ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ কাটে স্বপ্নের মতো। ব্যাটে-বলে তার জাত চেনান। তারপর কাটা পড়েন সাসপেনশনের খাঁড়ায়। সদ্য ফিরেছেন। বর্তমানে তার ভাবনাজুড়ে আগামীর বিশ্বকাপ। প্রস্তুত করছেন নিজেকে। ভাবছেন দল নিয়েও। এসব নিয়ে কথা বলেছেন। লিখেছেন মাইদুল আলম বাবু
অশ্রুসিক্ত নয়নে মিরপুর ছেড়েছিলেন সাকিব আল হাসান। নিষেধাজ্ঞায় জীবন থেকে একটি বছর ঝরে গেল। অবশ্য করোনা মহামারীর জন্য ক্রিকেটও তেমন হয়নি। এবার ফিরলেন হাসি নিয়ে। যখন মিরপুরে ফিরলেন, তখন বদলে গেছেন বাঁহাতি এই স্পিনার। ঝাঁকড়া চুলে ছেয়ে গেছে মাথা। সে জন্য ব্যান্ড দিয়ে চুল আটকে রাখেন পেছনে। একেবারে আমেরিকান হিপ্পি যুবকদের মতো! আগের চেয়ে আরও অনেক লাজুক ও চুপচাপ এই সাকিব সবার চেনাই। ২০১৯ বিশ্বকাপ স্মরণীয় ছিল। ইংল্যান্ডে ব্যাটে ও বলে ছিলেন অবিশ্বাস্য। এখন তার বয়স ৩৩ চলছে। ২০২৩-এর মধ্যে তিনটি বিশ্বকাপ পাড়ি দিতে হবে।
ফেরার প্রত্যয় নিয়ে সাকিব আল হাসান অধিনায়কত্ব নিয়ে বেশকিছু দিন আগে আমাদের সময়কে নিজের একটি ভিডিওবার্তায় বলেছিলেন- ‘এটি নিয়ে আগেই বলেছি। আমি ভাবছি না এসব নিয়ে। আমার মাথায় এখন একটিই চিন্তা- কীভাবে আমি কামব্যাক করতে পারি। আর কীভাবে পুনরায় আগের জায়গায় যাব। সাসপেনশনের আগে যে পারফরম্যান্স ছিল, ওই জায়গায় ফিরতে চাই।আর আগের অবস্থানে আসার পর আমি আরও ইমপ্রুভ করার চেষ্টা করব।’
২০২৩ বিশ্বকাপ মোটেও সহজ হবে না। ১২টি টেস্ট খেলুড়ে দেশ ছাড়াও নেদারল্যান্ডস বাছাইয়ের লড়াইয়ে রয়েছে। আগামী দুই বছরে ২৪টি ওয়ানডে ম্যাচ রয়েছে প্রত্যেকের। র্যাংকিংয়ে বা পয়েন্ট টেবিলে (২৪ ওয়ানডের পর) আটের মধ্যে থাকলে সরাসরি বিশ্বকাপে যাবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে খেলতে আসবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, শ্রীলংকা, ইংল্যান্ড ও আফগানিস্তান। তবে দেশের বাইরে বাংলাদেশের সিরিজ রয়েছে নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, জিম্বাবুয়ে ও আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে। ২৪০ পয়েন্টের খেলা প্রত্যেক দলের। প্রতিটি জয়ের জন্য ১০ পয়েন্ট রয়েছে। আর সেরা আটে না থাকলে বাছাই খেলে বিশ্বকাপের সেরা দশে জায়গা করে নিতে হবে। আট দল সরাসরি বিশ্বকাপ খেলবে। নবম ও দশম দলটি পাওয়া যাবে বাছাইপর্বের মাধ্যমে।
২০২৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশের তিনটি বিশ্বকাপ। আর ওয়ানডে বিশ্বকাপ হবে ভারতে। স্বাগতিক ভারত ছাড়া আর সাত দেশ সরাসরি বিশ্বকাপে যাবে। মোট ১০টি দেশ বিশ্বকাপে লড়াই করবে। চারটি দেশে ও চারটি অ্যাওয়ে সিরিজ খেলবে সবাই। প্রতিটি ম্যাচ জয়ের জন্য ১০ পয়েন্ট। আর টাই বা নো রেজাল্ট এলে ৫ পয়েন্ট পাওয়া যাবে। তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ। সে হিসেবে ২৪ ওয়ানডে ম্যাচ হাতে রয়েছে। করোনার জন্য দীর্ঘদিন ধরেই খেলা বন্ধ ছিল। সে জন্য এই সুপার লিগের পরিধি বাড়বে। ২০২৩ বিশ্বকাপে সাকিবের বয়স হবে ৩৬। ২০২৭ ওয়ানডে বিশ্বকাপে তিনি খেলবেন কিনা সেটি নিয়ে কথা থাকতে পারে। কারণ তখন তার বয়স হবে ৪০। ২০২১ ও ২০২২ সালে দুটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ রয়েছে। সাকিবের টানা তিন বছরে তিনটি বিশ্বকাপ। ২০২১ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ভারতে। আর পরের বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হবে অস্ট্রেলিয়ায়। বাংলাদেশের ওয়ানডে বিশ্বকাপ ২০২৩-এর যাত্রা শুরু হচ্ছে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজ দিয়ে।
সাকিব ঘরোয়া ক্রিকেটে নিজের স্কিলকে ডেভেলপ করছেন। যুক্তরাষ্ট্রে এই নিষেধাজ্ঞার এক বছর নিজেকে সময় দিয়েছেন। পুড়ে পুড়ে প্রতিটি ঘটনা ও ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে হয়েছেন আরও পরিণত। অধিনায়কত্ব নিয়ে তিনি ভাবছেন না। ইংল্যান্ডের ২০১৯ বিশ্বকাপকে বেজ ভাবছেন। আট ম্যাচে ৬০৬ রান ছিল। তৃতীয় সর্বোচ্চ রান স্কোরার। দুটি সেঞ্চুরি ও পাঁচটি ফিফটিই বলে দেয় কী দুর্দান্ত কেটেছে তার বিশ্বকাপ। বল হাতে ১১ উইকেট শিকার করেন এই অলরাউন্ডার। আগামী তিনটি বিশ্বকাপ নিয়েও সাকিব কথা বলেছেন। কেমন দল হবে বিশ্বকাপে বা কী ভাবছেন- এর জবাবে সাকিব বলেন, ‘নতুন বা পুরনো খেলোয়াড় থাকবে কিনা এটি ব্যাপার নয়। যারা পারফরম করবে তারাই দলে প্রাধান্য পাবে। যারা জায়গা ডিজার্ভ করে, তারাই যেন সুযোগ পায়। সেটিই আমি মনে করি। আর অবশ্যই আমাদের যেন একটি ধারণা থাকে। কেমন দল হবে। আমাদের কী করতে হবে। ওয়ানডে বিশ্বকাপ যখন হবে, তখন কি টিম নিয়ে যাব। কোথায় শক্তি ও দুর্বলতা সেটি ধরতে হবে। তা হলে উন্নতি করার জায়গা থাকবে।
বাংলাদেশের ওয়ানডে লড়াই শুরু হবে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে দিয়ে। তারা যদি জানুয়ারিতে আসতে পারে, তা হলে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ মিশন শুরু হবে। সবাই আশা করছেন সাকিব এই সিরিজে ফিরবেন। সাকিব বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা। এ ছাড়া বাংলাদেশ দলে নতুন ক্রিকেটাররাও ভালো করছেন। সব মিলিয়ে খুবই রোমাঞ্চকর বিশ্বকাপ দেখা যেতে পারে সেটি আশা করাই যায়। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে করোনার পর দুটি লিগ করেছে। বিসিবি কাপ হয়ে গেছে। সেখানে কিছু ভালো খেলোয়াড় পাওয়া গেছে। আবার বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপেও নতুনদের পারফরম্যান্স দেখা যাচ্ছে। সব মিলিয়ে অভিজ্ঞদের সঙ্গে নতুন ক্রিকেটারদের একটি সেটআপ হয়েই যাবে আগামীতে।
সাকিবকে ‘ক্রিকেটের ম্যারাডোনা’ বললেও অত্যুক্তি হবে না। উনি দেশে আসার পরেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনেক রকম ঝামেলায় পড়ে যান। মিডিয়া ফোকাস এতটাই বেশি যে, বেনাপোল দিয়ে ভারত কীভাবে গেলেন সেটিও নিউজ হচ্ছে। আর সেখানে ভুল বোঝাবুঝি হয় এক সেলফি শিকারির সঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসার পরের দিন একটি দোকান উদ্বোধন করতে গিয়ে বিপাকে পড়েন। আবার কলকাতায় একটি দাওয়াতেও তাকে নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় ফেসবুক লাইভে এসে ক্ষমাপ্রার্থনা করেন। এই সাকিব ক্ষমা চাইবে এটিই অপ্রত্যাশিত ছিল। উনার ফিটনেস টেস্টের স্কোর কত এটি নিয়ে আবার আরেক ধাঁধা।
সাকিব নিজে থেকে কিছুই বলেননি। তবে আশপাশের অনেক দায়িত্বশীলরাই তার বিপদে পড়ার কারণ হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপে তিনি খুলনার হয়ে খেলছেন। উইকেট শিকার দিয়ে শুরু হয়েছে বাংলাদেশের সেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের। সাকিব মূলত যে কথাটি বলেছেন, সেটি হচ্ছে- তিনি আগের অবস্থানে ফিরতে চান। আর সেখান থেকেই মিশন শুরু হবে। বাংলাদেশও ২০১৯ বিশ্বকাপের সাকিবকে আবার দেখতে চায়। যে পরিমাণ ক্রিকেট সিডিউল। সে ক্ষেত্রে শরীর হয়তো ২০২৭ বিশ্বকাপ পর্যন্ত সাকিবকে সায় দেবে না। সে জন্য ২০২৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখবে। ২০০০ সালে বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়েছে। ১৯৯৯ সালে প্রথম বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ। স্বপ্ন তো দেখতেই পারে। স্বপ্ন দেখা অপরাধ তো নয়। আর সাকিবকে সেই ১৯৮৬-এর দিয়েগো ম্যারাডোনা হতে হবে। যিনি শক্ত কাঁধে আর্জেন্টিনার স্বপ্ন নিয়ে ছুটেছিলেন। আর বজ্রকঠিন জার্মানির হাত থেকে ছিনিয়ে এনেছিলেন বিশ্বকাপ। ভারতের কন্ডিশন কি খুব অচেনা আমাদের? মনের গহিনে লুকিয়ে থাকা প্রশ্নের উত্তরটির জন্য ১৭ কোটির অপেক্ষা।