীতিমালার আলোকে তদারকি করা হচ্ছে।