স্বাধীনতার সময় আমার বয়স ছিল সাত বছর। ফলে মুক্তিযুদ্ধের ২-৩ বছর আগের সামাজিক পরিস্থিতি আমার বেশ মনে আছে। বাবা ছিলেন থানা শিক্ষা কর্মকর্তা। সেই সূত্রে আমরা থানা পর্যায়ে বসবাস করতাম। পারিবারিকভাবে আমার পরিবারে নামাজ-রোজা করার রেওয়াজ ছিল ছোটবেলা থেকেই। সে থেকে আমিও বাদ যাইনি। কিন্তু আমরা কখনো নিজেদের ধর্মপ্রাণ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার কোনো বাসনা পোষণ করিনি। নিজেকে কোনো একটি ধর্মের পরিচয়ে পরিচিত করার কোনো আকাঙ্ক্ষা কখনো জাগেনি। অন্য ধর্মের মানুষও পর মনে হয়নি। এটা শুধু আমার উপলব্ধিই নয়, বরং সে সময়কার পরিবেশটাই এ রকম ছিল। বাবার অফিসের এক পিয়ন চাচা আমাকে দুর্গা প্রতিমা দেখাতে নিয়ে গেলেন ১৯৭০ সালে। সেটাই আমার প্রথম সাক্ষাৎ প্রতিমা দর্শন। ১৫-২০ মিনিট পূজামণ্ডপ ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম আর ঢাকের তালে তালে মনটা কিছুটা নেচে উঠছিল। বাসায় ফিরে সবার সঙ্গে অনুভূতির কথা শেয়ার করলাম। এ ক্ষুদ্র পরিক্রমার কোথাও কোনো আশঙ্কার বালাই ছিল না, ছিল না কোনো আতঙ্কের বিষয়। সে বয়সে এটা বুঝতে পেরেছিলাম, দুর্গাপূজা হলো হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি উৎসব। কিন্তু উৎসব পালনকারীদের ‘হিন্দু’ মনে হয়নি। নিজের সঙ্গে তাদের পার্থক্য করার মতো কোনো চারিত্রিক উপাদান খুঁজে পাইনি।
ধর্মের ভিত্তিতে সৃষ্টি হওয়া পাকিস্তানের শেষদিকটাতে সমাজের এমনই চিত্র ছিল। এর পরের বছরই মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিম পাকিস্তানিদের দ্বারা শোষিত, নির্যাতিত, বঞ্চিত বাঙালির বেঁচে থাকার শেষ লড়াই ছিল আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধ। যেহেতু আর্থসামাজিক বৈষম্যই আমাদের অস্তিত্বকে ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিয়েছিল, তাই মুক্তিযুদ্ধের সনদপত্রে তার উল্লেখ পাওয়া যায়। স্বাধীন বাংলাদেশ কোন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামনে রেখে পরিচালিত হবে, এর উত্তর পাওয়া যায় সনদে-সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার। ধর্মের বিষয়ে পৃথকভাবে কিছু বলা হয়নি। এর অর্থ দাঁড়ায়, ইচ্ছা করলে কেউ ধর্ম পালন করতে পারে, ইচ্ছা করলে নাও করতে পারে। এ ব্যক্তিগত বিশ্বাসে রাষ্ট্র কোনো হস্তক্ষেপ করবে না। তবে এমন কোনো কাজ করা যাবে না যার দ্বারা অসাম্য সৃষ্টি হয়; যার দ্বারা মানবিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয় এবং যার দ্বারা সামাজিক ন্যায়বিচার বাধাগ্রস্ত হয়। আজকের বাংলাদেশে স্বাধীনতা সনদের মূলমন্ত্রের কোনোটাই আর অক্ষত নেই বরং ক্ষতবিক্ষত।
সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার-১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে বর্তমান সংবিধান গ্রহণের আগ পর্যন্ত এ তিনটিই ছিল রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি, যেখানে ধর্মের বিষয়ে কোনো উল্লেখ নেই। ’৭২ সালে প্রণীত ও গৃহীত সংবিধানে ধর্মের বিষয়ে কিছুটা আভাস দেওয়া হয়েছে। মূলনীতিতে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি সংযোজিত হয়েছে, যা আজও বর্তমান। এ ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র আভিধানিক অর্থ যাই হোক না কেন, ব্যাবহারিক অর্থ হলো সব ধর্মের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারবে। কোনো ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের জন্য অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে না। এমন একটা পরিবেশ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের আগ পর্যন্ত পাওয়া গেছে। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর থেকে রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে আবারও ধর্মীয় ফ্লেভারটা ছড়াতে শুরু করে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত ৪৫ বছরে যত সরকার এসেছে, কোনো সরকারের আমলেই সংখ্যালঘুরা নিরাপদে থাকেনি বরং দিনকে দিন এ যেন নতুন মাত্রা পাচ্ছে। এটা যে খুব শিগগিরই দূর হবে, এমনটাও ভাবা যাচ্ছে না। কেননা যেহেতু সমস্যাটা শাসন পদ্ধতিতে, আর শাসন পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া যেহেতু শিগগিরই পরিবর্তিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই, তাই সমস্যার সমাধানটাও দূরসাধ্য। সমাজকে বিভাজিত করে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়া কিংবা রাষ্ট্রক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখাই হলো আজকের শাসন পদ্ধতি, যা ‘শোষণ’ পদ্ধতিও বটে। আমরা কোনো সাম্প্রদায়িক ঘটনার পর কেবল প্রাণহানি এবং পূজামণ্ডপ কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হলো, এর হিসাবটা রাখতে পারি; কিন্তু ওই সম্প্রদায়ের মানুষের, বিশেষ করে নারী ও শিশুদের ওপর মানসিক অসহায়ত্বের যে চাপ সৃষ্টি হয় এবং তা থেকে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়, এর হিসাবটা করতে পারি না। করতে পারলে দেখা যেত এর পরিমাণ অনেক বেশি।
এ বছর দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে কুমিল্লা, চৌমুহনী, পীরগঞ্জ, চাঁদপুরসহ সারা দেশে যে ন্যক্কারজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো তাতে দুঃখ পেয়েছি, কষ্ট পেয়েছি, ব্যথিত হয়েছি, লজ্জিত হয়েছি, ক্ষুব্ধ হয়েছি; কিন্তু বিস্মিত হইনি। কারণ সাম্প্রদায়িক ইস্যুগুলো এখন ধর্মীয় বিশ্বাসের বাইরে গিয়ে রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। কুমিল্লার ঘটনাই এর প্রমাণ। কোনো ধর্মপ্রাণ মুসলমানই এ কাজটি করতে সাহস পাবে না, একইভাবে কোনো ধর্মপ্রাণ হিন্দুও কাজটি করবে না। তাহলে এ দুই ধর্মপ্রাণ মানুষের মাঝখানে তৃতীয় কোনো মানুষের অনুপ্রবেশ ঘটেছে, যারা রাজনৈতিক স্বার্থে পরিচালিত। এখানে সরকার আর বিরোধী দল বলে কথা নেই। সাম্প্রতিক ঘটনা নিয়ে সারা দেশ এখন প্রতিবাদে তোলপাড়। বলা হচ্ছে, সাম্প্রদায়িকতা রুখে দাঁড়াও। এটা এখন একটা দায়সারা বুলি হয়ে গেছে। যে পরিমাণ প্রতিবাদ আমরা প্রত্যক্ষ করছি, এর একটি ক্ষুদ্র অংশ যদি আন্তরিক হতো, তাহলে এরকম জঘন্য ঘটনার জন্ম হতো না। সরকারি দল বারবার বিরোধী দলের দিকে আঙুল তাক করছে, বিরোধী দল করছে সরকারের দিকে। এতে আমরা সন্তুষ্ট নই। সরকারি দলের দায়িত্ব ছিল নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সে হিসাবে স্বীকার করতে হবে যে, দায়িত্ব পালনে তারা অক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে। কারও ঘারে দোষ চাপানো নয়, আমরা চাই সংখ্যালঘুদের একশ ভাগ নাগরিক অধিকার, ধর্মীয় অধিকার, অর্থনৈতিক অধিকার, রাজনৈতিক অধিকারের নিশ্চয়তা। এটা যে ধরনের সরকার দ্বারা সম্ভব হবে, আমরা সে ধরনের সরকারই চাই।
বর্তমান সরকারকে অনেকেই অসাম্প্রদায়িক মানসিকতার সরকার বলেই জ্ঞান করে থাকেন এবং এ বিষয়ে কমবেশি ভরসাও করে থাকেন। সাম্প্রতিক ঘটনাবলি সে বিশ্বাসে চিড় ধরিয়েছে। যাদের আমরা মৌলবাদসংশ্লিষ্ট সরকার বলতাম, তাদের চেয়ে ব্যতিক্রমী ভূমিকায় এ সরকারকে দেখা যায়নি। এ বিষয়ে মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামালের বক্তব্য হলো, ‘এবার দেখা গেল, আগের মতোই মোটামুটিভাবে আক্রমণকারীরা একই কৌশল অবলম্বন করেছে-নিজেরাই অপরাধের ক্ষেত্র তৈরি করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তা ছড়িয়ে দেওয়া, ধর্মীয় স্থাপনাকে ব্যবহার এবং সন্ত্রাসকে হাতিয়ার করে নির্বিচারে ‘টার্গেট’ জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা করা। এসব ঘটনায় সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিরোধমূলক নিরাপত্তা বিধানে গাফিলতি, অদক্ষতা ও উদাসীনতা প্রকটভাবে দৃশ্যমান। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরও নির্বাচিত প্রতিনিধি, প্রশাসন এবং ক্ষমতাসীন দলের সদস্যদের ঘটনাস্থলে ছুটে না যাওয়ার রীতি এবারও বহাল। কেউ এ ঘটনায় বিচলিত হয়েছেন বলে তাদের ভাষা বা ভাব-ভঙ্গিতে মনে হয় না।’
অনেকেই মনে করেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতিই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তির কারণ। সরকারকে এ সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তা না হলে কেবল মুখের কথায় কল্যাণকর কিছু হবে না।
মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়