একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ভোটের লড়াইকে রাজনৈতিক ভুল বলে মনে করছেন বিএনপি নেতারা। ওই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে তারা বলছেন, এবার আন্দোলন বলেন কিংবা নির্বাচন, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বেই সব কিছু করতে হবে। ২০১৮ সালের মতো আর নেতা ‘হায়ার’ করা যাবে না। ধারাবাহিক বৈঠকের দ্বিতীয় দিন গতকাল বুধবার গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে দলের মধ্যম সারির নেতারা নিজেদের মতামত জানান। অনেকে এ সময় প্রশ্ন করেন কার বুদ্ধিত্বে ড. কামাল হোসেনকে তখন হায়ার করা হয়েছিল?
বিকাল ৪টায় শুরু হয়ে বৈঠক চলে মধ্যরাত পর্যন্ত। যুক্তরাজ্য থেকে স্কাইপির মাধ্যমে যুক্ত হয়ে তারেক রহমান এতে সভাপতিত্ব করেন। পৌনে আট ঘণ্টাব্যাপী চলা ওই বৈঠকে অংশ নেওয়া ১১০ সম্পাদক ও সহসম্পাদকের মধ্যে বক্তব্য রাখেন ৬০ জন।
বৈঠক শেষে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রথম দিন (মঙ্গলবার) আমরা দলের ভাইস চেয়ারম্যান ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছি। আজ সম্পাদকম-লীর সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। আগামীকাল হবে দলের অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে। এর পর বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গেও রাজনৈতিক বিষয়ে ও বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনা করব। তা ছাড়া দলের নির্বাহী কমিটির সদস্যদের সঙ্গেও বৈঠক হতে পারে। তবে এটা এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। দলের স্থায়ী কমিটির শনিবারের সভায় এ বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব।’ এদিকে গতকালের বৈঠক সূত্রে জানা যায়, বিএনপির নেতারা বলেন, আগে সিদ্ধান্ত নিতে হবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে বিএনপি কোনো নির্বাচনে যাবে কি না। এর পর খালেদা জিয়ার মুক্তি, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ও নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবিতে আন্দোলনে নামারও সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আর এ দাবি আদায়ে কোনো রকম ছাড় দেওয়া যাবে না। আন্দোলনের বিকল্প নেই। সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়েই নামতে হবে। এবার আর কোনো রকম ব্যর্থ হওয়া যাবে না। বিগত আন্দোলনে কী কী ভুল ছিল তা চিহ্নিত করতে হবে। সেই ভুলগুলো এবার কোনো অবস্থাতেই করা যাবে না।
নেতারা এও বলেন, আন্দোলনে নামার আগে তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত নেতাকর্মীদের মাঝে একটি আত্মিক বন্ধন গড়ে তুলতে হবে। দেশের কোথাও কোনো নেতাকর্মী ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের মাধ্যমে নির্যাতনের শিকার হলে প্রতিবাদে ফেটে পড়তে হবে একযোগে। সেই সঙ্গে দলকে শক্তিশালী করতে বিএনপি এবং তার অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠনের সব পর্যায়ে যোগ্য ও ত্যাগী নেতাকর্মীদের কমিটিতে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। প্রতিটি কমিটি পূর্ণাঙ্গ করে সক্রিয় রাখতে হবে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, ছাত্রদল ও মহিলা দলকেও। পুনর্গঠন ও রাজপথে রাখতে অভিজ্ঞ নেতাদের দিয়ে করতে হবে সুপার ভিশন। পাশাপাশি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবিকে জনগণের দাবিতে পরিণত করতে ২০-দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে অটুট রেখে ডান-বামসহ সরকারবিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, পেশাজীবীসহ সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে।
বৈঠকে যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘নব্বইয়ের আন্দোলনে ছাত্রদল নেতাকর্মীদের মধ্যে এমন কোনো পরিকল্পনা ছিল না যে, এমপি-মন্ত্রী হব। প্রতিজ্ঞা ছিল স্বৈরাচারকে হটাতে হবে। এ জন্যই আন্দোলনে সফল হয়েছিল। কিন্তু এখন তো ছাত্রদলের বা অঙ্গ সংগঠনের থানা পর্যায়ের যদি যুগ্ম আহ্বায়কও হয় সেও বলে এ এলাকা থেকে আসলাম। এ এলাকা শব্দটা আগে ছিল না। এখন যুদ্ধে জয় হওয়ার আগেই যদি গনিওয়াতের মাল ভাগাভাগি করি, তা হলে তো ভাগাভাগির মধ্যেই থাকব; আন্দোলন হবে কীভাবে বা সংগঠনই হবে কীভাবে?’
বিএনপির বিশেষ সম্পাদক আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ২০১৮ সালে নেতৃত্ব হায়ার করা হয়েছিল। এটা সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল না। আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি হয়েছিলেন। তাকে কি আওয়ামী লীগ বাদ দিয়ে দিয়েছিল? না। আমাদের দলের প্রাণ বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান। তারা জাতীয়তাবাদী শক্তির প্রতীক। তাদের সামনে রেখেই আমাদের চলতে হবে। সরকারে গেলে কে প্রধানমন্ত্রী হবেনÑ এ প্রশ্ন কেন আসবে? আন্দোলনে সফল হলে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক মামলা টিকবে না, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও নিরাপদে দেশে ফিরতে পারবেন। তা হলে সমস্যা কোথায়? আমাদের তো নেতৃত্বের সংকট নেই। আমাদেরকে অন্যদের প্রয়োজন হতে পারে কিন্ত অন্যদেরকে আমাদের প্রয়োজন নেই। আন্দোলন-সংগ্রাম করে জনগণের ভোটেই আমরা ক্ষমতায় যেতে চাই। এর নেতৃত্ব দেবেন খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান। আমাদের নেতৃত্ব হায়ার করার কোনো প্রয়োজন নেই।’
সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বলেন, ‘হয় এস্পার, নয় ওস্পার। কারণ আমাদের নির্বাচন করতে দেয়নি। আবার এখন নতুন খেলা শুরু করেছে সরকার। আওয়ামী লীগের অধীনে আর কোনো নির্বাচন হবে না।’ বিএনপিকে তিনি এককভাবেই আন্দোলনে যাওয়ার পরামর্শ দেন। গণশিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক অধ্যক্ষ সেলিম ভূঁইয়া বলেন, ‘স্থায়ী কমিটির সদস্য ও জাতীয় নির্বাহী কমিটির ভাইস চেয়ারম্যানসহ যেসব পদ শূন্য রয়েছে তা দ্রুত পূরণ করতে হবে। তা ছাড়া আন্দোলনের বিকল্প নেই। কেননা উদার মন নিয়ে এ সরকারকে সরানো সম্ভব নয়।’ সহসম্পাদক শাহাবুদ্দিন সাবু বলেন, ‘আন্দোলন শুরুর আগে যেসব নেতারা দেশের বাইরে চিকিৎসা নেন, তাদের আগেই চিকিৎসা নিতে হবে। আন্দোলন চলাকালে সব নেতার পাসপোর্ট স্থায়ী কমিটির নেতাদের কাছে জমা দিতে হবে।’
রুদ্ধদ্বার বৈঠকের মূলমঞ্চে ছিলেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বরচন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান, সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু। বৈঠকে যুগ্ম মহাসচিবদের মধ্যে আরও অংশ নেন ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, মজিবুর রহমান সারোয়ার, খায়রুল কবির খোকন, হারুন অর রশীদ, হাবিব উন নবী খান সোহেল। সাংগঠনিক সম্পাদকদের মধ্যে ছিলেন ফজলুল হক মিলন, নজরুল ইসলাম মঞ্জু, মাহবুবের রহমান শামীম, বিলকিস জাহান শিরিন, আসাদুল হাবিব দুলু, সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, শামা ওবায়েদ, ডা. সাওয়াত হাসান জীবন, মোস্তাক মিয়া। সম্পাদকদের মধ্যে সালাহউদ্দিন আহমেদ, আনম এহছানুল হক মিলন, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, শিরিন সুলতানা, মাসুদ আহমেদ তালুকদার, অধ্যাপক ওবায়দুল ইসলাম, এবিএম মোশাররফ হোসেন, আজিজুল বারী হেলাল, আশরাফউদ্দিন উজ্জ্বল, লুৎফুর রহমান কাজল, আনিসুজ্জামান খান বাবু, রিয়াজুল ইসলাম রিজু, জয়নাল আবেদীন, নূরী আরা সাফা, ডা. রফিকুল ইসলাম, খালেদ মাহবুব শামল, এএমএ নাজিম উদ্দিন, সোহরাব উদ্দিন, মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল, জিকে গাউস, গৌতম চক্রবর্তী, আবুল কালাম আজাদ, শেখ ফরিদ আহমেদ মানিক, আসাদুজ্জামান আজাদ, মীর সরফত আলী প্রমুখ। সহসম্পাদকদের মধ্যে এবিএম আশরাফ উদ্দিন নিজান, দেওয়ান মো. সালাহউদ্দিন, মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল, আকন কুদ্দুসুর রহমান, আমিরুল ইসলাম আলীম, তাইফুল ইসলাম টিপু, মুনির হোসেন, বেলাল আহমেদ, ফাহিমা নাসরিন মুন্নী, রুমিন ফারহানা, অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, শহিদুল ইসলাম বাবুল, রওনকুল ইসলাম টিপু, ইকবাল হোসেন, মাহবুবুল হক নান্নু, হারুনুর রশীদ, শামীমুর রহমান শামীম প্রমুখ।