মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাচ্ছে। এতে বাড়ছে আমদানি ব্যয়। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে বাণিজ্য ঘাটতির ওপর। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, গত বছরের ৪ ডিসেম্বর আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার পেতে যেখানে ব্যয় করতে হতো ৮৩ টাকা ৯০ পয়সা, চলতি মাসের একই সময়ে তা বেড়ে হয়েছে ৮৪ টাকা ৯০ পয়সা। তবে আমদানি পর্যায়ে করপোরেট ডিলিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন হচ্ছে ৮৬ টাকা পর্যন্ত। রফতানি আয় কমে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহে টান পড়েছে।
এক দিকে আমদানি চাহিদা বেড়ে গেছে, অপর দিকে টাকার মান কমে যাচ্ছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে পণ্যের আমদানি ব্যয়ের ওপর। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সামগ্রিক পণ্য বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা।
জানা গেছে, বছরের শুরুতেই রেমিট্যান্সপ্রবাহের পাশাপাশি রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি বেড়ে ছিল। কিন্তু সেই তুলনায় আমদানি চাহিদা বাড়েনি। এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা অনেকটা সহনীয় ছিল। কিন্তু গত চার মাস ধরে রেমিট্যান্সপ্রবাহ ঠিক থাকলেও একটানা রফতানি আয়ের ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। এ দিকে আমদানি চাহিদাও বেড়ে গেছে। সাথে সাথে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা বেড়ে গেছে। এ দিকে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাচ্ছে।
এ দিকে বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্কট থাকায় ব্যাংকগুলো প্রতিনিয়তই বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে হাত পাতছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জ্বালানি তেল ভোগ্যপণ্যসহ কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রতিনিয়তই সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোর টাকার জোগান দিচ্ছে। কিন্তু বেশির ভাগ ব্যাংকই করপোরেট ডিলিংয়ের মাধ্যমে বেশি মূল্যে ডলার লেনদেন করছে। এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেয়া বৈদেশিক মুদ্রার দর কার্যকর হচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট এক সূত্র জানায়, কিছু কিছু ব্যাংকের ডলারের সঙ্কট রুটিনে পরিণত হয়েছে। কারণ, বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বাড়ছে না। কাক্সিক্ষত হারে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করতে পারছে না। আবার রফতানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ কম। ফলে পণ্য আমদানির দায় পরিশোধ করতে বাজার থেকে হয় তাদের ডলার কিনতে হচ্ছে, অথবা একটি নির্ধারিত কমিশনের বিপরীতে ধার নিতে হচ্ছে। আর এ সুযোগটি কাজে লাগাচ্ছে কিছু কিছু ব্যাংক। তারা ইচ্ছেমাফিক ডলার মূল্য আদায় করতে চাচ্ছে। তবে, এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও তেমন করার কিছু নেই। যেমন, বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেয়া মূল্য ধরেই ফরওয়ার্ড ডিলিং করছে।
ফরওয়ার্ড ডিলিং হলো, একটি ব্যাংকের পণ্যের আমদানি দায় মেটাতে ১০ কোটি ডলারের প্রয়োজন। চাহিদার দিনের ৪ থেকে ৫ দিন আগেই বাংলাদেশ ব্যাংক বেধে দেয়া মূল্য ধরে ডলার কেনা হলো। এর সাথে বিনিময় ঝুঁকি বা অতিরিক্ত প্রিমিয়াম যুক্ত হচ্ছে। যেমন, চার দিন আগে ৮৪ টাকা ৯০ পয়সা দরে ১০ কোটি ডলার কেনা হলো। লেনদেনের দিন ২ শতাংশ অতিরিক্ত ধরে অর্থাৎ ৮৭ টাকায় ডলার লেনদেন করছে। এভাবেই বাজারে বাংলাদেশ ব্যাংক বেঁধে দেয়া দর কার্যকর হচ্ছে না। এ বিষয়ে অপর একটি ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, তাদের করার কিছুই নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিমালা দিয়ে ব্যাংকগুলোকে আটকাতে না পারলেও তাদেরকে ডেকে এনে এ বিষয়ে সতর্ক করতে পারে।
এ দিকে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। আগে যে পণ্যের দাম ১০০ টাকা ছিল ওই পণ্য শুধু টাকার মান কমে যাওয়ার কারণে এখন ১০৫ টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে। যেহেতু আমাদের অর্থনীতি বেশির ভাগ আমদানিনির্ভর, এ কারণে টাকার মান কমে যাওয়ার সরাসরি প্রভাব পণ্যের মূল্যের ওপর পড়ে। এতে এক দিকে যেমন পণ্য মূল্য বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতির ওপর প্রভাব পড়ছে, অপর দিকে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, জুলাই-অক্টোবর চার মাসে পণ্য আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ১৯ হাজার ৬০৩ কোটি টাকা, এর বিপরীতে রফতানি আয় হয়েছে ১২ হাজার ৭২১ কোটি টাকা। অর্থাৎ মাত্র চার মাসে পণ্যবাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। এভাবে ঘাটতির পরিমাণ বাড়লে বছর শেষে পণ্য বাণিজ্য ঘাটতি ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।