বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প খাত করোনার প্রথম ধাক্কা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয় ধাক্কায় আর লকডাউনে কী হবে, এর ভবিষ্যত সেটিই নিয়ে চিন্তিত বিশেষজ্ঞরা। দেশের রপ্তানি আয়ের ৮৪ শতাংশ আসে পোশাক খাত থেকে। এ খাতে ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করেন। তাদের মধ্যে ৮০ শতাংশের বেশি শ্রমিকই নারী। দেশের বৃহত্তর রপ্তানি আয়ের এ খাতটি যেন উৎপাদন অব্যাহত রাখতে পারে এবং আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারে, ওই উদ্দেশ্যে ঈদের পর লকডাউনের সময় পোশাক কারখানাগুলো খোলা রাখার সিদ্ধান্ত বিবেচনার দাবি সরকারের কাছে। উদ্যোক্তারা বলেন, পোশাক উৎপাদকদের জন্য জুলাই-আগস্ট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ সময় পশ্চিমা বাজারে শীত ও বড়দিনের জন্য বিক্রি বেড়ে যায়। বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি করা মোট পোশাকের ৪০ শতাংশই এ দুই মাসে রপ্তানি করা হয়। কিন্তু দেশে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়ে যাওয়ায় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে সরকার ২৩ জুলাই যে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে, সেখানে পোশাকশিল্প কারখানাগুলোকে এই বিধিনিষেধের আওতার বাইরে রাখার জন্য অনুরোধ করেছে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ।
গণপরিবহন বন্ধ রেখে কারখানা খোলা রাখলে শ্রমিকদের যাতায়াত ব্যবস্থা কী হবে? নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তা কে দেবেন? গত লকডাউনের সময় রিকশা ছাড়া সব পরিবহন বন্ধ থাকায় শ্রমিকদের দীর্ঘ পথ হেঁটে কারখানায় যেতে দেখা গেছে। ফলে তাদের পরিশ্রম বেড়ে গেছে। অনেক ক্ষেত্রে অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণে অসুস্থ হয়ে কাজে অনুপস্থিত থাকতে হয়েছে। তবে পোশাকশিল্পের কল্যাণে দেশের অনেক নারীই অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন। পাশাপাশি বেড়েছে তাদের আর্থিক সক্ষমতাও। অন্যদিকে বিপরীত চিত্রও আছে। এই শিল্পে কাজ করতে এসে অসংখ্য নারী শ্রমিক অধিকার বঞ্চিত হচ্ছেন। পাচ্ছেন না শ্রমের উপযুক্ত মূল্য। চাকরি হারিয়ে পথে বসছেন অনেকেই। সরকারি সেক্টরের মতো এই শিল্পে মাতৃত্বকালীন ছুটি নেই বলে মা হওয়ার আগে তাদের চাকরি ছেড়ে দিতে হয়। সারাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে অভাবী নারী ও কিশোরীরা কাজের খোঁজে আসে এই সেক্টরে। কাজ করে নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের পাশাপাশি দেশের জন্যও তারা শ্রম দিচ্ছেন।
পরিবেশ প্রতিকূলতায় হাজার হাজার নারী শ্রমিক রয়েছেনÑ যারা বিবিধ সমস্যায় জর্জরিত। তাদের কর্মক্ষেত্রে নেই স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট, বিশুদ্ধ পানি, অসুস্থতায় রেস্ট রুম কিংবা ডাক্তার।
পোশাকশিল্পে নারীরা কেমন আছেন, এ বিষয়ে মতামত জানতে প্রশ্ন করা হলে গ্রিনবাংলা ওয়াকার্স ফেডারেশনের নারীবিষয়ক সম্পাদক মাকসুদা আক্তার ইতি বলেন, ‘দীর্ঘ ও অবিরাম সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের নারীসমাজ ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। নাগরিক হিসেবে পুরুষের সমান অধিকার থাকা সত্ত্বেও নারীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বঞ্চিত হচ্ছেন। নারীর নিরাপত্তার জায়গাটাও এখনো নড়বড়ে, অনেকখানি হতাশাব্যঞ্জক। এখন অর্থনৈতিক কর্মকা-সহ নানা ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছেÑ এটি সার্বিক বিবেচনায় কতটা অগ্রগতি, তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। তা ছাড়া অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে জেন্ডারবৈষম্য এখনো রয়ে গেছে। এই সেক্টরের একটি অংশ দীর্ঘকাল নারীদের সঙ্গে আমানবিক আচরণ করে এলেও এর কোনো প্রতিকার নেই।’
অনেক মালিক শ্রমিকদের কথা ভাবেন না। এ কারণে কারখানার নানা দুর্ঘটনার শিকার হন শ্রমিকরা। বিপরীতে কোনো পুনর্বাসন বা ক্ষতিপূরণ পান না। পেলেও সামান্য। কোভিড ও এর প্রাদুর্ভাব নিয়ে তৈরি পোশাকশিল্পের ভবিষ্যৎ দুশ্চিন্তার পরও বলা যায় বাংলাদেশে সর্বসম্মত শ্রমিকদের নিরাপত্তা উন্নত হয়েছে। কিন্তু কাজ শেষ হয়ে যায়নি। এখনো বাংলাদেশে অনেক কারখানা আছেÑ যা নিরাপদ নয়।
কিছু কারখানায় স্বাস্থ্যবিধির বাধ্যবাধকতা দেখা যায়। এসব কারখানায় কর্মীদের তাপমাত্রা মাপা হচ্ছে। জীবাণুনাশক স্প্রে করা ছাড়াও হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কারও শরীরে জ্বর থাকলে বা সর্দি-ঠা-া থাকলে ছুটি দেওয়া হয়। সুস্থ হয়ে কোভিড-১৯ পরীক্ষায় নেগেটিভ হলে আবার কাজে ফেরেন। কিন্তু তেমন কারখানা হাতে গোনা। আবার দেখা যায়, তৈরি পোশাকশিল্পের কর্মীদের জীবনে প্রতিটি উৎসবই আসে আশাহত হওয়ার আশঙ্কা নিয়ে। ঈদের আগে বেতনটা পাবে কিনা? ওই বেতনে উৎসব উদযাপন হবে কিনা? প্রায় প্রতি উৎসবের আগে ন্যূনতম মজুরির অধিকার আদায়ের সংগ্রাম নামেন তারা। করোনা মোকাবিলায় তৈরি পোশাকশিল্প খাতের কর্মীদের পর্যায়ক্রমে টিকাদান কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। সবশেষে বলা যায়, দেশের রপ্তানি আয়ের সবচেয়ে বড় খাতকে টিকিয়ে রাখতে শ্রমিকের দিকে নজর দিতে হবে। না হলে গভীর সংকটে পড়তে পারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প।