এক দিকে রফতানি আয়ের বিশাল ধাক্কা, অন্য দিকে রাজস্ব আদায়ে শ্লথগতি, এই দুয়ে মিলে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীলতাকে অনেকটা ঝুঁকির মুখে ফেলে দিয়েছে। এতে করে উদ্বিগ্ন সরকারও। কারণ সরকারের ব্যয় নির্বাহের জন্য রাজস্ব আয় বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।
রাজস্ব আদায় বাড়ানোর দায়িত্বটি যার হাতে ন্যস্ত সেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বলেছে, বর্তমানে রাজস্ব আদায় কমলেও আগামীতে তা বাড়বে। এর পেছনে এনবিআরের যুক্তি হচ্ছে, আগামী ডিসেম্বরে হাজারখানেক ‘ইএফডি’ (ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস) মেশিন বসানোর কাজ শেষ হবে। আর এতে করে কর ফাঁকির পরিমাণও কমবে। শুধু তাই নয়, অতীতের প্রবণতা অনুযায়ী বছরের বাদবাকি সময়ে রাজস্ব আয় এমনিতে বেড়ে যাবে। নতুন করে এ বছরই অনেকে করের আওতায় নিয়ে আসা হবে।
এর একটি ইতিবাচক ফল দেখা যাবে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে। তবে রাজস্ব আয় কমে যাওয়ার পেছনে বিভিন্ন খাতে নতুন করে কর রেয়াত দেয়াকে দায়ী করেছে এনবিআর।
অন্য দিকে, সামষ্টিক অর্থনীতি চাপের কারণে সরকার আগামী অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি চলতি অর্থবছরের মতো প্রায় একই রাখা হচ্ছে। আগামী ২০২০-২০২১ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রাথমিকভাবে প্রাক্কলন করা হয়েছে ৮ দশমিক ২৩ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে যা রয়েছে আট দশমিক ২ শতাংশ। অন্য দিকে মূল্যস্ফীতির হার ধরা হয়েছে সাড়ে ৫ শতাংশ।
গতকাল বিকেলে অর্থ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত আর্থিক, মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হারসংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের বৈঠকে এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছেন। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে বৈঠকে বাণিজ্য মন্ত্রী টিপু মুন্সি, পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সিনিয়র সচিব ড. শামসুল আলম, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবীর, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মো: মোশাররফ হোসেন ভূঁইঞা, অর্থসচিব আবদুর রউফ তালুকদারসহ অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। গতকাল বাজেট ব্যবস্থাপনা ও সম্পদ কমিটির বৈঠকটিও অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বৈঠক শেষে সন্ধ্যায় সাংবাদিকরা কাউন্সিলে কী বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে সে বিষয়ে অর্থমন্ত্রীকে প্রশ্ন করলেও তিনি এ বিষয়ে কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তবে বৈঠকে উপস্থিত একাধিক সূত্র জানায়, বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, রফতানি প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমলেও আগামীতে তা বাড়বে। কারণ কিছু দিন আগে তৈরি পোশাক খাতে ১ শতাংশ বাড়তি প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। এর একটি প্রভাব রফতানি আয়ে দেখতে পাওয়া যাবে।
বৈঠকে অর্থসচিব আব্দুর রউফ তালুকদার চলতি অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়ন ও আগামী অর্থবছরের বাজেটে প্রাক্কলিত একটি হিসাব তুলে ধরেন। আগামী অর্থবছরের ভর্তুকির একটি প্রাক্কলিত হিসাবও তুলে ধরা হয় বলে জানা যায়। বৈঠকে উপস্থিত কৃষি সচিব আগামী অর্থবছরে সারে ভর্তুকি বাড়ানোর সুপারিশ করে বলেন, আগামী অর্থবছরে ডিএপি সারে ভর্তুকি বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে। এ বিষয়ে তাকে লিখিত আকারে প্রস্তাব দেয়ার জন্য বলা হয়।
এদিকে সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে রাজস্ব আদায় বেড়েছে মাত্র ২ দশমিক ৬২ শতাংশ। নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় কম ১৭ শতাংশের মতো। তিন মাসে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৪৭ হাজার ৩৮৮ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৪ হাজার ৯০৬ কোটি টাকা কম। তবে গতকালের বৈঠকে এনবিআর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) সময়ে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৬৭ হাজার কোটি টাকা। একইভাবে চলতি (২০১৯-২০) অর্থবছরের চতুর্থ মাস অক্টোবর শেষে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রফতানি আয় কমেছে ১১ দশমিক ২১ শতাংশ। অর্জিত আয় আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৬ দশমকি ৮২ শতাংশ কম হয়েছে।
ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) সব ধরনের পণ্য রফতানিতে বৈদেশিক মুদ্রার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় এক হাজার ৪৩২ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলার। কিন্তু এ সময়ে আয় হয়েছে এক হাজার ২৭২ কোটি ১২ লাখ ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১১ দশমিক ২১ শতাংশ কম। একই সাথে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় অর্জিত এ হার ৬ দশমিক ৮২ শতাংশ কম। একক মাস হিসেবে চলতি বছরের অক্টোবরে রফতানি আয় হয়েছে ৩০৭ কোটি ৩২ লাখ ডলার, যা লক্ষ্য ছিল ৩৪৮ কোটি ১০ লাখ ডলার। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অক্টোবরে রফতানি আয় কমেছে ১১ দশমিক ৭১ শতাংশ।
চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) আমদানি ব্যয় ২ দশমিক ৫৫ শতাংশ ঋণাত্মক হয়েছে। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে আমদানি ব্যয় ২ দশমিক ৫৫ শতাংশ কমেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, এই তিন মাসে শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনী যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি) আমদানি কমেছে ৮ শতাংশ। জ্বালনি তেল আমদানি কমেছে ১৪ শতাংশ। আর শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে কলকারখানা স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনী যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি) আমদানি কমেছে ৮ শতাংশ। শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে ২০ শতাংশের মতো।
সেপ্টেম্বর শেষে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশে নেমে এসেছে। গত অর্থবছর শেষে যা ছিল ১১ দশমিক ৩২ শতাংশ। এদিকে, রাজস্ব আয় কমে যাওয়ার কারণে সরকারের ব্যয় নির্বাহের জন্য ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর ভরসা করা হচ্ছে। অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে ব্যাংক থেকেই ঋণ নেয়া হয়েছে ২৮ হাজার কোটি টাকারও বেশি, যা পুরো অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার ৫৭ শতাংশ।