বিশ্বের প্রধান শহরগুলোর মধ্যে ঢাকার বায়ুতে দূষণের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টা পর্যন্ত তথ্য অনুযায়ী দূষিত বায়ুর শহরগুলোর মধ্যে ঢাকার অবস্থান ছিল চতুর্থ। ওই তালিকার শীর্ষ তিনটি শহর যথাক্রমে ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লি, কলকাতা ও ইন্দোনেশিয়ার জার্কাতা। চতুর্থ স্থান অধিকারী বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার পর পঞ্চম অবস্থানে দেখা গেছে ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয়ের নাম। বিশ্বের বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়ালের পর্যবেক্ষণে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
জানতে চাইলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল্লাহ আল মোহসীন চৌধুরী বলেন, বায়ুদূষণ রোধে অনেক দিন থেকে কাজ হচ্ছে। ১৬টি সার্বক্ষণিক বায়ুমান পরিবীক্ষণ কেন্দ্র (ক্যামস) থেকে সার্বক্ষণিক বায়ুদূষণের মাত্রা পরিমাপ করা হচ্ছে। বায়ুদূষণ বাড়ার কারণ নির্ণয়ে নতুন জরিপের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এতে বায়ুর পাশাপাশি পরিবেশের সব ধরনের দূষণকার্যক্রম সম্পর্কে জরিপ করা হবে। এর মাধ্যমে দূষণের একটা সমন্বিত ধারণা পাওয়া যাবে। আবাসন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণের কারণে কৃষিজমি কমছে। অটোব্রিকসের জন্য নদী খননে উত্তোলিত বালুমাটি ব্যবহার করা যায়। এতে ভূমিক্ষয় রক্ষা পাবে। দূষণ রোধে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে, তবে তা অবশ্যই দেশের উপযোগী হতে হবে। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি ব্যক্তিপর্যায়েও সচেতনতা বাড়াতে হবে। তাহলেই দূষণ রোধে ফল মিলবে।
পরিবেশ আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, সমস্যা সমাধানেও পরিবেশ অধিদফতরকে কাজ করতে হবে। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, আইন বিধিমালা প্রণয়নের পাশাপাশি জনগণকে সচেতন করতে হবে। গ্যাস পোড়ালেও রান্নাঘরের পরিবেশ দূষিত হয়। এ জন্য বিভিন্ন জ্বালানির স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত চার দিকে ছড়িয়ে দিতে হবে। জনগণকে বেছে নেয়ার সুযোগ দিতে হবে কিভাবে দূষণমুক্ত জীবন যাপন করতে পারে। বায়ুদূষণের ভয়াবহতা সম্পর্কে তাদের উদ্বেগ তৈরি করতে হবে। বায়ুদূষণ রোধে পরিবেশ অধিদফতরের পাশাপাশি অন্যান্য সরকারি দফতর বিশেষ করে স্থানীয় সরকার বিভাগ ও এর সংস্থাগুলোকেও কাজে লাগাতে হবে। চিকিৎসকদের বায়ুদূষণের প্রভাব সম্পর্কে সরকারকে ধারণা দিতে হবে। আইন অনেক হয়েছে, এগুলো প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। ২০৭০ সালের মধ্যে দেশের কৃষিজমি নাই হয়ে যাবে। তাই ইটভাটা ও আবাসন শিল্পে জমির ব্যবহারে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে।
পরিবেশ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের মিরপুর-৯ স্বপ্ন নগর এলাকায় এক হাজার আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্প, লালমাটিয়া নিউ কলোনি ১৩২ আবাসিক ফ্ল্যাট (রিভাইজড ১৫৩) নির্মাণ প্রকল্প, ঢাকা মিরপুর ১৫ নম্বর সেকশনে সরকারি-আধাসরকারি কর্মকর্তাদের জন্য ‘রূপনগর’ আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্প, মিরপুর ১৫ নম্বর সেকশনে (গ্রেনেড হামলায় নিহত ও আহতদের) জন্য ১০০ আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্প, লালমাটিয়া নিউ কলোনি ১২০ ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্প, মিরপুর (সেকশন-৯) ১৪তলা ১৫ ফ্ল্যাট (দ্বিতীয় পর্যায়) নির্মাণ প্রকল্প, লালমাটিয়া হাউজিং এস্টেট ৫৪ ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্প, লালমাটিয়া হাউজিং এস্টেট ৭২ আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্প, লালমাটিয়া কমিউনিটি সেন্টার কাম অফিস স্পেস ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প, মিরপুর সেকশন-১৬ আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্প ইত্যাদি বহুতল ভবন-আবাসন প্রকল্পের জন্য জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ অবস্থানগত ছাড়পত্র এবং পরিবেশগত ছাড়পত্র নেয়নি। এসব প্রকল্পের ছাড়পত্র না নেয়ার কারণ ব্যাখ্যা চেয়ে চিঠি দিলেও কোনো উত্তর পায়নি অধিদফতর।
পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক সাখাওয়াত হোসেন বলেন, শুধু গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ নয়, আরো অনেক প্রতিষ্ঠান ছাড়পত্র ছাড়াই কাজ করছে। এসব বিষয় মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়েছে। তিনি বলেন, রাজধানীতে মেট্রোরেলসহ বিভিন্ন উন্নয়মূলক কাজ চলমান থাকায় পরিবেশ দূষণের মাত্রা বেড়ে গেছে। আমরা চেষ্টা করছি সেই দূষণ কিভাবে কমিয়ে আনা যায়। আগামী সপ্তাহ থেকে ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে অভিযান আরো জোরদার করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পরিবেশদূষণে ঢাকা শহরের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলছে। বিশেষ করে মেট্রোরেল নির্মাণকারী সংস্থা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কর্তৃপক্ষ, ২০ তলা নির্মাণাধীন জাতীয় রাজস্ব ভবন নির্মাণ কর্তৃপক্ষ, ঢাকা সিটি করপোরেশন উত্তর এবং দক্ষিণ, ঢাকা ওয়াসা, সড়ক ও জনপথ অধিদফতর, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর, গণপূর্ত অধিদফতর, তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল সম্প্রসারণ কর্তৃপক্ষ, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ২৪ তলা ভবন নির্মাণ প্রকল্প, সরকারি কর্মচারীদের জন্য নির্মাণাধীন ১৪ তলা ভবন কর্তৃপক্ষ, ভূগর্ভস্থ ক্যাবথল লাইন প্রকল্প, ঢাকা সিটি করপোরেশনের (উত্তর) আগারগাঁও রাস্তা নির্মাণ প্রকল্প, বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের ১৪ তলা বিটিইবি ভবন-২ প্রকল্প, নির্মাণাধীন বিটিআরসি ভবন, বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের নির্মাণাধীন ১৩ তলা ভবন নির্মাণ প্রকল্প বায়ুদূষণে ভূমিকা রাখছে। এ ছাড়াও দূষণ হচ্ছে নানা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিগত নির্মাণকাজ থেকেও।
এসব প্রতিষ্ঠানকে পরিবেশ অধিদফতর দূষণ রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার তাগিদ দিলেও তারা কোনো সাড়া দেয় না। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে সমন্বয় সভায় ডাকা হলেও বেশির ভাগ সংস্থা তাদের মাঝারি পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পাঠিয়ে দায় সারছে। ফলে পরিবেশ অধিদফতর ইচ্ছা থাকলেও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছে না।
ধুলাবালি মিশ্রিত বাতাসের কারণে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। অন্য দিকে শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকি ও নিরাপত্তাহীনতা দিন দিন বেড়েই চলছে। এই সমস্যা পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব না হলেও কিছু সচেতনতা ও কার্যকর পদক্ষেপ তা অনেক কমিয়ে আনতে পারে বলে মনে করেন পরিবেশবাদীরা।
আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদী সংগঠন গ্রিনপিস ও এয়ার ভিজ্যুয়াল গবেষণা জরিপ অনুযায়ী, ২০১৮ সালের দূষণের সূচকে বিশ্বের তিন হাজার ৯৫টি শহরের মধ্যে সবচেয়ে দূষিত ৩০টি শহরের ২২টি ভারতের, পাকিস্তানের দু’টি, চীনের পাঁচটি ও বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা রয়েছে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, বায়ুদূষণের ফলে শুধু ফুসফুসকেন্দ্রিক রোগ বিস্তার লাভ করতে পারে এমনটি নয়। এর মাধ্যমে হৃদরোগ, স্ট্রোক ও ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশের মতো মারাত্মক রোগও ছড়িয়ে পড়তে পারে। পাশাপাশি অনেক ছোটখাটো রোগবালাইসহ প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মানসিক অবসাদ ও শিশুদের মধ্যে অ্যাজমার মতো রোগ ছড়িয়ে দিতে পারে। বায়ুদূষণের লাগাম টেনে না ধরতে পারলে শ্বাসজনিত নানা রোগ, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, ক্যান্সার ও জেনেটিক পরিবির্তনজনিত নানা অজানা রোগে ভুগতে হতে পারে চরমভাবে। এতে এক দিকে যেমন চিকিৎসাব্যয় বেড়ে যাবে তেমনিভাবে অসুস্থ মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে উৎপাদনশীতাও ব্যাপকভাবে কমে যেতে পারে।
জানতে চাইলে জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা: শাহিদুর রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, বায়ুদূষণের কারণে অ্যাজমার প্রভাব বাড়ে। ঘনবসতি ও কলকারখানার ধোঁয়া, ধুলাবালির কারণে শহরাঞ্চলের বায়ু বেশি দূষিত থাকে। এ কারণে শহরাঞ্চলের মানুষের অ্যাজমায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। সালফার ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড থেকে শুরু করে মার্কারি, লেডের মতো ভারী পদার্থ বাতাসে মিশে যাচ্ছে। এগুলো ফুসফুসের পাশাপাশি হৃদরোগ, যকৃতের সমস্যা ও প্রসূতি মায়েদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এ কারণে অ্যাজমা রোগী বাড়ছে। বায়ুদূষণ কমাতে রাজধানী ও আশপাশের ইটভাটা, যানবাহন ও ট্যানারিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ এবং সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পরামর্শ দেন তিনি।