রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৪১ পূর্বাহ্ন

মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ লাক্ষাদ্বীপেও চলছে মুসলিমদের ধ্বংস করার প্রয়াস

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : বুধবার, ২৬ মে, ২০২১
  • ২১৭ বার

ভারতের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য জম্মু ও কাশ্মিরের পরে এখন আরো একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল লাক্ষাদ্বীপেও সাম্প্রদায়িক শক্তি চোখ রাঙাচ্ছে। বিভিন্নভাবে অভিযোগ উঠছে যে লাক্ষাদ্বীপের প্রশাসক ও বিজেপি নেতা প্রফুল খোদা প্যাটেল ৯৭ শতাংশেরও বেশি মুসলিম জনসংখ্যাসম্পন্ন এই দ্বীপের জীবনযাপন ও চিরাচরিত ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি ধ্বংস করার চেষ্টা করছেন। ফলে লাক্ষাদ্বীপের প্রশাসককে নিয়ে তৈরি হয়েছে মারাত্মক রাজনৈতিক অস্থিরতা। নতুন প্রশাসক প্রফুল প্যাটেলের একাধিক সিদ্ধান্ত নিয়ে দেখা দিয়েছে বিতর্ক। গরুর গোশতে নিষেধাজ্ঞা, দুই সন্তানের অধিক সন্তান থাকলে অভিভাবকের পঞ্চায়েত ভোটে দাঁড়ানোর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। যেখানে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল এই দ্বীপপুঞ্জে অপরাধের হার একেবারে নেই বললেই চলে। সেখানে গুন্ডাদমন আইন প্রণয়ন নিয়েও শোরগোল হচ্ছে। এছাড়াও নতুন আইনে উন্নয়নের কাজে যেকোনো জমি অধিগ্রহণের ক্ষমতা রয়েছে প্রশাসনের।

প্রশাসকের সিদ্ধান্ত নিয়ে পার্শ্ববর্তী কেরালার সিপিএম-কংগ্রেস একযোগে প্রতিবাদ জানিয়েছে। সোমবারই কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন জানিয়েছেন, প্রশাসকের পদক্ষেপ লাক্ষাদ্বীপের সংস্কৃতি ও মানুষের জীবনযাপনকে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। তিনি বলেন, এই ধরনের আইন কখনো মানা যায় না। লাক্ষাদ্বীপের সঙ্গে কেরালার দীর্ঘ দিনের আত্মীয়তা। কিন্তু সেটাকে ধ্বংস করার চেষ্টা হচ্ছে। তিনি ছাড়াও বাম গণতান্ত্রিক জোট এবং কংগ্রেসের বহু এমপি, সেই সঙ্গে লাক্ষাদ্বীপের একমাত্র এমপি মোহাম্মদ ফয়জল এই স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। প্যাটেলের স্বৈরাচারী, জনবিরোধী নীতির জেরে কেন্দ্রের কাছে চিঠি লিখে তার অপসারণের দাবি তুলেছেন অনেকেই। এমনকি তার সিদ্ধান্তগুলো বাতিল করার আওয়াজও উঠেছে।

স্থানীয় এমপি মোহাম্মদ ফয়জল জানিয়েছেন যে, চলতি বছরের জানুয়ারির পর থেকে প্যাটেলের কারণে প্রায় ৩০০ লোক কাজ হারিয়েছেন। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের লোকেরা তার প্রবর্তিত নীতিমালার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা শুরু করে এবং তার কয়েক দিন পরেই কাজ হারাতে শুরু করেন অনেকেই। হায়দরাবাদের এমপি আসাদউদ্দিন ওয়েইসিও প্রশাসকের দিকে আঙুল তোলেন। তিনি টুইট করেছেন, যে মোদি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার লাক্ষাদ্বীপ ও সেখানকার জনগণের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করছে। তিনি লাক্ষাদ্বীপের কাছ থেকে দ্বীপবিরোধী সমস্ত আইন প্রত্যাহার এবং প্যাটেলকে প্রশাসকের পদ থেকে অপসারণের দাবি জানান। এদিকে, গত কয়েক দিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে #SaveLakshadweep ট্রেন্ড শুরু হয়। প্রধানত লাক্ষাদ্বীপ ও কেরলের মানুষেরা এই ট্রেন্ডিং শুরু করেন প্যাটেলের স্বৈরাচারী নীতির অবসানের জন্য।

উল্লেখ্য, লাক্ষাদ্বীপ ডেভলপমেন্ট অথরিটি রেগুলেশন ২০২১ (এলডিএআর) প্রশাসককে শহর পরিকল্পনা বা কোনো উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য দ্বীপের বাসিন্দারা সম্পত্তি থেকে অপসারণ বা স্থানান্তর করার ক্ষমতা প্রদান করে। অন্যদিকে, ‘গুন্ডা নীতি’বিরোধী সামাজিক ক্রিয়াকলাপের আওতায় একজন ব্যক্তিকে যেকোনো সময় কোনো কারণ ছাড়াই এক বছর পর্যন্ত আটক করা যাবে।

পাশাপাশি, প্যাটেল লাক্ষাদ্বীপের স্কুল মেনু থেকে আমিষ খাদ্য সামগ্রীগুলো সরিয়ে দেন অথচ ওইসব অঞ্চলের মানুষের খাদ্যতালিকায় ওপরে দিকেই রয়েছে সামুদ্রিক মাছ। মানুষ এই নির্বিচারে অভিহিত করা ‘গুন্ডা আইন’ বাস্তবায়নের বিরুদ্ধেও বিক্ষোভ করছে। অনেক এমপি তাদের চিঠিতে অভিযোগ করেন যে প্যাটেল প্রশাসনের জারি করা আদেশ ও নিয়মগুলোতে জনগণের খাবারের পছন্দ ও জীবিকার বিষয়ে কোনরকম বিচারবিবেচনা না করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সিয়াসাত ডটকমের মতে লাক্ষাদ্বীপের জনসংখ্যার ৯৭ শতাংশ মুসলমান এবং প্রধানমন্ত্রী মোদির ঘনিষ্ঠ সহযোগী প্রশাসক কর্তৃক অনুমোদিত নীতিমালায় হিন্দুত্ববাদ প্রকল্পের সম্প্রসারণের স্পষ্ট প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে।

শুধু তাই নয়, প্যাটেলের বিরুদ্ধে কোভিড-১৯ সম্পর্কিত নিয়মগুলো পুরোপুরি পরিবর্তন করা ও সামাজিক বিধিনিষেধ ভাঙার অভিযোগ আনা হয়েছিল। অনেকেই অভিযোগ করছেন প্রশাসনের উদাসিনতার কারণেই এই দ্বীপের ছোট্ট অঞ্চলটিতে কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ বেড়েছে।

উল্লেখ্য যে, নরেন্দ্র মোদি যখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন গুজরাটের বাসিন্দা প্রফুল খোদা প্যাটেল ছিলেন রাজ্যের প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। মোদির ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে খ্যাত, প্রাক্তন প্রশাসক ও আইপিএস অফিসার দীনশ্বর শর্মা মারা যাওয়ার পরে প্যাটেলকে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে লাক্ষাদ্বীপের প্রশাসক করা হয়েছিল। এর আগে, প্যাটেলকে ২০১৬ সালে দমন ও দিউ এবং দাদরা ও নগর হাভেলি-র প্রশাসক নিযুক্ত করা হয়েছিল। দাদরা ও নগর হাভেলি থেকে স্বতন্ত্র এমপি সদস্য মোহন দেলকারের আত্মহত্যায় তার নাম জড়ায়, যিনি তার ১৫ পৃষ্ঠার সুইসাইড নোটে প্যাটেলের নামও লিখেছিলেন।

একটি ফেসবুক পোস্টে লাক্ষাদ্বীপের স্থানীয় বাসিন্দা ফিরোজ নেদিয়াথ অভিযোগ করেন যে প্যাটেল সাধারণত বিজেপি নেতা বলেই এই পদটি হাতে পেয়েছিলেন। লাক্ষাদ্বীপের ইতিহাসকে প্যাটেল কীভাবে ধ্বংস করছে তা নিয়ে মালায়ালামে লেখা তার পোস্টটি বর্তমানে তুমুল ভাইরাল।

অন্যদিকে সিপিএম রাজ্যসভার সদস্য এলামারোম করিম তার চিঠিতে লিখেছিলেন যে দ্বীপপুঞ্জীরা মালায়ালাম ভাষায় কথা বলে এবং সংস্কৃতিগতভাবে কেরালার সঙ্গে সংযুক্ত। বেইপুর বন্দরটি মূল ভূখণ্ড এবং দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে বহু প্রজন্ম ধরে সংযোগ রক্ষা করছিল। অথচ প্রশাসক এখন দ্বীপপুঞ্জ ও কেরালার মধ্যে যোগসূত্রটি বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করছেন। গত ছয় মাসে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই প্রায় ২ হাজারেরও বেশি অস্থায়ী সরকারি কর্মচারীকে বরখাস্ত করা হয়েছিল এবং এটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেও অভিযোগ করেন অনেকেই। প্রশাসক শিশু এবং গর্ভবতী মহিলাদের পুষ্টিকর খাবার সরবরাহ বন্ধ করার জন্য ৩৮টি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রও সিল করে দিয়েছেন। প্রশাসনের নির্দেশে পর্যটন বিভাগ ১০৯ জন কর্মচারীকে বরখাস্ত করা হয়েছে বলেও জানা যায়।

তবে ইতিমধ্যেই এই স্বৈরাচারী নীতির বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন বহু বিশিষ্টজন। অভিনেতা ও চলচ্চিত্র নির্মাতা পৃথ্বীরাজ সুকুমারান দ্বীপপুঞ্জের সঙ্গে প্রকাশ্যে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। অভিনেত্রী ও পরিচালক গীতু মোহনদাসও প্রশাসকের কিছু সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেছেন। ফুটবলার সি.কে. ভিনিথ টুইট করে প্যাটেলের কাজগুলি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। পপুলার ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়া লাক্ষাদ্বীপের অধিবাসীদের হিন্দুত্ববাদী দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে এগিয়ে আসার এবং দেশের সকল অগণতান্ত্রিক শক্তিকে প্রতিহত করার আহ্বান জানিয়েছে।

সূত্র : পুবের কলম

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com