দিন দশেক হলো যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণা শুরু করেছেন প্রার্থীরা। বলা হচ্ছে, কাছাকাছি সময়ে কোনো মার্কিন নির্বাচনে এত তিক্ততা ও সামাজিক বিভাজন দেখা যায়নি।
করোনাভাইরাস মহামারি আর দেশজুড়ে নানা শহরে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন ও সহিংস দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে শুরু হওয়া প্রচারণায় ট্রাম্প ও বাইডেন ক্যাম্প দুই পক্ষই আক্রমণাত্মক ও উস্কানিমূলক অবস্থান নিয়েছেন।
দ্বিতীয়বার মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য লড়ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রতিপক্ষ জো বাইডেন সমর্থকদের উদ্দেশ্যে সম্প্রতি তিনি হুশিয়ার দিয়েছে যে, লুটেরা ও নৈরাজ্যবাদীদের যেভাবেই হোক আমেরিকার মাটি থেকে উচ্ছেদ করবেন তিনি।
নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন। তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মেয়াদকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এক কালো অধ্যায় হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, মার্কিন জনগণের একতা এই কালো অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটাবে। এভাবেই চলছে একে অপরকে আক্রমণ। নির্বাচনে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে যা নতুন নয়। যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আসছে তেসরা নভেম্বর।
কিন্তু দুই দলই চড়া মেজাজে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে বছরের শুরু থেকেই।
নিউ জার্সি শহরের বসবাস করেন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ক্যান্সার গবেষক ড. সুবর্না খান। যুক্তরাষ্ট্রের গত নির্বাচনে প্রথমবার ভোট দিয়েছেন তিনি।
এবারের নির্বাচনে বর্ণভিত্তিক এক ধরনের তিক্ততার আবহ তিনি দেখছেন। সেই সময়কার সাথে এবারের নির্বাচনের পরিবর্তন উল্লেখ করে তিনি বলছিলেন, ‘গতবারের নির্বাচনে বিষয়টা ছিল আগের অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের ব্যর্থতাগুলো তুলে ধরা। দেশকে বিকিয়ে দেয়া হয়েছে, দেশের কাজ বাইরে চলে গেছে – এই জিনিসগুলো প্রধান ছিল। এবারের মেজাজটা আমি বলবো অনেক বেশি তিক্ত।’
‘ডোনাল্ড ট্রাম্প আসার পরে গত চার বছরে রিপাবলিকান পার্টির যে পলিসগুলো তৈরি হয়েছে সেখানে, ‘ইউনাইটেড স্টেটস অফ অ্যামেরিকা, দ্যা ল্যান্ড অফ ড্রিমস’, সেই যায়গাটা থেকে আমরা অনেকটাই সরে এসেছি। শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক, শ্বেতাঙ্গ প্রধান, ইমিগ্র্যান্টরা আমাদের সব কাজ নিয়ে নিচ্ছে এরকম গোষ্ঠীভিত্তিক চিন্তাভাবনা আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি।’
ডেমোক্র্যাট সমর্থকদের মৌনতা ভঙ্গ?
এবারের নির্বাচন এমন এক সময় অনুষ্ঠিত হচ্ছে যখন এর পটভূমিতে রয়েছে দেশটিতে করোনাভাইরাস মহামারিতে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা, সারা দেশজুড়ে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন, পুলিশের সাথে সংঘর্ষ ও দাঙ্গা।
উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যের ম্যাডিসন শহরে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন নাফসানিয়াথ ফাতেমা। তিনি বলছেন, এবার মানুষজন রাজনীতি ও দলগত সমর্থন নিয়ে অনেক বেশি প্রকাশ্যে কথা বলছে, বিশেষ করে ডেমোক্র্যাট সমর্থকরা।
সে বিষয়ে ধারণা দিয়ে তিনি বলছেন, ‘পলিটিক্স নিয়ে মানুষ অনেক ওপেনলি কথা বলা শুরু করেছে। কে কোন দল সাপোর্ট করছে আগে বিষয়টা যার যার ব্যক্তিগত বিষয় মনে করতো। এখন প্রচণ্ড তিক্ততা দেখা যায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে। প্যান্ডেমিকের কারণে মানুষজন ঘরে বেশি থাকছে এবং সোশাল মিডিয়া ব্যবহার করছে। আমার মনে হয় ডেমোক্র্যাটদের সমর্থকরা একটু চুপচাপ থাকতো। কিন্তু এখন তারা অনেক অ্যাক্টিভ হয়ে গেছে। বিশেষ করে জর্জ ফ্লয়েড এবং (জেকব) ব্লেকের ঘটনার পরে অনেক প্রোটেস্ট হচ্ছে ‘
কী নিয়ে এত তিক্ততা ও বিভাজন?
নাফসানিয়াথ ফাতেমা যে দুটি নাম উল্লেখ করছিলেন সেই নাম দেশটিতে ব্যাপক আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে।
যে অঙ্গরাজ্যে তিনি বাস করেন সেই উইসকনসনে দিন দশেক আগে জেকব ব্লেক নামে কৃষ্ণাঙ্গ এক তরুণকে একজন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তা সাতবার পিঠে গুলি করার পর থেকে সেখানে সহিংস বিক্ষোভ শুরু হয়।
শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তাদের গুলিতে কৃষ্ণাঙ্গদের মৃত্যু গত কয়েক বছরে অনেক বেশি সংখ্যায় ঘটছে।
জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ড এবছরের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা। বেশিরভাগ আলোচিত ঘটনায় হত্যাকাণ্ডের শিকার কৃষ্ণাঙ্গরা নিরস্ত্র ছিলেন এবং তাদের হত্যাকাণ্ডের ঘটনার ভিডিও প্রকাশিত হওয়ার পর তোলপাড় শুরু হয়।
এসব হত্যার প্রতিবাদে বেশ লম্বা সময়জুড়ে দেশটিতে আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে, যা ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ নামে পরিচিত।
এই আন্দোলন দেশটিতে সামাজিক বিভাজনের চিত্র স্পষ্ট করে ফুটিয়ে তুলেছে। যুক্তরাষ্ট্রে এই চরম তিক্ততা ও বিভাজনের মুল উৎস হিসেবে তিনটি বিষয় উল্লেখ করছিলেন রাজনীতির বিশ্লেষক অধ্যাপক আলী রিয়াজ।
‘তিনটি প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ ও রাজনীতিতে বিভাজন ছিল। একটা হলো দরিদ্রদের সাথে ধনীদের পার্থক্য, বৈষম্য। দ্বিতীয়টি হচ্ছে বর্ণের প্রশ্ন।’
‘বর্ণবাদী ব্যবস্থাকে সমর্থন করে এরকম লোকজনের সংখ্যা বেড়েছে। অথবা তারা প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে। যার মধ্যে একটা অন্যতম দিক হচ্ছে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের উপস্থিতি। তৃতীয়টি হচ্ছে ইমিগ্রেশন।’
‘শ্বেতাঙ্গদের একটা বড় রকমের ভীতি হচ্ছে যে যুক্তরাষ্ট্র গত কয়েক দশকে যেভাবে পরিবর্তিত হয়েছে এবং আগামীতে যেভাবে পরিবর্তিত হবে তাতে শ্বেতাঙ্গরা আসলে সংখ্যালঘুতে পরিণত হবে। এই বিষয়গুলো দীর্ঘদিন ধরে থাকলেও এখন সেগুলোকে ব্যবহার করা হচ্ছে।’
উস্কানিমূলক আর নোংরামির প্রচারণা
বিশেষ করে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দায়ী করা হচ্ছে বর্ণবাদ, উগ্র জাতীয়তাবাদ ও অভিবাসনবিরোধী মনোভাবকে উস্কে দেয়ার জন্য। ২০১৬ সালের নির্বাচনেই যার শুরু।
জো বাইডেন একই ইস্যুকে ঠিক উল্টোভাবে ব্যবহার করে অভিবাসী ও কৃষ্ণাঙ্গদের ভোট আকর্ষণের চেষ্টা করছেন। সেই সাথে পোস্টাল ব্যালটের জন্য সোচ্চার তার ক্যাম্প। অর্থাৎ বাড়িতে পাঠানো ব্যালট পূরণ করে চিঠিতে ভোট দেয়ার সুযোগ।
ডেমোক্র্যাটরা এর মাধ্যমে ভোট কারচুপির চেষ্টা করছে বলে সরাসরি অভিযোগ করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্প ক্যাম্পের উস্কানি জো বাইডেন কতটা সামাল দিতে পারবেন সেনিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অনেকে।
সাউথ ক্যারোলাইনা স্টেট ইউনিভার্সিটির সাংবাদিকতার অধ্যাপক ড. শফিকুর রহমান যুক্তরাষ্ট্রে আটটি নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন।
তিনি বলছেন, কাছাকাছি সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে উস্কানিমূলক আর নোংরামির নির্বাচন হচ্ছে এবছর। প্রচারণার ধরন, ভাষা ও মেজাজে অনেক পরিবর্তন এবার দেখতে পাচ্ছেন তিনি।
‘গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সম্মানের সাথে অপজিশনকে ট্রিট করার যে সংস্কৃতি ছিল, সেই পরিবেশটা গত নির্বাচনে ২০১৬-তে এবং এবার যা হচ্ছে তা অবিশ্বাস্য। কী করলে মানুষের উপকার হবে, ব্যবসা বাণিজ্যের মাধ্যমে, আইনের মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য যে সম্পর্ক ছিল, সেটা চলে গেছে। এখন এটা ব্যক্তিগত ব্যাপারে চলে গেছে। কে কোনো মেয়ের সাথে কোথায় গেছে, কার ছেলে কোন আইন ভঙ্গ করেছে এই ধরনের ব্যক্তিগত বিষয় দিয়ে নোংরা পরিবেশ তৈরি হয়েছে।’
স্বপ্নের দেশে স্বপ্নভঙ্গ
বহু জাতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র। যাকে বলা হয় ল্যান্ড অফ ড্রিমস, অপরচুনিটি, অর্থাৎ যেখানে গেলে সকল স্বপ্ন পূরণ হয় বলে ধারণা। যে স্বপ্নে বিভোর হয়ে সারা পৃথিবী থেকে মানুষ সেখানে ছোটেন।
মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের প্রশ্নে যে দেশটি পুরো বিশ্বকে প্রতিনিয়ত তিরস্কার করে সেখানকার রাজনীতির এমন বহিঃপ্রকাশ দেশটির সমাজ সম্পর্কে কি মনোভাব তৈরি করে?
বাংলাদেশের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান বলছেন, ‘অনেক রকমের জাতিকে নিয়ে একসাথে থাকতে হবে এবং বৈচিত্র্যটা মানতে হবে- এটা ম্যানেজ করা সবাই যে পারে তা নয়।’
‘মানুষের মধ্যে বিভাজন থাকে কিন্তু রাজনীতিবিদরা ডাইভারসিটির প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে সবাইকে এক রাখতে পারে। লিডারশিপটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অনেক রাজনীতিবিদ এই বিভিন্ন জাতির মানুষগুলোকে এক অপরের বিরুদ্ধে উস্কে দিয়ে ফায়দা লুটতে চায়।’
তবে মার্কিন নির্বাচন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে পুলিশি নির্যাতন আর ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনকে ঘিরে।
দুই পক্ষই ভিন্নভাবে একে ব্যাবহার করার চেষ্টা করলেও এই আন্দোলনের ফসল শেষ পর্যন্ত কার ঘরে উঠবে সেটি এখনো নিশ্চিত নয়।
সূত্র : বিবিসি