দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ জঙ্গি হামলা হলি আর্টিজান মামলায় ৭ আসামির ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত। মামলার এক আসামি বেকসুর খালাস পেয়েছেন। এই রায়ে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে বলে মন্তব্য করেছেন আদালত। গতকাল দুপুর ১২টার দিকে ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমান আলোচিত এই মামলার রায় ঘোষণা করেন। এজাহারভূক্ত ৮ আসামির উপস্থিতিতে এই রায় ঘোষণা করা হয়। রায়কে ঘিরে মঙ্গলবার থেকে সারা দেশে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। রায় ঘোষণার সময় আদালত এলাকায় ছিল নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা। ফাঁসির দ-প্রাপ্ত ৭ আসামিরা হলো, মো. জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী (৩২), রাকিবুল হাসান ওরফে রিগেন (২২), মো. আবদুস সবুর খান (৩৩), মো. হাদিসুর রহমান, মো. আসলাম হোসেন র্যাশ (২০), শরিফুল ইসলাম খালেদ (২৫) এবং মামুনুর রশীদ রিপন (৩০)। তবে মামলার অপর আসামি মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান (৬০) বেকসুর খালাস পেয়েছেন। ৫১ কার্যদিবস শেষে এ রায় ঘোষণা করা হয়। সন্ত্রাস বিরোধী আইনের ৬(২)(অ) ধারায় এই সাত আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করে সর্বোচ্চ সাজার পাশাপাশি পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদ-ে দ-িত করা হয়।
মৃত্যুদ- ছাড়াও আরো দুটি ধারায় তাদের পৃথক ১০ বছর ও ৬ মাসের সশ্রম কারাদ- দেয়া হয়েছে। সন্ত্রাস বিরোধী আইন ২০০৯ এর ৭ ধারায় আসামি জাহাঙ্গীর হোসেন, আসলাম হোসেন র্যাশ, হাদিসুর রহমান, রাকিবুল হাসান রিগেন, মো. আব্দুস সবুর খান ও শরিফুল ইসলাম খালেদকে দোষী সাব্যস্ত করে দশ বছরের সশ্রম কারাদ- প্রদান করা হয়। অপরদিকে আসামি জাহাঙ্গীর হোসেন, আসলাম হোসেন র্যাশ, আব্দুস সবুর খান, মো. হাদিসুর রহমান, রাকিবুল হাসান রিগেন, শরিফুল ইসলাম খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপনকে সন্ত্রাস বিরোধী আইন ২০০৯ এর ৮/৯ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে ৮ ধারায় প্রত্যেককে ছয় মাসের সশ্রম কারাদ- এবং দশ লাখ টাকা অর্থদ-ে দ-িত করা হয়। অনাদায়ে দুই বছরের সশ্রম কারাদ- প্রদান করা হয়। অন্যদিকে আসামি মামুনুর রশিদ রিপন এর বিরুদ্ধে সন্ত্রাস বিরোধী আইন ২০০৯ এর ৭ ধারার অভিযোগ, আসামি মো. মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস বিরোধী আইন ২০০৯ এর ৬(২)(অ)/৭/৮/৯/১০/১১/১২/১৩ ধারার অভিযোগ এবং আসামি জাহাঙ্গীর হোসেন, আসলাম হোসেন র্যাশ, আব্দুস সবুর খান, মো. হাদিসুর রহমান, রাকিবুল হাসান রিগেন, শরিফুল ইসলাম খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস বিরোধী আইন ২০০৯ এর ১০/১১/১২/১৩ ধারার অভিযোগ হতে বেকসুর খালাস প্রদান করা হয়।
রায় প্রদানের সময় জাপানের একটি প্রতিনিধি দলসহ বিদেশি সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন। রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা। তবে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন চার আসামির আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, আসামি পক্ষের আইনজীবী হিসেবে আইনগতভাবে যা করণীয় তাই করা হবে। রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি পাওয়ার পর আসামিদের সঙ্গে কথা বলে উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে।
এ রায় ন্যয়বিচার নিশ্চিত করবে: সন্ত্রাস বিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান এ রায় ন্যয়বিচার নিশ্চিত করবে বলে রায়ে উল্লেখ করেন। কি কারণে এই ৭ আসামিকে সাজা দেয়া হলো তা রায়ে উল্লেখ করেন তিনি। এতে বলা হয়- বাংলাদেশের তথাকথিত জিহাদ কায়েমের লক্ষ্যে জননিরাপত্তা বিপন্ন এবং আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএসের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য জেএমবি’র একাংশ নিয়ে গঠিত নব্য জেএমবি’র সদস্যরা গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে নারকীয় ও দানবীয় হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। এ হামলার মধ্যে দিয়ে উন্মত্ততা, নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতার জঘন্য বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। নিরপরাধ দেশি-বিদেশি মানুষ যখন রাতের খাবার খেতে হলি আর্টিজান বেকারিতে যায়, তখনই আকস্মিকভাবে তাদের উপর নেমে আসে জঙ্গীবাদের ভয়াল রূপ। তিনি আরো উল্লেখ করেন, জঙ্গী সন্ত্রাসীরা শিশুদের সামনে এ হত্যাকা- চালায়। মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য জঙ্গিরা মৃতদেহগুলোকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপায়। মুহুর্তের মধ্যে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয় হলি আর্টিজান বেকারি। কলঙ্কজনক এ হামলার মাধ্যমে অসামপ্রদায়িক বাংলাদেশের চরিত্র হরণের চেষ্টা করা হয়েছে। এতে বাংলাদেশে বিদেশি নাগরিকরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। বিচারক রায়ে উল্লেখ করেন, এ ঘটনার ফলে শান্তি ও সমপ্রীতির জন্য পরিচিত বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি কিছুটা ক্ষুণ্ন হয়। সেজন্য সাজা প্রদানের ক্ষেত্রে আসামিরা কোন ধরনের অনুকম্পা বা সহানুভূতি পেতে পারে না। এই ক্ষেত্রে আসামিদের সন্ত্রাস বিরোধী আইন ২০০৯ এর ৬(২)(অ) ধারায় প্রদত্ত সর্বোচ্চ সাজা প্রদানই ন্যায় বিচার নিশ্চিত করবে এবং ভাগ্যাহত মানুষের স্বজনরা কিছুটা হলেও শান্তি পাবে।
যেমন ছিল আদালতের পরিবেশ: সকাল ১০টা ১৫ মিনিটে কারাগার থেকে প্রিজনভ্যানে আসামিদের ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে আনা হয়। এ সময় প্রিজনভ্যান থেকে নেমে আঙুল উঁচিয়ে হাসিমুখে আদালতের গারদ খানার প্রবেশ করে আট আসামি। ১১টা ৫০ মিনিটে তাদের মহানগর দায়রা আদালতের সন্ত্রাস বিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের এজলাসে প্রবেশ করানো হয়। এরমধ্যে একজনের পায়ে সমস্যা থাকায় সে ক্র্যাচে ভর করে এজলাসে প্রবেশ করে। এসময় তাদের খুবই আত্মবিশ্বাসী দেখা গেছে। নারকীয় এ হত্যাকা-ের রায় ঘোষণা নিয়ে তাদের চোখেমুখে কোনো ধরনের চিন্তাও দেখা যায়নি। বেলা ঠিক ১২ টায় এজলাসে প্রবেশ করেন ঢাকার সন্ত্রাস বিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান। এরপর তিনি রায় পড়া শুরু করেন। রায় ঘোষণার পর উপস্থিত আট আসামিই উচ্চস্বরে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে চিৎকার করে। এসময় তারা বিভিন্ন মন্তব্যও করে।
রায়ে সন্তোষ প্রকাশ রাষ্ট্রপক্ষের: রায়ে সাত আসামির মৃত্যুদ-ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আবদুল্লাহ আবু। তিনি বলেন, এই রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। তবে একজনের খালাসের বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার পর পর্যালোচনা করে যদি মনে করি, আপিল করার মতো কোনো গ্রাউন্ড আছে, তাহলে অবশ্যই আপিল করবো। তিনি আরো বলেন, আইএসের বরাত দিয়ে তারা হামলার দায় স্বীকার করেছে। কিন্তু এদেশে আইএসের অস্তিত্ব আছে, সেটা তদন্তে আসে নাই। তারা পরিকল্পিতভাবে এ হত্যাকা- ঘটিয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী দলের অপর সদস্য অ্যাডভোকেট মো. গোলাম সারওয়ার খান জাকির বলেন, আদালত তার পর্যালোচনায় বলেন এই অপরাধ সংগঠনে আসামিদের ‘কমন ইন্টেনশন’ ছিল। আর সেটি হচ্ছে বাংলাদেশের মতো একটি স্থিতিশীল রাষ্ট্রকে আইএসের আদলে অস্থিতিশীল রাষ্ট্রে পরিণত করা। যা দেশের পেনাল কোড অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
রায়ে সন্তুষ্ট নিহতের পরিবার: রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন নিহত পুলিশের এসি রবিউল ইসলামের ভাই শামসুজ্জামান শামস। রায় ঘোষণার আগেই তিনি আদালতে উপস্থিত হন। রায়ের পর এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, এই মামলাটি অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে শেষ করে আদালত রায় দিয়েছে। এজন্য সরকারকে অনেক অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। হলি আর্টিজান হামলা মামলার মতো দেশের সকল আলোচিত মামলাগুলোর রায় দ্রুততার সঙ্গে দিলে, আমরা যারা স্বজন হারিয়েছি তাদের পরিবার কিছুটা হলেও শান্তি পায়। শামস বলেন, আমার ভাই দেশের মানুষের জানমালের নিরাপত্তায় হলি আর্টিজানে নিহত হয়েছেন। মৃত্যুর আগে তিনি যেমন মানুষের জন্য কাজ করেছেন, ঠিক তেমনিভাবে মৃত্যুর পরেও মানুষের জন্য তিনি সেবার দুয়ার খোলে রেখে গেছেন। প্রথমে আমরা ভেবেছিলাম ভাইয়ের প্রতিষ্ঠিত বিশেষায়িত স্কুল ‘ব্লুমস’-এর কার্যক্রম থমকে যাবে। ভেঙে যাবে ভাই রবিউলের স্বপ্ন। কিন্তু আমাদের পরিবারের সদস্যদের চেষ্টা ও মানুষের সার্বিক সহযোগিতায় ভালোভাবেই পরিচালিত হচ্ছে স্কুলটির কার্যক্রম। আলো ছড়াচ্ছে প্রতিবন্ধী শিশুদের মাঝে। তিনি জানান, ২০১১ সালে মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার কাটিগ্রামে মায়ের দেয়া ২৯ শতাংশ জমির ওপর ১২ জন প্রতিবন্ধী শিশু নিয়ে স্কুলটির যাত্রা শুরু করেন রবিউল। স্কুলটির পুরো নাম বিকনিং লাইট অর্গানাইজেশন অব ম্যানকাইন্ড এন্ড সোসাইটি। টিনের ঘর থেকে এখন ওই স্কুল পরিণত হয়েছে তিন কক্ষবিশিষ্ট পাকা দালানে। বর্তমানে এই স্কুলের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪২। পাঠদানের পাশাপাশি স্কুল আঙিনায় তৈরি করা হয়েছে শিশু বিনোদনের দোলনাসহ কয়েকটি রাইডস। ভাই আজ বেঁচে থাকলে কি যে খুশি হতেন, তা আপনাদেরকে ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না।
ফাঁসির দ- পাওয়া সাতজনের কার কী দায়: তিন বছর আগে হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলা ও নৃশংস হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় ফাঁসির দ- পাওয়া সাতজনের কার কী দায় ছিল রায়ে তা উঠে এসেছে।
রাকিবুল হাসান ওরফে রিগেন: এইচএসসি পাস। ২০১৪ সালে বগুড়া আজিজুল হক কলেজে পড়ার সময় জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হন। পরের বছর ঢাকায় চলে আসেন। মোট ছয়টি বাসায় ছিলেন। নিষিদ্ধ সত্তার সদস্য পদ গ্রহণ, সমর্থন, অর্থ গ্রহণ, হামলায় জড়িতদের প্রশিক্ষণ দিয়ে হত্যাকা-ে সহায়তা ও প্ররোচিত করা। হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলাকারী জঙ্গিদের প্রশিক্ষক। বসুন্ধরার যে বাসা থেকে হামলাকারীরা হলি আর্টিজানের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছিলেন, সে বাসায় যাতায়াত ছিল। ২৭ জুলাই কল্যাণপুরের জাহাজ বিল্ডিংয়ে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের অভিযানে গুরুতর আহত অবস্থায় গ্রেপ্তার হন। দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দি অনুযায়ী গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারির হামলা ছিল প্রকৃত ইসলাম কায়েমের একটি দৃষ্টান্ত।
মো.জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী: নিষিদ্ধ সত্তার সদস্য পদ গ্রহণ, সমর্থন, অর্থ গ্রহণ, পরিকল্পনা হামলায় জড়িতদের সহায়তা, ঘটনাস্থল রেকি, সার্বিক বিষয়ে অবগত থেকে হত্যাকা-ে সহায়তা করেছেন। সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে রাজীব গান্ধী ওরফে জাহাঙ্গীর আলম হলি আর্টিজানে হামলাকারী খায়রুল ইসলাম পায়েল ওরফে, শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বলকে সরবরাহের কথা স্বীকার করেছেন। আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছেন, তিনি নব্য জেএমবির উত্তরবঙ্গের ‘ইসাফা’ গ্রুপের প্রধান। ২০০৫ সালের ১৭ই আগস্ট দেশের ৬৪টি জেলায় একযোগে বোমা বিস্ফোরণের পর সক্রিয়ভাবে জেএমবিতে যুক্ত হন। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা থানাধীন বোনারপাড়ার একটি বাসায় তামিম চৌধুরী, মেজর জাহিদ, সারোয়ার জাহান মানিক, তারেক, মারজান, শরিফুল ইসলাম খালিদসহ তিনি আত্মঘাতী হামলার পরিকল্পনা করেন। ওই পরিকল্পনা বৈঠকেই সমন্বয়কের দায়িত্ব দেয়া হয় তামিম চৌধুরী ওরফে তালহাকে।
মোহাম্মদ আসলাম হোসেন ওরফে র্যাশ: নিষিদ্ধ সত্তার সদস্য পদ গ্রহণ, সমর্থন, অর্থ লেনদেন, হামলাকারীদের তুলে নিয়ে প্রশিক্ষকের কাছে পৌঁছে দেয়া ও বোমা ছোড়ার প্রশিক্ষণ দেয়া, ঘটনাস্থল রেকি করা, অস্ত্র বহন করে নিয়ে আসা। মোটের ওপর হামলার পরিকল্পনায় অংশ নিয়ে হত্যাকা-ে সহায়তা ও প্ররোচনা দেয়া হলি আর্টিজানে হামলার পরিকল্পনায় যুক্ত থাকার কথা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন। তিনি এসএসসি পাস। ২০১৪ সালের ১লা রমজান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র শরিফুল ইসলাম খালেদের হাতে হাত রেখে বায়াত নেন। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে তামিম চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর নব্য জেএমবিতে যোগ দেন। হামলাকারীদের ঢাকার বিভিন্ন জায়গা থেকে তুলে নিয়ে প্রশিক্ষণের জন্য পৌঁছে দেন। তাঁদের প্রস্তুত করে অস্ত্র, গুলি ও ম্যাগাজিন সরবরাহ করেন। হলি আর্টিজান বেকারি রেকি করেন। বসুন্ধরায় হামলাকারীদের অবস্থানের জন্য বাসা ভাড়ার সন্ধান করেন।
আবদুস সবুর খান : শুরা সদস্য হয়ে টাকা টাহণ, অস্ত্র ও বিস্ফোরক পদার্থ সংগ্রহ, তৈরি ও সরবরাহ করে হলি আর্টিজান বেকারির হত্যাকা-ে সহায়তা করেছে। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছে, জেএমবিতে যুক্ত ২০০২ সাল থেকে। সিদ্দিকুর রহমান ওরফে বাংলা ভাইয়ের সহযোগী ছিলেন। নওগাঁর আত্রাইতে বোমা বানানোর সময় হাত উড়ে যায়। তার সরবরাহকৃত অস্ত্র ও গ্রেনেড গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারির হামলায় ব্যবহার হয়েছিল। ২০১৬ সালের মে মাসে নব্য জেএমবিতে যোগ দেয়। মিরপুরের একটি বাসায় তামিম চৌধুরী ও বাশারুজ্জামান চকলেটের সঙ্গে সাক্ষাৎ। সেখানেই গুলশানে বড় হামলার পরিকল্পনা। এ জন্য লোক সংগ্রহ, অস্ত্র ও গ্রেনেড সরবরাহের দায়িত্ব দেয়া হয়। সে আসলামকে অস্ত্র বুঝিয়ে দিতো।
মোহাম্মদ হাদিসুর রহমান: তার বিরুদ্ধে অভিযোগ নিষিদ্ধ সত্তার সমর্থন, সদস্য পদ গ্রহণ, অর্থ গ্রহণ, হামলার জন্য অস্ত্র গ্রেনেড সরবরাহ করে হত্যাকা-ে সহায়তা ও প্ররোচিত করা। সে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছে, ঝিনাইদহে অবস্থানের সময় হলি আর্টিজানে হামলায় প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী নিবরাস ও মোবাশ্বেরের সঙ্গে সাংগঠনিক কাজে যুক্ত ছিলো। ঢাকার কূটনৈতিক পাড়ায় হামলা ও প্রস্তুতি হিসেবে টার্গেট কিলিং সম্পর্কে অবহিত ছিলো। হলি আর্টিজানে হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্র নিজেদের জিম্মায় রেখেছিলো। হামলার ২০ বা ২২ দিন আগে তামীম আহমেদ চৌধুরীর নির্দেশে একটি কালো ব্যাগে করে হাদিসুর চারটি গ্রেনেড ঝিনাইদহ থকে ঢাকায় নিয়ে আসে। ওই গ্রেনেড হামলায় ব্যবহৃত হয়েছিল।
মামুনুর রশিদ রিপন: সদস্য পদ গ্রহণ, সমর্থন, অর্থ সংগ্রহ, অর্থ লেনদেন, হামলার পরিকল্পনা, হত্যাকান্ডের সহায়তা ও প্ররোচিত করা। দাখিল পাস। জেএমবির দায়িত্বশীল নেতাদের মৃত্যুদ- কার্যকরের পর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে রিপন। সারোয়ার জাহান, ডাক্তার নজরুল ও অন্যদের নিয়ে অঞ্চলভিত্তিক উদ্বুদ্ধকরণ মিটিং ও সদস্য সংগ্রহের কাজ অব্যাহত রাখে।
দুজনের মাথায় টুপি: সাত আসামির মৃত্যুদ-ের রায়ের পর আদালত প্রাঙ্গণেই তাদের দুজনের মাথায় দেখা গেছে কালো টুপি, সেখানে মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গি দল আইএস এর পতাকার চিহ্ন অংকিত ছিল। পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় আসামিদের কাছে কী করে ওই টুপি গেল, সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি কেউ। রায় শেষে আসামিদের মহানগর দায়রা জজ আদালতের পঞ্চম তলায় সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের এজলাস থেকে নামিয়ে আনার সময় আসামি রাকিবুল হাসান রিগ্যানের মাথায় দেখা যায় একটি কালো টুপি, সেখানে আইএস এর পতাকার ঢঙে আরবি লেখা।
এসময় তার পাশে পুলিশ সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন। পরে আসামিদের কারাগারে নেয়ার সময় প্রিজন ভ্যানে তোলা হলে জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধীর মাথাতেও একই ধরনের টুপি দেখা যায়। অথচ আদালতে নেয়ার সময় ওই দুজনের মাথায় কোনো টুপি দেখা যায়নি। আদালত প্রাঙ্গণে পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় কীভাবে ওই টুপি তারা পেলেন- সে বিষয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য এসেছে। পুলিশের উপ-কমিশনার (প্রসিকিউশন) জাফর আহমেদ বলেন, এটা আমরা খেয়াল করতে পারিনি। ধর্মীয় টুপি বলেই মনে করেছিলাম। পরে বিষয়টি নজরে আসে। তবে আদালত থেকে এধরণের টুপি আসামিদের হাতে যাওয়ার সুযোগ নেই। অন্যদিকে জেলার মাহবুব আলম বলেন, আসামিদের মধ্যে শুধু একজন আমাদের এখান থেকে সাদা টুপি পরে গেছে। বাকি সবার মাথা খালি ছিল। আমাদের এখান থেকে এ ধরনের কোনো টুপি পরে কেউ যায়নি। রায় ঘোষণার পর আসামিরা যখন কারাগারে এসেছে, তখনও তাদের কাছে কোনো কালো টুপি পাওয়া যায়নি। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আবদুল্লাহ আবু বলেন, এ ব্যাপারে আমি বলতে পারব না, এটা জেল কর্তৃপক্ষ, যেখান থেকে এদেরকে আনা হয়েছে, এই টুপি কীভাবে পরল, এই জবাবটা তারা দিবে। টুপি তারা পরতে পারে, কিন্তু টুপিতে কালো কাপড় দিয়ে প্রতীকী টুপি পরা একটি সংগঠনের, এটা অন্যায়। এটা কোনোভাবে হওয়া উচিত না। বিষয়টি তদন্তের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, তাদের (জেল কর্তৃপক্ষের) অবহেলা বা গাফিলতি আমি এই মুহূর্তে বলব না।
এটা সুষ্ঠুভাবে দেখতে হবে, এটার অবশ্যই তদন্ত হওয়া দরকার, জানা দরকার। আইএসের অনুরূপ কীভাবে এই টুপিটা তারা পরল? আব্দুল্লাহ আবু বলেন, নিরাপত্তার অনেকগুলো ধাপ পার করে আসামিদের আদালতে আনা হয়েছে। তার মধ্যে কীভাবে আসামিদের কাছে টুপি গেল, কীভাবে ফিতা লাগালো- এটা অবশ্যই দেখা দরকার, কেননা বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে পিপি গোলাম ছারোয়ার খান জাকির বলেন, আমি মন্তব্য করব না। তবে এর আগে আসামিরা যখনই আদালতে এসেছে এমন কোনো অভিযোগ পাইনি। অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, আসামিরা দীর্ঘদিন ধরে পুলিশের হাতে ছিল। আসামিরা কে কী পরে এসেছে সেটা নিয়ে আমার কথা বলা ঠিক নয়। এটা পুলিশের বিষয়।
গত ১৭ই নভেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক শেষ হয়। এরপর ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান রায় ঘোষণার এদিন ধার্য করেন। ২০১৬ সালের ১লা জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালিয়ে দুই পুলিশসহ দেশি-বিদেশি ২২ জনকে হত্যা করে জঙ্গিরা। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও দু’জনের মৃত্যু হয়। এছাড়া হামলায় অন্তত ৩০ জন পুলিশ সদস্য আহত হন। ওই সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যৌথ অভিযান ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ডে’ পাঁচ জঙ্গি নিহত হয়। অভিযানে এক জাপানি ও দুই শ্রীলংকানসহ ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়।
যা ছিল মামলার এজাহারে: মামলার বাদী এসআই রিপন কুমার দাস গুলশান থানার ৭১ নং রোড থেকে ৯২ নং রোড এবং আশপাশ এলাকায় সকাল ৯টা থেকে পেট্রোল ডিউটি করছিলেন। তিনি রাত ৮টা ৪৫ মিনিটের দিকে বেতারযন্ত্রের মাধ্যমে জানতে পারেন, ৭৯ নম্বর রোডের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড বেকারিতে গোলাগুলি হচ্ছে। সংবাদ পাওয়ার পর তিনি ফোর্সসহ রাত ৮টা ৫০ মিনিটের দিকে রেস্টুরেন্টের কাছে গিয়ে দেখতে পান, ভেতরে কিছু সন্ত্রাসী ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি ও বোমা নিক্ষেপ করছে। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে তাদের ওপরও বোমা নিক্ষেপ ও এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে সন্ত্রাসীরা। আত্মরক্ষার্থে পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়। একপর্যায়ে সন্ত্রাসীদের গুলি ও গ্রেনেডের আঘাতে এসআই ফারুক হোসেন ও তার সঙ্গে থাকা কনস্টেবল প্রদীপ চন্দ্র দাস ও আলমগীর হোসেন গুরুতর আহত হন। আহতদের হাসপাতালে পাঠানো হয়। এরপর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়াসহ ডিএমপির সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তা ও ফোর্স ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। তারা বেকারির চারপাশ ঘিরে রেখে সন্ত্রাসীদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন। তখন সন্ত্রাসীরা তাদের লক্ষ্য করে অনবরত গ্রেনেড ও গুলি করতে থাকে। এরপর রাত সাড়ে ৮টার দিকে সন্ত্রাসীরা বেকারির পশ্চিম দিকের ৭৯ নম্বর রোডের ২০ নম্বর বাড়ির সামনে অবস্থানরত পুলিশকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড নিক্ষেপ ও গুলি শুরু করে। এ সময় ৩০-৩৫ জন পুলিশ কর্মকর্তা ও ফোর্স আহত হন। আহতদের মধ্যে অনেকের অবস্থা ছিল গুরুতর। তাদের সবাইকে ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত ৯টা ২০ মিনিটে বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সালাহউদ্দিন খান মারা যান। এর কিছুক্ষণ পর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সহকারী কমিশনার মো. রবিউল করিমও মারা যান। সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়ন অভিযান চালায়। সে সময় সন্ত্রাসীরা কমান্ডো বাহিনীর ওপর গ্রেনেড নিক্ষেপ ও গুলি করে। এ অভিযানে পাঁচ জঙ্গি এবং ওই বেকারির এক কর্মীসহ ছয়জন নিহত হয়। পাঁচ জঙ্গি হলো- মীর মোবাশ্বের (১৯), রোহান ইমতিয়াজ (২০), নিবরাস ইসলাম (২০), মো. খায়রুল ইসলাম পায়েল (২২), মো. শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ওরফে বিকাশ (২৬)। নিহত বেকারির কর্মীর নাম সাইফুল চৌকিদার। এ সময় প্যারা কমান্ডোরা দেশি-বিদেশি জিম্মিদের জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করতে সক্ষম হন।
এছাড়া, নয়জন ইতালীয়, সাতজন জাপানি এবং একজন ভারতীয় ও তিনজন বাংলাদেশি (তাদের একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমেরিকার নাগরিক) নাগরিকের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। অভিযানে ছয় সন্ত্রাসী নিহত হয়। নিহতদের মৃতদেহ ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) পাঠানো হয়। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে মৃতদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। সিআইডি ক্রাইম সিন বিভাগের সহায়তায় গুলশান থানার এসআই রিপন কুমার দাস, এসআই মফিদুল ইসলাম, এসআই জয়নাল আবেদীন এবং এসআই হুমায়ুন কবির ঘটনাস্থল থেকে সন্ত্রাসীদের ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্র, বিস্ফোরক দ্রব্যসহ অন্যান্য জিনিস এবং ভিকটিমদের ব্যক্তিগত মালামাল জব্দ করে হেফাজতে নেন।