দেশ থেকে পণ্য রফতানি ধারাবাহিকভাবে কমছে। কমছে মেশিনারি এবং কাঁচামাল আমদানিও। কমে চলেছে অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্য বিক্রি। দেশে শিক্ষিতের হার ক্রমাগত বাড়লেও কর্মসংস্থানের সুযোগ বেড়েছে খুব সামান্যই। খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ার পাশাপাশি কমছে সাধারণ ব্যবসায়ীদের ঋণগ্রহণের প্রবণতা। কারণ দেশে নতুন করে উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে না। ব্যবসায়-শিল্প বাড়াচ্ছেন না বিদ্যমান উদ্যোক্তারাও। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, সীমাহীন বেকারত্ব, দেশী-বিদেশী বিনিয়োগে খরা, শেয়ারবাজারের দুরবস্থা, পরিবহন, বাসা ভাড়া ও শিক্ষা-চিকিৎসার ব্যয়বৃদ্ধিসহ সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থার কবলে পড়ে ব্যবসায় মন্দাভাবের সৃষ্টি হয়েছে। মন্দার কবলে পড়ে পুঁজি ভেঙে খাচ্ছেন সাধারণ ব্যবসায়ীরা। সবচেয়ে বেকায়দায় আছে কম পুঁজির ব্যবসায়ীরা।
রফতানিতে ধস : ব্যবসায়িক মন্দার চিত্র ফুটে উঠেছে রফতানিচিত্রে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) মাসিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত নভেম্বর মাসে দেশের রফতানি আয়ে বড় ধরনের ধস নেমেছে। এ মাসে রফতানি আয় আগের বছরের একই মাসের তুলনায় ১০ দশমিক ৭০ শতাংশ কমেছে। এ সময়ে কৌশলগত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আয় কমেছে ১৭ দশমিক ৯০ শতাংশ। আগের মাসেও রফতানি আয় ব্যাপকভাবে কমেছিল। ওই মাসে গত বছরের অক্টোবর মাসের তুলনায় রফতানি আয় কমেছিল ৬ দশমিক ৮২ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) গত বছরের একই সময়ের তুলনায় রফতানি খাতে আয় কমেছে সাড়ে ৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ। অন্য দিকে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১২ দশমিক ৫৯ শতাংশ কমেছে রফতানি আয়। গত পাঁচ মাসে তৈরী পোশাক খাতে এক হাজার ৩০৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা আয় হয়েছে, যা গত বছরের চেয়ে ৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ এবং লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ কম। গত বছর একই সময়ে এই খাতে আয় হয়েছিল এক হাজার ৪১৮ কোটি ৮২ লাখ টাকা। আলোচিত সময়ে ওভেন পোশাকে রফতানি আয় কমেছে ৮ দশমিক ৭৪ শতাংশ, আর নিট পোশাকে ৬ দশমিক ৭৯ শতাংশ। অন্য দিকে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় এই দুই খাতে আয় কমেছে যথাক্রমে ১৮ দশমিক ২০ ও ৮ দশমিক ৯৪ শতাংশ।
রাজস্ব ঘাটতি চরমে : ব্যবসায়িক মন্দার ফলে কমেছে রাজস্ব আদায়ও। করের আওতা এবং পরিমাণ বাড়িয়েও লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করছে পারছে না সরকারি সংস্থাগুলো। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো: মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া জানান, জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত রাজস্ব আহরণ হয়েছে ৬৫ হাজার ৯৬ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২০ হাজার কোটি টাকা কম। তবে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় রাজস্ব আদায় সাড়ে ৪ শতাংশ বেশি হয়েছে। এর মধ্যে কাস্টমসে রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ শতাংশ। ভ্যাট আদায়ে প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ৬৬ শতাংশ এবং আয়কর আহরণে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১১ দশমিক ৪৬ শতাংশ। তিনি বলেন, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের রাজস্ব প্রয়োজন। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই, এমসিসিআই, দোকান মালিক সমিতিসহ বিভিন্ন সংস্থার সাথে আলোচনা করা হয়েছে। এত কিছু করার পরও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব না আসা দুঃখজনক। তাই এখন থেকে কোনো টিআইএনধারী রিটার্ন দাখিল করেন না, তা খতিয়ে দেখা হবে। এত দিন ব্যবসায়ীদের প্রতি নমনীয় ছিল এনবিআর। এখন থেকে ভ্যাট আদায়ে রাজস্ব কর্মকর্তাদের কঠোর হওয়ার নির্দেশ দেয়া হবে।
বিনিয়োগে খরা : অর্থনৈতিক দুরবস্থার চিত্র ফুটে ওঠে বিনিয়োগচিত্র থেকেও। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) তথ্যানুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণ যেখানে ছিল এক হাজার ৩১ কোটি মার্কিন ডলার, সেখানে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে একই বিনিয়োগের পরিমাণ কমে হয়েছে মাত্র ৫২৫ কোটি মার্কিন ডলার। অর্থাৎ এক বছরের মধ্যেই বিদেশী বিনিয়োগ অর্ধেকে নেমে এসেছে। অথচ সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণের ক্ষেত্রে ওই অর্থবছরে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানে ছিল। একই অবস্থা বিরাজ করছে দেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও। বিডা জানায়, বিগত অর্থবছরে পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনায় অনেক কম বিনিয়োগ প্রস্তাব নিবন্ধন করা হয়েছে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এমন নি¤œমুখী স্থবিরতার কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বিশিষ্টজনেরা বলছেন, আগে রাজনৈতিক সঙ্ঘাত ও অনিশ্চয়তাকে বিনিয়োগ কমে যাওয়ার জন্য দায়ী মনে করা হতো। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গ্যাস ও বিদ্যুতের সংযোগ না পাওয়া এবং অবকাঠামোগত দুর্বলতাকে প্রধান কারণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে। পাশাপাশি রয়েছে জমি কেনা ও রেজিস্ট্রেশন করাসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতা। মাঝখানে বহু দিন পর্যন্ত শিল্প-কারখানায় গ্যাস ও বিদ্যুতের সংযোগ দেয়া হয়নি। এখনো সব শিল্প উদ্যোক্তাকে তাদের চাহিদা অনুযায়ী যথাসময়ে গ্যাস ও বিদ্যুতের সংযোগ দেয়া হচ্ছে না। ফলে দেশীয় উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন। তারা চলে যাচ্ছেন ভারত ও মালয়েশিয়াসহ অন্য দেশগুলোতে। একই কারণে এগিয়ে আসছেন না বিদেশী উদ্যোক্তারাও। কারণ দেশের ভেতরে বিনিয়োগ বাড়লে এবং উৎপাদনসহ বাধাহীন কার্যক্রম পরিচালনার ব্যাপারে নিশ্চয়তা পেলেই সাধারণত বিনিয়োগের জন্য বিদেশীরা এগিয়ে আসেন।
প্রতিযোগিতার ক্ষমতা কমছে : ব্যবসায়ীদের দুর্দশার চিত্র উঠে এসেছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা প্রতিবেদনেও। সদ্য প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১৪১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৫তম। আগেরবার অবস্থান ছিল ১০৩। প্রতিবেদন তৈরিতে ১২টি সূচক ব্যবহার করা হয়েছে। এসব সূচকের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০টিতেই পিছিয়েছে। মাত্র দু’টিতে এগিয়েছে। যেসব সূচকে বাংলাদেশ পিছিয়েছে, সেগুলো হলো সামষ্টিক অর্থনীতি, শ্রমবাজার, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, অবকাঠামো, দক্ষতা, প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, আর্থিক ব্যবস্থাপনা, ব্যবসায় বৈচিত্র্য, উদ্ভাবন এবং বাজারের আকার। প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়ার কারণ হিসেবে অবকাঠামো সমস্য, দক্ষ মানবসম্পদ গঠনের বিষয় এবং সুশাসনের অভাবের কথা জানান বিশ্লেষকরা।
সিন্ডিকেটের রাজত্ব : অনুসন্ধানে জানা যায়, সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করছে কয়েকজন ব্যবসায়ীর একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। বাকিরা বছরের পর বছর অপেক্ষা করেও কোনো কাজ পাচ্ছেন না। বিরাট অঙ্কের রাজস্ব আদায়ে সৎ ব্যবসায়ীদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ। সিটি করপোরেশন, এলজিইডি, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরসহ সরকারি বিভিন্ন অফিসে শত শত ব্যবসায়ী-সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান তালিকাভুক্ত থাকলেও কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। শক্তিশালী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পরিচিত কয়েকজনের মাঝেই বণ্টন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের টেন্ডার। সুদিনের আশায় বছরের পর বছর কাগজপত্র হালানাগাদকরণ, অফিস ব্যবস্থাপনা এবং কর্মচারীর বেতন দিতে দিতে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছে শত শত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। একসময়ের রমরমা ব্যবসায়ী এসব ঠিকাদারের এখন দিন কাটছে চরম দুর্দশায়। ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদহারের কারণে লোকসান গুনতে হচ্ছে সম্ভাবনাময় ব্যবসায়ও। বন্দরের অব্যবস্থাপনা, পদে পদে হয়রানি এবং ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজির শিকার হয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন সাধারণ ব্যবসায়ীরা। বাধ্য হয়ে ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন অনেকে।
মন্দাচিত্র মার্কেটগুলোয় : ব্যবসায়িক মন্দার চিত্র চোখে পড়ে মার্কেটগুলোয় গেলেও। আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে ব্যর্থ হয়ে প্রতিনিয়তই ব্যবসা ছেড়ে দিচ্ছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠত মার্কেটের দোকানিরাও। হাতবদলের পর কিছু দিন লোকসান গুনে নতুন দোকানিও গুটিয়ে নিচ্ছেন নিজেকে। ফলে মার্কেট-মহল্লায় নতুন নতুন ব্যবসায়ীর সংখ্যাই বেশি চোখে পড়ছে। সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছেন কম পুঁজির ব্যবসায়ীরা। তাদেরই একজন জীবনযুদ্ধে হিমশিম খাওয়া রাজধানীর খিলগাঁও তালতলা মার্কেটের ব্যবসায়ী সোলায়মান। ক্রেকারিজ মালামালের ব্যবসায় করেন তিনি। কথা প্রসঙ্গে জানালেন, কয়েক মাস থেকে ব্যবসায়ের অবস্থা খুবই খারাপ। বেচা-বিক্রি নেই বললেই চলে। সামনে শিশুদের নতুন বছরে ভর্তি ফি,বইপত্র কেনাসহ সম্ভাব্য খরচ কোত্থেকে জোগাড় করবেন সে বিষয়ে চরম দুশ্চিন্তার কথা জানালেন তিনি। ব্যবসায় মন্দার ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, গত রোজার ঈদের আগে থেকে যা বিক্রি হয় তাতে দোকান খরচই আসে না। বাসা ভাড়া, বাজার খরচ, চিকিৎসা ব্যয় এবং শিশুদের পড়াশোনার খরচ চলছে দোকানের পুঁজি ভেঙে।
কথা প্রসঙ্গে সোলায়মান জানান, তার একার নয়, মার্কেটের সবার ব্যবসায়ই মন্দাবস্থা চলছে। আয়-ব্যয়ের হিসেব মেলাতে ব্যর্থ হয়ে গত কয়েক বছরের অর্ধেকের বেশি দোকানদার ব্যবসায় ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। যাদের নিজস্ব দোকান তারা ভাড়া দিয়ে দিয়েছেন। মাস শেষে ভাড়া তুলে খাচ্ছেন। তাতেও ভালো, লোকসান কম হচ্ছে। তার কাছে প্রশ্ন ছিল, এসব দোকান নতুন করে ভাড়া নিচ্ছেন কারা? জবাবে সোলায়মান বলেন, মানুষের হাতে তো কাজ নেই। ধনের একজন লোক বিদেশ থেকে ফেরত এসেছেন। হাতে কিছু টাকা আছে। ওই টাকা দিয়ে অনেক বড় আশা নিয়ে একটি দোকান ভাড়া নিয়ে ব্যবসায় শুরু করেছেন। কিছু দিন পর টের পেলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য নেই। দিনদিন পুঁজি কমে যাচ্ছে। এভাবে এক দিন পুঁজি হারিয়ে তিনিও দোকান বন্ধ করে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
ব্যবসায়ী নেতার মূল্যায়ন : আলাপ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি এবং এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সহসভাপতি মো: হেলাল উদ্দিন নয়া দিগন্তকে বলেন, সাধারণ মানুষের হাতে টাকা নেই। টাকা চলে গেছে অল্প কিছু মানুষের হাতে। তারা কেনাকাটা করেন বিলাসবহুল মার্কেটে কিংবা বিদেশে। ফলে সাধারণ মানের মার্কেটগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। অন্য দিকে ঢাকার মার্কেটগুলোয় দোকানভাড়া অনেক বেশি। বিদ্যুৎ বিল বাড়তে বাড়তে আকাশ ছুঁয়েছে। সার্ভিস চার্জসহ অন্যান্য খরচও বাড়তি। এসব কারণে বেশির ভাগ দোকানদার লোকসান দিয়ে পেশা টিকিয়ে রেখেছেন। অন্য কিছু করার সুযোগ নেই বলে দোকানদারি করছেন। কর্মসংস্থান না থাকায় প্রতিনিয়ত নতুন নতুন লোক ব্যবসায় আসছেন এবং লোকসান দিয়ে ব্যবসায় গুটিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। পরিস্থিতি মোকাবেলায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক সংস্কারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।