তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের শেষপ্রান্তে এসে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। শুধু তরুণরাই নয়, বিভিন্ন বয়সীর কাছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে এ মাধ্যমটির। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দ্বারা পৃথিবীর যে কোনো স্থানে ঘটে যাওয়া ঘটনা আমরা সঙ্গে সঙ্গে সরাসরি দেখতে পাচ্ছি। বর্তমানে এটি তথ্য আদান-প্রদানের অন্য যে কোনো মাধ্যমের তুলনায় অধিক শক্তিশালী ভূমিকা পালন করছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মোট ব্যবহারকারীর মধ্যে তরুণদের সংখ্যাই বেশি। এতে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছে। আর ব্যবহারকারীরা তা দেখার পাশাপাশি তাদের মতামত দিতে পারছেন। এখন সময় এসেছে জনপ্রিয় এ মাধ্যমটিকে আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় কতটুকু উপযোগী করে ব্যবহার করা যায়, ওই বিষয়ে ভাবার।
আমরা যদি ধরে নিই, কোনো শিক্ষার্থী স্কুলে না গিয়ে শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সব শিক্ষা গ্রহণ করবে, তা হলে তা সম্ভব কি? অথবা কোনো শিক্ষার্থী প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করছে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও তার সঙ্গে আছে, তা হলে সে এই মাধ্যম থেকে আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় কতটুকু সহায়তা পাবে? আর যদি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিকল্প হিসেবে এই মাধ্যমকে ব্যবহার করা যায়, তা হলে সে এখান থেকে কতটুকু উপকৃত হবে?
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কী?
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হচ্ছে ইন্টারনেটভিত্তিক অ্যাপ্লিকেশনগুলোর একটি গ্রুপ। এটি ওয়েব ২.০-এর আদর্শিক ও প্রযুক্তিগত মূলের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিতÑ যাতে ব্যবহারকারীর তৈরি কোনো বিষয়বস্তুকে আদান-প্রদান এবং নতুন কিছু তৈরি করার অনুমতি দেয়। ২০১৭ সালে হানসেনসহ কয়েক তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের একটি আধুনিক সংজ্ঞা দিয়েছেন। সেখানে তারা বলেছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হচ্ছে একগুচ্ছ অনলাইন অ্যাপস ও টুলসের সমষ্টি। এটি চূড়ান্তভাবে একটি স্বগোক্তিকে কথোপকথনে রূপান্তর এবং জ্ঞানবিনিময়ের ক্ষেত্র তৈরি ও সহজ করার মাধ্যমে ডিজিটাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের মধ্যে সামাজিক মিথস্ক্রিয়া এবং পারস্পরিক যোগাযোগের পথ বাতলে দেয়। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হচ্ছে ইন্টারনেটভিত্তিক অ্যাপস ও টুলসের সমন্বয়। এটি ওয়েব ২.০-এর আদর্শ ও প্রযুক্তিগত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। যোগাযোগ ও মিথস্ক্রিয়মূলক কাঠামো তৈরিতে সহায়তাই এর কাজ। এখানে ব্যবহারকারীরা তাদের তৈরি করা কনটেন্ট বিনিময় করে থাকে।
এখন আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যবহারকারীদের তৈরি করা বিষয়বস্তুর সুবিধাদি বিনিময়ে আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে। এখানে সমস্যা হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রত্যেক ব্যবহারকারীই কনটেন্ট তৈরি করছেন এবং তা শেয়ার করছেন। এটি অনেক সময় খুবই বিপজ্জনক। যেমনটি আমরা ২০১২ সালে কক্সবাজারের রামুতে দেখেছি। সম্প্রতি ভোলার বোরহানউদ্দিনে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখছি। কারণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা কোনো নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নেই। এখানে কোনো যাচাই-বাছাইও নেই। ব্যবহারকারীরা নিজেরাই কনটেন্ট তৈরি করছেন এবং তা শেয়ার করছেন। এই কনটেন্ট সঙ্গে সঙ্গে থামানো অনেক সময় প্রশাসনের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। কোনো তথ্য পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে প্রতিক্রিয়া, তা নিয়ন্ত্রণে আমরা এখনো অভ্যস্ত হইনি। তথ্যটি গুজব, নাকি সত্যÑ তা যাচাই করার ক্ষমতা আমরা এখনো অর্জন করতে পারিনি। তথ্য পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই না করে আমরা তা গ্রহণ করছি নিজের মতো করে। কারণ সমাজে বিভিন্ন মানসিকতার মানুষ বসবাস করে। কোনো গোষ্ঠী তথ্যটিকে তার মতো করে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। এ জন্য সমাজ প্রস্তুত থাকে না। তবে এ মাধ্যমটি অনেক সময় খুবই উপকারী ভূমিকাও পালন করে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো কী কী?
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে আমরা বৃহৎ শ্রেণীকরণের মাধ্যমে ভাগ করতে পারি। অনেক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ব্লগ (যেখানে একজন ব্যবহারকারী গল্পকাহিনি, নিজের জীবনকাহিনি কিংবা যে কোনো ঘটনা লিখতে পারেন), উইকিস (উইকিপিডিয়া), সামাজিক নেটওয়ার্ক সাইট (ফেসবুক, লিংকডইন ইত্যাদি), স্ট্যাটাস আপডেট সাইট (টুইটার), সোশ্যাল বুকমার্কিং (রেডডিট, স্টাম্বলআপন, ডিগ ইত্যাদি), ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম, রিসার্চগেট ইত্যাদি। সামাজিক সংযোগগুলো আমাদের জীবনের অনেক দিককে প্রভাবিত করছে, সেহেতু এগুলোকে আনুষ্ঠানিক শিখন-শিক্ষণে প্রয়োগের দিকে ধাবিত হচ্ছে বিশ্ব। অনেকে বলছেন, এ মাধ্যমটি শিখন-শিক্ষণে প্রয়োগ করাটা ভালো হবে। আবার অনেকে বলছেন, ব্যবহার করার আগে সতর্কতা অর্জন করা জরুরি।
শিখন-শিক্ষণ কী?
শিখন-শিক্ষণ হচ্ছে একটি সামাজিক প্রক্রিয়া। এটি কঠিন ও সমাজ বাস্তবতার সঙ্গে জড়িত। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিতে এটি সবচেয়ে ভালো কাজ করে। এখানে শিক্ষার্থীদের উচিত শিক্ষকদের সম্মান ও তাদের প্রতি দায়বদ্ধতা অনুভব করা। শিক্ষকদের উচিত শিক্ষার্থীদের সহায়তা ও অনুপ্রাণিত করা এবং তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা। কিন্তু আমরা যদি ইতিহাস দেখি, তা হলে দেখতে পাই ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে শিক্ষকের বিকল্প খোঁজার চেষ্টা করা হচ্ছে অথবা কোনো ভালো কনটেন্ট তৈরি করে সহজ মাধ্যম হিসেবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহারের চেষ্টা করা হচ্ছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে শিক্ষার ব্যয় কমানো। এখনো অনেকে শুধু শিক্ষার্থীদের রেখে কীভাবে শিখন-শিক্ষণ পরিচালনা করা যায়, ওই চেষ্টা করছেন। তাদের ধারণা, ভালো ভালো শিক্ষকের লেকচার ভিডিও করে বা অনলাইনে দিয়ে দিলেই শিখন-শিক্ষণ হবে অথবা ভালো কনটেন্ট দিয়ে পারলে শিখন-শিক্ষণ হবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সরাসরি শিক্ষকের উপস্থিতি না থাকলে শিখন-শিক্ষণ সেভাবে হবে না। এ কারণেই আমরা অনেক সময় বলতে চাইÑ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় ব্যবহৃত হবে, নাকি আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সহায়ক হিসেবে ব্যবহৃত হবে? আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করা হলে শিখন-শিক্ষণটা সেভাবে হবে না। কারণ শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা পরিচালিত হলে সেখানে শিক্ষকের উপস্থিতি থাকে না আর শিক্ষকের উপস্থিতি না থাকলে শিখন-শিক্ষণ সেভাবে হয় না। লেকচার ভিডিও করে বা অনলাইনে দিয়ে দিলে হয়তো শিক্ষার্থী সেখান থেকে শিখতে পারবে। তবে ভালোভাবে শিখন-শিক্ষণটা হবে না। কেননা ভিডিও বা শিক্ষা যেহেতু একটি সামাজিক বিষয়Ñ সেহেতু এখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মিথস্ক্রিয়া, শিক্ষার্থীর সঙ্গে শিক্ষার্থীর মিথস্ক্রিয়া, শিক্ষার্থী এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের মিথস্ক্রিয়ার প্রয়োজন। আর যদি তা করা সম্ভব না হয়, তা হলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রদান করা সহজ হবে না। তবে অবশ্যই আমরা এ মাধ্যমটিকে দক্ষতা উন্নয়নে ব্যবহার করতে পারি।
আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় একদিক থেকে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মধ্যে, অন্যদিক থেকে শিক্ষার্থী এবং দৈনন্দিন জীবনের ইভেন্টগুলোর মধ্যে প্রতিদিনের সামাজিক মিথস্ক্রিয়া প্রয়োজন। যখন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে একটা সামাজিক বন্ধন থাকবে, তখনই সত্যিকারের শিখন-শিক্ষণ হবে। আমাদের ক্লাসরুম এবং বাস্তব বিশ্বের মধ্যে যে ফারাক রয়েছে, এর সেতুবন্ধন তৈরি করতে হবে। শিখন-শিক্ষণের একটি তাৎপর্য আছে। তা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কিত। এটি বাস্তব বিশ্বের সিস্টেমে তৈরি করা হয়েছে। আপনি যখন মানুষের সঙ্গে কোনো কিছুর বিনিময় করতে যাবেন, তখন তার প্রতি আপনার আস্থা ও বিশ্বাস থাকতে হবে। সে যে তথ্যটি আপনাকে দিচ্ছে, আপনি ধরে নিচ্ছেন তা সত্য। কিন্তু অনলাইনে তা ঘটার সম্ভাবনা কম। অনলাইনে একজন মানুষ যখন আপনাকে কোনো তথ্য দিল, তখন আপনি জানেন না তথ্যটি সত্য কিনা। কারণ যখন কোনো ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো তথ্য দিচ্ছে, তখন সেটি তার নিজের তৈরি করা কনটেন্ট। যেহেতু এ মাধ্যমটিতে তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের সুযোগ নেই, সেহেতু ওই তথ্যটি সত্য কিনাÑ বাকিরা তা জানতে পারছেস না। এ জন্য তথ্যদাতার প্রতি ব্যবহারকারীদের আস্থা থাকে না। কেননা তারা তাকে চেনেন না।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নেতিবাচক দিক
যেহেতু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সবার জন্য উন্মুক্ত এবং এখানে কোনো যাচাই-বাছাই নেই, সেহেতু এ মাধ্যমে অনুপযুক্ত ছবি, সংবাদ ও ঘটনা সরবরাহ করা হতে পারে। তাই এই মাধ্যমে হতাশা, গুজব, ব্ল্যাকমেইলিং, ভুয়া পরিচয়, আসক্তি ব্যাধির মতো ঝুঁকিসহ অন্যান্য ঝুঁকি রয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ইতিবাচক দিক
এ মাধ্যমটির রয়েছে বেশকিছু ইতিবাচক দিক। এ মাধ্যম ব্যবহারকারীর আনেকেই মনে করে থাকেন, তার অর্জিত জ্ঞান তিনি অন্যদের সঙ্গে ভাগাভাগি করবেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো শিক্ষার্থী শিখবে। তবে সে যদি আরেকটু অতিরিক্ত শিখতে বা জানতে চায়, তা হলে সেটিও সম্ভব। কারণ সে যে কোনো বিষয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাগাভাগি করলে তার ফলাবর্তন পাবে। সেখানে সহপাঠী ও বিশেষজ্ঞদের মতামত নিতে পারবে। শিক্ষক ও সহপাঠীদের কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া গ্রহণের ক্ষমতা এবং আদান-প্রদান হওয়া বার্তাগুলোর প্রতিফলনের সুযোগ থাকে। চিন্তাভাবনার বহিঃপ্রকাশ, আলোচনা করা ও অন্যের আইডিয়াকে চ্যালেঞ্জ করা এবং প্রদত্ত সমস্যার একটি গ্রুপ সমাধানের জন্য একসঙ্গে কাজ যায়। সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার দক্ষতা বিকাশ করার পাশাপাশি নিজের প্রতিফলিত, জ্ঞান ও অর্থের সহনির্মাণ করার দক্ষতা অর্জন করা যায়।
বর্তমান বাস্তবতায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য একটি অংশ। এখন এ মাধ্যমটিকে আর শিক্ষা থেকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব নয়। বর্তমানে আমাদের প্রধান কাজ হওয়া উচিত শিক্ষায় এটিকে আমরা কতভাবে কাজে লাগাতে পারি, এর নতুন পথের সন্ধান করা। কারণ আমাদের তরুণ প্রজন্ম এ মাধ্যমে এতটাই আসক্ত যে, তারা এর বাইরে চিন্তাও করতে পারছে না। এ মাধ্যমটিকে বাদ দিয়ে অন্য কিছু চিন্তা করাও আমাদের উচিত হবে না। কিন্তু ভুল হবেÑ যদি আমরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার বিকল্প হিসেবে ভাবতে থাকি। আমরা যদি ভাবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম শিক্ষক, বাস্তব বন্ধুত্ব ও বাস্তব যোগাযোগের বিকল্পÑ তা হলে বিরাট ভুলই হবে না, জাতি হিসেবে আমাদের সর্বনাশের পথ রচনার জন্য যথেষ্ট মূল্য দিতে হবে।
অধ্যাপক ড. মুনাজ আহমেদ নূর : উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ