ভাঙনের মুখে সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন জোট যুক্তফ্রন্ট। একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর কোনো কর্মকাণ্ডে নেই এই ফ্রন্ট। এমনকি কোনো বৈঠকও হয়নি।
চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মেলাতে না পেরে ইতোমধ্যে জোট ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ক্ষুব্ধ শরিক দল বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (বাংলাদেশ ন্যাপ), এনডিপি এবং জাতীয় জনতা পার্টিসহ কয়েকটি দল। ‘রাজনৈতিক সংস্কার আন্দোলন’ নামে ভিন্ন প্ল্যাটফরম গঠনের চেষ্টা করছেন এসব দলের নীতিনির্ধারকরা।
যুক্তফ্রন্টের অন্যতম শরিক দল বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (বাংলাদেশ ন্যাপ) মহাসচিব গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া যুগান্তরকে বলেন, ‘অস্তিত্বহীন জোটে আমরা তো নেই। ২০১৯ সালের বাজেট পরবর্তী আলোচনা সভার পর থেকে জোটের সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগই নেই। আমরা প্রধান শরিক বিকল্প ধারাকে ‘রাজনীতি’ করতে বলেছিলাম। কিন্তু তারা তা করছে না। এজন্য জোটের কোনো কার্যক্রমে অংশ নেইনি। নেওয়ার সম্ভাবনাও নেই।’
তিনি জানান, ‘রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী হিসাবে একজন টানা দু’বারের বেশি নয়, দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করাসহ আরও কিছু বিষয় নিয়ে আমরা এখন ‘রাজনৈতিক সংস্কার আন্দোলনের’ নামে কাজ করতে চাই। প্রাথমিক পর্যায়ে এ নিয়ে কয়েকটি বাম দলের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হয়েছে। তারা জানিয়েছেন, এ নিয়ে এগিয়ে গেলে একটা রাজনৈতিক ধারাও তৈরি হতে পারে। করোনা একটু স্বাভাবিক হলেই আনুষ্ঠানিকভাবেই নতুন এই জোট নিয়ে আলোচনা শুরু করব। ২০ দল ও ১৪ দলের বাইরে যেসব দল আছে তাদেরকে যুক্ত করার টার্গেট থাকবে। তাদের সঙ্গে কথা বলব। এমনকি জাতীয় পার্টির সঙ্গেও এ বিষয়ে কথা বলব।’
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিকল্প ধারার প্রেসিডেন্ট বি. চৌধুরীর নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিএনপিকে ১৫০ আসন এবং জামায়াতকে ত্যাগ করার শর্ত দিলে সে প্রক্রিয়া ভেস্তে যায়। পরে বি. চৌধুরীর নেতৃত্বে ১১টি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত হয় যুক্তফ্রন্ট। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে নির্বাচনী ঐক্য গড়ে জোটটি।
নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন বি. চৌধুরীর ছেলে মাহী বি. চৌধুরী ও তার দলের মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নান। সে সময়ই বিকল্প ধারার আসন সমঝোতার বিষয়টি নিয়ে মনঃক্ষুণ্ন হন শরিক দলের নেতারা। কারণ আসন সমঝোতায় শরিক দলের নেতাদের ছাড় দেয়নি বিকল্প ধারা। এ ছাড়াও নির্বাচনের পর থেকে কোনো কর্মকাণ্ডে না থাকা, শরিকদের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখাসহ নানা ইস্যুতে জোটে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়।
এসব বিষয়ে বক্তব্য নিতে বিকল্প ধারার প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে একাধিকবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি। তবে বিকল্প ধারার প্রেসিডিয়াম সদস্য শমসের মবিন চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, ‘যুক্তফ্রন্ট ভেঙে গেছে সেটা বলা যাবে না। এখনো জোট আছে। তবে জোট এখন অনেকটা নিষ্ক্রিয় বলা যেতে পারে। কোনো তৎপরতা নেই।’
যুক্তফ্রন্টে থাকা ১১টি দল হল-বিকল্প ধারা বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ, বাংলাদেশ লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-বিএলডিপি, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এনডিপি, জাতীয় জনতা পার্টি, বাংলাদেশের জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশ গণসাংস্কৃতিক দল, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, বাংলাদেশ জনতা লীগ, বাংলাদেশ শরিয়া আন্দোলন ও বাংলাদেশ মাইনোরিটি ইউনাইটেড ফ্রন্ট। দলগুলোর মধ্যে বিকল্প ধারা, বাংলাদেশ ন্যাপ ও বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত।
জানতে চাইলে যুক্তফ্রন্টের আরেক শরিক দল বাংলাদেশ লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-বিএলডিপির চেয়ারম্যান নাজিমউদ্দিন আল আজাদ বলেন, ‘যুক্তফ্রন্ট তো এখন নেই। আমার ধারণা এই জোট করেছিল নির্বাচনের জন্য। তবে এটা অব্যাহতভাবে ফ্রন্ট হিসাবে কাজ করবে-এ রকম একটা চিন্তা আমাদের ছিল। কিন্তু নির্বাচনের পর যখন জোটের আর কোনো ভূমিকা নেই, তখন তো মনে হয় নির্বাচনও শেষ, যুক্তফ্রটও শেষ।’
আরেক শরিক দল ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এনডিপি) চেয়ারম্যান খোন্দকার গোলাম মোর্ত্তজা বলেন, ‘যেদিন সবকিছু বিসর্জন দিয়ে বিকল্প ধারা শুধু নিজেদের জন্য দুটি আসন নিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করেছে, যুক্তফ্রন্ট সেদিনই শেষ হয়ে গেছে। এরপর একটা মিটিং হয়েছিল। সেখানে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য কর্মসূচি দেওয়ার দাবি তুলেছিলাম। কিন্তু বি. চৌধুরী একমত হননি। তার পর থেকে আমাদের সঙ্গে যুক্তফ্রন্টের কোনো যোগাযোগ নেই।’
জোটের শরিক দলের নেতারা আরও জানান, ১১টি দল ও কিছু ব্যক্তির সমন্বয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হলেও লাভবান হয়েছে একমাত্র বিকল্প ধারা। জোটের অন্য দলগুলোর কথা চিন্তা না করে একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিকল্প ধারার নেতারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতা করেছে। তারা দুটি আসন পেয়েছে। ক্ষমতাসীন দলও শুধু মাহী বি. চৌধুরী ও মেজর (অব.) মান্নানের দুটি আসনে ছাড় দিয়েছে। অন্য কোনো দলের নেতাদের ছাড় দেয়নি। তখনই এ জোট শেষ হয়ে গেছে। তার পরও কেউ কেউ নির্বাচন পরবর্তী সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার আশায় ছিলেন। কিন্তু তা না পেয়ে সবাই হতাশ। তাদের মতে, আনুষ্ঠানিকভাবে হয়তো জোট আছে। কিন্তু বাস্তবে বিকল্প ধারা ছাড়া কোনো দলই এখন যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে নেই।