শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৪২ পূর্বাহ্ন

রেমিট্যান্সের সোনা ফলে ১৭৪ দেশে

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : বুধবার, ৩১ মার্চ, ২০২১
  • ১৫৬ বার

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালের ২০ জানুয়ারি শ্রম ও জনশক্তি মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। একই সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও কর্মী প্রেরণ বিষয়ে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সমঝোতা সৃষ্টি হয়। তারই ধারাবাহিকতায় সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় বাংলাদেশি কর্মী যাওয়া শুরু। শ্রম ও জনশক্তি মন্ত্রণালয়ের কাজের পরিধি বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বাংলাদেশে ২০০১ সালের ২০ ডিসেম্বর ‘প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়’ নামে পৃথক মন্ত্রণালয় গঠন করা হয়। এ মন্ত্রণালয় গঠনের উদ্দেশ্য হলো নিরাপদ অভিবাসন, প্রবাসী ও বিদেশ গমনেচ্ছু কর্মীদের কল্যাণ নিশ্চিতকরণ, দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টি এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সম্প্রসারণ। এ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২৭ দেশে ২৯টি শ্রমকল্যাণ উইং শ্রমবাজার সম্প্রসারণ, সুসংহতকরণসহ প্রবাসীদের কল্যাণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করছে। রেমিট্যান্সের প্রবাহ বৃদ্ধি এবং দেশের সব অঞ্চল থেকে কর্মীদের বিদেশে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে সব অভিবাসী কর্মীর কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য মন্ত্রণালয় নিরলসভাবে কাজ করছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো ১৯৭৬ সালে তৎকালীন ‘জনশক্তি উন্নয়ন ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের’ সংযুক্ত বিভাগ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে এর কর্মযাত্রা শুরু হয়। বৈদেশিক কর্মসংস্থানে অভিবাসী কর্মী নিয়োগ ও প্রেরণের লক্ষ্যে এ ব্যুরো প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে বিএমইটি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনে অভিবাসন ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানে নিয়োগ প্রক্রিয়া তত্ত্বাবধান, অভিবাসী কর্মীদের অধিকার সংরক্ষণ ও দক্ষতা, প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের অধিকতর সুযোগ সৃষ্টি করে কর্মোপযোগী জনগোষ্ঠীকে যথাযথ কাজে লাগানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। অভিবাসী কর্মী, চাকরি অন্বেষী ও সংশ্লিষ্ট অংশীজনের জন্য প্রয়োজনীয় সব সেবাপ্রদানকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিএমইটি ব্যাপক অবদান রেখে চলেছে।

ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তথ্য মতে, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ৬-৭ লাখ মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। এ প্রবাসীরা প্রতিবছর প্রায় ১৮ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠায়- বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা। এটি দেশের মোট রপ্তানি আয়ের অর্ধেকের বেশি। এত বিপুলসংখ্যক মানুষ দিন-রাত পরিশ্র ম করে শুধু দেশের মুদ্রার রিজার্ভ স্ফীতিতে অবদান ও পরিবারের জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থাই করেননি বরং জীবনযাত্রার মান, কর্মসংস্থান, কাঠামোগত উন্নয়ন, শিক্ষা, চিকিৎসা ও ব্যাংকসহ বিভিন্ন খাতে রেখে আসছেন অভাবনীয় অবদান।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, বর্তমানে ১৭৪টি দেশে বাংলাদেশ শ্রমিক প্রেরণ করে আসছে, যা প্রায় ১ কোটি ২০ লাখের বেশি। যাদের তিন-চতুর্থাংশ নিয়োজিত রয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, রেমিট্যান্স আয়ের তিন ভাগের দুই ভাগই আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে।

জাতিসংঘের ২০১৯ সালের তথ্যমতে, বিশ্বে প্রায় ২৭২ মিলিয়ন মানুষ অভিবাসী হিসেবে রয়েছেন, যা বিশ্বের জনসংখ্যার ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। কাজের জন্য বা অন্য কোনো প্রয়োজনে নিজ দেশে বাস না করে অন্য দেশে বাস করছেন এবং উভয় দেশেরই আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন।

প্রবাসী আয়ের পরিমাণের দিক থেকে শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অষ্টম। প্রথম স্থানে আছে ভারত (৭৬ বিলিয়ন ডলার), দ্বিতীয় স্থানে চীন (৬০ বিলিয়ন ডলার), তৃতীয় স্থানে মেক্সিকো (৪১ বিলিয়ন ডলার)।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বিভিন্ন দেশে থাকা কোটি বাংলাদেশির পাঠানো অর্থ বা রেমিট্যান্স। দেশের জিডিপিতে এই রেমিট্যান্সের অবদান ১২ শতাংশের মতো।

বাজেট আলোচনায় অর্থমন্ত্রী বলেন, শ্রমবাজারে করোনার ব্যাপক প্রাদুর্ভাবজনিত কারণে এবং বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাসে আগামী অর্থবছরে প্রবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধি শ্লথ হতে পারে। এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আগামী অর্থবছরেও রেমিট্যান্সে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা দেওয়া হবে। বর্তমানে বিশ্বের ১৭৪টি দেশে ১ কোটি ২০ লাখের বেশি অভিবাসী কর্মী কর্মরত রয়েছে। এর মধ্যে গত ১০ বছরেই কর্মসংস্থান হয়েছে ৬৬ লাখ ৩৩ হাজার।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, কোভিড ১৯ মহামারীর কারণে বিশ্বব্যাপী প্রবাসী আয় নিম্নমুখী হলেও বাংলাদেশি প্রবাসীরা এ মহামারীর মধ্যেই রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে গড়েছে নতুন রেকর্ড। ২০১৯ সালে যেখানে দেশে মোট প্রবাসী আয় এসেছিল ১ লাখ ৫৫ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকা, সেখানে ২০২০ সালে এসেছে ১ লাখ ৮৪ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে ৬৮৯ বিলিয়ন ইউএস ডলার প্রবাসী আয় হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জাতীয় আয়ে যুক্ত হয়েছে। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে প্রায় ১৭ বিলিয়ন ইউএস ডলার প্রবাসী আয় বাংলাদেশে এসেছে এবং মোট প্রায় ৬ লাখ ৪ হাজার মানুষের বিদেশে কর্মসংস্থান হয়েছে। এদের মধ্যে নারী ৯৭ হাজার ৪৩০ জন।

যেসব দেশে শ্রমিক বেশি যায়- এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরব। এর পরই রয়েছে ওমান, কাতার, বাহরাইনের মতো দেশ। জর্ডান, সিঙ্গাপুর, রোমানিয়া ইত্যাদি দেশেও অল্প কিছু করে কর্মী যাচ্ছেন। কুয়েত, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালদ্বীপ এক সময় বাংলাদেশের জন্য বড় শ্রমবাজার ছিল। এখনো এসব দেশে বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে অনেক বাংলাদেশি কাজ করেন। কিন্তু এসব দেশে বৈধভাবে এখন কর্মীরা যেতে পারছেন না। বৈধভাবে পোল্যান্ড, রোমানিয়া, বলিভিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকরা সম্প্রতি যেতে শুরু করেছেন।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন বলেন, স্বাধীনতার পরে ভঙ্গুর অর্থনীতি আজ এ পর্যন্ত আসার পেছনে প্রবাসী আয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে আজ ৫০ বছরে শ্রমবাজার অনেক বিস্তৃত হয়েছে। শুরুতে গুটি কয়েক দেশে কর্মী গেলেও বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ১৭৪টি দেশে কমসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। এ অল্প সময়ে এত বিস্তৃত হওয়া কেবল বাংলাদেশের পক্ষেই সম্ভব হয়েছে। তবে এখন প্রয়োজন দক্ষ কর্মী। বিশ্বে দক্ষ কর্মীর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সরকার দক্ষ কর্মী তৈরি করতে নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে পারলে আগামীতে প্রবাসী আয় অনেক অনেক গুণ বেড়ে যাবে বলেও মনে করেন তিনি।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান আমাদের সময়কে বলেন, দেশ স্বাধীনের পর পর মাত্র ৫ থেকে ৬ হাজার কর্মী বিদেশে কাজের জন্য যেত। সেখান থেকে আজ ৫০ বছরে প্রতিবছর প্রায় ৮ থেকে ১০ লাখ কর্মী কাজের জন্য বিদেশে যান। এটা বিস্ময়কর অগ্রগতি। তিনি বলেন, হাঁটি হাঁটি পা পা করে অভিবাসন খাত এখন বিশাল কর্মযজ্ঞ। দেশের কোন ধরনের সুযোগ সুবিধা ভোগ না করেই দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। তিনি বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এক কোটির বেশি প্রবাসী কর্মী রয়েছেন, যারা বিভিন্ন সময়ে উন্নত জীবনের আশায় দেশ ছেড়েছেন। প্রতিবছর ৭ লাখের বেশি কর্মী দেশের বাইরে কাজ করতে যান, যাদের বেশিরভাগই অদক্ষ বা আধা দক্ষ। বিশ্ববাজারের চাহিদা মেটাতে এখন দক্ষ কর্মী তৈরি করতে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। দক্ষ কর্মী তৈরি করতে সরকারের পাশাপাশি বায়রাও কাজ করছে।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com