আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে দলের ১১ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। এ লক্ষ্যে ধারাবাহিকভাবে সংগঠনগুলোর কমিটি ভেঙে দেওয়া হবে। গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে টানা তিন দিনের সিরিজ বৈঠকের পর দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অবশ্য কয়েক মাস আগে কৃষক দল এবং গত রবিবার জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক সংস্থা জাসাসের কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়। তবে দুই সংগঠনের কেন্দ্রীয় পূর্ণাঙ্গ কমিটি এখনো হয়নি। ছাত্রদলের মেয়াদ শেষ হয়েছে গতকাল ১৮ সেপ্টেম্বর। মহিলা দল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, শ্রমিক দল, মৎস্যজীবী দল, তাঁতী দল, মুক্তিযোদ্ধা দল, ওলামা দল- এসব অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে কয়েক বছর আগে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহাজাহান আমাদের সময়কে বলেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সবার মতামতের ভিত্তিতে যে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। আর দল পুনর্গঠন একটি চলমান প্রক্রিয়া। দলকে শক্তিশালী করতে যখন যা করা দরকার, সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে দল।
সংগঠনগুলোর পদপ্রত্যাশীরা জানান, প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিবেশ ও করোনা পরিস্থিতির পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবে ঝিমিয়ে পড়েছে সংগঠনগুলোর কার্যক্রম। এর মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণের পরও নতুন কমিটি গঠন না হওয়ায় নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে। কমিটি বাণিজ্যেরও ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে কারও কারও বিরুদ্ধে। সম্প্রতি দলের সিরিজ বৈঠকেও ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটি গঠনের জন্য গঠিত টিমের সদস্যদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আনা হয়েছে বিএনপির নির্বাহী কমিটির বৈঠকে। সিরিজ বৈঠকে মহিলা দলের নেতৃত্বে অতিমাত্রায় গ্রুপিংয়ের কথাও উঠেছে এসেছে। এ নিয়ে দলের নীতিনির্ধারকরা বেশ বিব্রত। এ ছাড়া শ্রমিক দল, মৎস্যজীবী দল, তাঁতী দল, মুক্তিযোদ্ধা দল, ওলামা দল কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এসব সংগঠনের কোনো কার্যক্রম নেই বলে সিরিজ বৈঠকে অভিযোগ করেন নেতারা।
দলের নীতিনির্ধারকদের সূত্রে জানা যায়, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের দাবিতে দেশের বিরোধী সব রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে জোটগত এবং যুগপৎ আন্দোলন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটি। আন্দোলেন নামার আগে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনকে ঢেলে সাজানোরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সিরিজ বৈঠকে দলের নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে, কোনো কারণে আন্দোলন সংগ্রামে না থাকতে পারলে পদ ছেড়ে দিতে হবে। কেউ-ই পদ ধরে রাখতে পারবে না।
এদিকে জাতীয় নির্বাহী কমিটির শেষ দিনের বৈঠকে দলের নীতিনির্ধারকদের বক্তব্য ও অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠনের কমিটি গঠনের খবরে সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদ পেতে নানাভাবে লবিং-তদবির শুরু করেছেন পদপ্রত্যাশীরা।
কৃষক দল : দীর্ঘ ২২ বছর পর গত ১২ মার্চ অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে শামসুজ্জামান দুদু ও হাসান জাফির তুহিন নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের কমিটি বিলুপ্ত করা হলেও এখন পর্যন্ত কমিটি করা সম্ভব হয়নি। সংগঠনটির সভাপতি হিসেবে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু অথবা হাবিব-উন নবী খান সোহেলের নাম রয়েছে হাইকমান্ডের ভাবনায়। এ ছাড়া সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আলোচনায় আছেন ডাকসুর সাবেক এজিএস নাজিম উদ্দিন আলম, প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রশিদ হাবিব, সহপ্রচার সম্পাদক শামীমুর রহমান শামীম, কৃষক দলের সাবেক সদস্য সচিব হাসান জাফির তুহিন, সাবেক কৃষক দল নেতা মাইনুল ইসলাম ও তকদীর হোসেন জসীম। তবে একটি প্রভাবশালী অংশ দলের প্রশিক্ষণবিষয়ক সম্পাদক এবিএম মোশাররফ হোসেন ও কৃষক দলের সাবেক সদস্য সচিব হাসান জাফির তুহিন সাধারণ সম্পাদক করতে নানা মাধ্যমে চেষ্টা চালাচ্ছেন।
মহিলা দল : আফরোজা আব্বাসকে সভাপতি ও সুলতানা আহমেদকে সাধারণ সম্পাদক করে ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর মহিলা দলের আংশিক কমিটি গঠন করা হয়। গত বছরের ৪ এপ্রিল পূর্ণাঙ্গ করা হয়। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে আলোচনায় আছেনÑ শিরীন সুলতানা, রেহানা আক্তার রানু, নিলোফার চৌধুরী মনি, সুলতানা আহমেদ, হেলেন জেরীন খান, বিলকিস ইসলাম, নায়াবা ইউসুফ প্রমুখ।
যুবদল : সাইফুল আলম নীরবকে সভাপতি ও সুলতান সালাউদ্দিন টুকুকে সাধারণ সম্পাদক করে ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি পাঁচ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। মেয়াদ শেষ হওয়ার প্রায় এক মাস পর ১১৪ সদস্যের আবার আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় কমিটি পূর্ণাঙ্গ করতে পারেনি সেই নেতৃত্ব। দলের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, যুবদলের আংশিক কমিটি পূর্ণাঙ্গ হতেও পারে, নাও পারে। পূর্ণাঙ্গ করা হলেও দ্রুত সময়ের মধ্যে ওই কমিটি বিলুপ্ত করে নতুন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাকের নাম ঘোষণা করা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে নেতাকর্মীদের কাছে আলোচনায় আছেন যুবদলের বর্তমান কমিটির সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু, নুরুল ইসলাম নয়ন, এসএম জাহাঙ্গীর হোসেন, মামুন হাসান, আবদুল মোনেম মুন্না, গোলাম মাওলা শাহীন, জাকির হোসেন নান্নুু। এ ছাড়া ছাত্রদলের সাবেক ছাত্রনেতা আমিরুল ইসলাম খান আলিম, হাবিবুর রশীদ হাবিব, আনিসুর রহমান তালুকদার খোকন, রাজীব আহসান, আকরামুল হাসান আলোচনায় আছে।
স্বেচ্ছাসেবক দল : ২০১৬ সালের ২৭ অক্টোবর শফিউল বারী বাবুকে সভাপতি ও আবদুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েলকে সাধারণ সম্পাদক করে স্বেচ্ছাসেবক দলের পাঁচ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। মেয়াদ শেষের এক বছর পর গত বছর কমিটি পূর্ণাঙ্গ করা হয়। গত বছর করোনা আক্রান্ত হয়ে সংগঠনের সভাপতি শফিউল বারী বাবুর মৃত্যুর পর নতুন কমিটি গঠনের বিষয়টি আলোচনায় আসে। নতুন কমিটিতে সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আবদুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েল, বজলুল করিম চৌধুরী আবেদ, সাইফুল ইসলাম ফিরোজ, ইয়াসিন আলী, ওবায়দুল হক নাসির, ফকরুল ইসলাম রবিনসহ বেশ কয়েকজনের নাম আলোচনায় আছে।
ছাত্রদল : ২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বরের কাউন্সিলে ফজলুর রহমান খোকন সভাপতি ও ইকবাল হোসেন শ্যামল সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিন মাস পর ৬০ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। এই অবস্থায় সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পদে আলোচনায় আছেন ইকবাল হোসেন শ্যামল, রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ, সাইফ মাহমুদ জুয়েল, আমিনুর রহমান আমিন, শাহনেওয়াজ, তানজিল হাসান, রিয়াদ মো. ইকবাল হোসেন, রাকিবুল ইসলাম রাকিব, মো. আমানউল্লাহ আমানসহ বেশ কয়েকজন।
জাসাস : অধ্যাপক মামুন আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক চিত্রনায়ক হেলাল খানের নেতৃত্বে ২০১৭ সালের ১৯ জানুয়ারি জাসাসের কমিটি ঘোষণা করা হয়। গত রবিবার এ কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। নতুন কমিটিতে পদ পেতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আলোচনায় রয়েছেন রেজাবুদ্দৌলা চৌধুরী, এমএ মালেক, হেলাল খান, জাহাঙ্গীর শিকদার জাকির হোসেন রোকন, রফিকুল ইসলাম রফিক, ইথুন বাবু প্রমুখ। এর বাইরে সংগীতশিল্পী আসিফ আকবরকে নিয়ে দলের একটি অংশ চিন্তা করছেন। সম্প্রতি সিরিজ বৈঠকে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুল হাই শিকদার দলের নীতিনির্ধারকদের উদ্দেশ্যে বলেন, মৃত্যু জাসাসকে আপনারা কমিটি বিলুপ্ত করে দাফন করেছেন। যোগ্য নেতৃত্বের হাতে ভার দিয়ে কবর থেকে টেনে তুলুন।
মৎস্যজীবী দল : ২০১৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ১০ বছরের মেয়াদোত্তীর্ণ মৎস্যজীবী দলের কমিটিকে ভেঙে সংগঠনের সাবেক সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম মাহতাবকে আহ্বায়ক ও আবদুর রহিমকে সদস্য সচিব করা হয়। মেয়াদোত্তীর্ণ এ কমিটিও নিষ্ক্রিয়।
ওলামা দল : ২০১৯ সালের ৫ এপ্রিল সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাওলানা শাহ মো. নেছারুল হককে আহ্বায়ক এবং মাওলানা নজরুল ইসলাম তালুকদারকে সদস্য সচিব করে ১৭১ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। শুধু মিলাদ মাহফিলের মধ্যেই সংগঠনের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ।
শ্রমিক দল : ২০১৪ সালের এপ্রিলে শ্রমিক দলের কাউন্সিলে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হলেও মেয়াদোত্তীর্ণ অভ্যন্তরীণ কোন্দল-গ্রুপিংয়ে হযবরল অবস্থা।
এর বাইরে মুক্তিযোদ্ধা দলের কমিটিও মেয়াদোত্তীর্ণ এবং তাঁতী দলের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হলেও তার কোনো তৎপরতা নেই। মুক্তিযোদ্ধা দল ইশতিয়াক আজিজ উলফাত ও সাদেক আহমেদ খান ছাড়া কাউকে কোনো কার্যক্রমে দেখা মেলে না। তাঁতী দলের আবুল কালাম আজাদ ছাড়া বাকিরা নিষ্ক্রিয়। এরই মধ্যে এই সংগঠন থেকে পদত্যাগ করেছেন সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্যক্ষ বাহাউদ্দিন বাহার।