৭১-এ আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে কলিকাতায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও ‘চরমপত্র’ অনুষ্ঠান পরিচালনাকারী স্বনামধন্য এম আর আখতার মুকুলের লেখা পরবর্তীকালের অনেক বই পাঠক প্রলোভিত। ‘চল্লিশ থেকে একাত্তর’ নামীয় বইটিতে ঐতিহাসিক কিছু তাত্ত্বিক সত্যের ব্যত্যয় ঘটাগুলোর উল্লেখ করা হলো।
ক) বইটির ২৩ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘‘২১ মার্চ ১৯৪৮ এ ঢাকার রেসকোর্সে মি. জিন্নাহ যখন বললেন, উর্দু-কেবলমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, তখন ঐ জনসভাতেই শেখ মুজিবুর রহমানসহ বাংলাভাষার সমর্থক একদল ছাত্র সম্মিলিতভাবে ‘না না’ ধ্বনিতে প্রতিবাদ জানায়।’ পক্ষান্তরে, তখন ঢাকায় জিন্নাহর কোনো বক্তৃতায়ই শেখ সাহেবের এহেন প্রকাশ্য প্রতিবাদ স্বয়ং তার কথায়ই অস্বীকৃত। তিনি তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইটির ৯৯ পৃষ্ঠায় বলেছেন, ‘‘ঘোড়দৌড় মাঠে বিরাট সভায় ঘোষণা করলেন (ঐ কথা)। আমরা প্রায় চার-পাঁচশত ছাত্র এক জায়গায় ছিলাম সেই সভায়। অনেকে হাত তুলে দাঁড়িয়ে জানিয়েছিল, ‘মানি না’। তার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশন বক্তৃতা করতে উঠে তিনি যখন আবার বললেন (ঐ একই কথা)- তখন ছাত্ররা তার সামনেই বসে চিৎকার করে বলল, ‘না না না’।” এর ২১৭ পৃষ্ঠায় এ-ও বলেছেন, “আমরা যে উর্দু ও বাংলা দুটাই রাষ্ট্রভাষা চাই, এ ধারণা তাদের ছিল না। তাদের বলা হয়েছে: শুধু বাংলাকেই রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করছি আমরা।’ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, জিন্নাহর বক্তৃতার সারকথা ছিল প্রাদেশিক ভাষা যার যার পছন্দ মতে নির্ধারণ করবে এবং প্রদেশসমূহের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে কেবলমাত্র উর্দু। ১৯৪৭ সালে বিভাজ্য ভারতে উর্দুকে সরকারি চাকরিসহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল এবং হিন্দির সাথে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়া হয় সংস্কৃতকে, যাতে (১৯৭০ সালের পরিসংখ্যান মতে) গোটা ভারতে মাত্র তিন হাজার লোকে কথা বলে। পরিশেষে নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদ ও আবেদনে কয়েক বছর পরে তা প্রত্যাহার করে উর্দুকে ১৫তম রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দেয়া হয় ভারতে।
খ) ২৪ পৃষ্ঠায় ‘পাকিস্তানের মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, লিয়াকত আলী খান এবং পূর্ব বাংলার খাজা নাজিমউদ্দিন-সবাই উর্দুভাষী’ বলা হয়েছে। অথচ একমাত্র খাজা নাজিমউদ্দিন ব্যতীত লিয়াকত আলী খানের ভাষা পাঞ্জাবি এবং জিন্নাহর মাতৃভাষা গুজরাটি, যাতে জিন্নাহ শব্দের অর্থ ‘পাতলা’।
গ) ৮৭-তে, ১৯৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাকে ‘তথাকথিত’ বলা হয়েছে। অবশ্য বইটি ১৯৮৫ সালে লেখারও ২৬ বছর এবং মামলাটির ৪৩ বছর পরে এর ২৬ নং অভিযুক্ত কর্নেল (অব:) শওকত আলী জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার থাকাকালে এর সত্যতা স্বীকারে ২০১১ সালে প্রকাশ করেন “সত্য মামলা আগরতলা” নামক বই। তবে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের ১০ বছর পরেই ১৯৮১ সালে দিল্লিতে প্রকাশিত অশোক রাইনার Inside RAW তে সর্বপ্রথম এর সত্যতা স্বীকার করা হয়।
ঘ) ৯৩ ও ৯৭ পৃষ্ঠা মতে, ‘বাংলাদেশে রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে প্রচণ্ড ধরনের মার খাওয়ার পর ১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেন যে, আর ১০ দিনের মধ্যে আমি এই রাওয়ালপিণ্ডিতে নাও থাকতে পারি। আমি তখন যুদ্ধ করব। কৌশলগত কারণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে পাক-ভারত যুদ্ধে রূপান্তরিত করার লক্ষ্যে ৩ ডিসেম্বর তৎকালীন পাকিস্তান বিমান বাহিনী হঠাৎ করে একযোগে ভারতের ছ’টি বিমান ঘাঁটিতে হামলা করলে দ্রুত যুদ্ধের ব্যাপ্তি লাভ করে।”
ভারত সরকারের প্রকাশিত ১৯৭২ সালের ‘বাংলাদেশ ডকিউমেন্টস’ নামক দ্বিতীয় খণ্ডের ২০৫ পৃষ্ঠায় PAKISTAN DECLARES WAR শিরোনামে দেয়া হয়েছে রোজকার যুদ্ধের অতি সংক্ষিপ্ত ও ধারাবাহিক বর্ণনা। এই ৩ তারিখে ইয়াহিয়া খানের যুদ্ধ করার ঐ ইচ্ছার উদ্ধৃতিসহ বিকাল ৫.৪৫ মিনিটে ভারতের ৮টি বিমান ঘাঁটিতে পাকিস্তানি আক্রমণের পাল্টা জবাবে রাত ১১.৪৫ মিনিটে ভারতও বিমান আক্রমণ চালায়। পরের দিন ৪ ডিসে: ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ‘Today war in Bangladesh has become a war on India… In the eastern sector, Indian troops move into Bangladesh at several points, and in concert with the Mukti Bahini, liberate many areas.’ (বাংলাদেশের ভিতরের যুদ্ধ হয়েছে আজ ভারতের উপরের যুদ্ধ… পূর্বাঞ্চলের অনেক পয়েন্টে ভারতীয় সেনারা বাংলাদেশের ভিতরে প্রবেশ করেছে এবং মুক্তিবাহিনীর সাথে যৌথভাবে অনেক অঞ্চল মুক্ত করেছে।)
এই একই ৪ তারিখের ও একই খণ্ডের ২২৩-২৪ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত রয়েছে WORLD PRESS AND PUBLIC OPINION, THE WAR THAT THREATENS THE WORLD শিরোনামে লন্ডনস্থ দি ডেইলি মিরর পত্রিকায় জন পিলজারের এ সংক্রান্ত রিপোর্টের মতে, ‘She hit back at the Pakistan army in a border action designed to give the Bangladesh guerrillas some chance against the super Pakistani fire power. This was not altogether successful, but still India held back…India, having moved its forees into Bangladesh, would be cast into the role of aggressor. Mrs. Gandhi has just said: ‘If any country thinks that by calling us aggressor it can press us to forget our national interest, then that country is living in its own fool’s paradise.” (উচ্চতর পাকিস্তানি গোলাবর্ষণ ক্ষমতার বিপরীতে বাংলাদেশী গেরিলাদের একটা সুযোগ করে দেবার মতলবে সে (ভারত) সীমান্তে পাকিস্তানি সেনাদের পাল্টা আঘাত করে। এটা সম্পূর্ণ সফল হয় নাই, কিন্তু ভারত এখনো ইতস্তত করছে।….. বাংলাদেশের ভিতরে সেনাবাহিনী প্রবেশ করিয়ে ভারত আক্রমণকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে।….. মিসেস গান্ধী এই মাত্র বলেছেন, ‘যদি কোনো দেশ আমাদের জাতীয় স্বার্থ ভোলাতে আমাদেরকে আক্রমণকারী বলাকে চাপ মনে করে, তবে সে দেশ তার নিজের বোকার স্বর্গে বাস করছে।’) অতএব, সীমান্ত থেকে আমাদের গেরিলাদের ঢোকাবার সহায়তায় ভারতীয় পাল্টা গোলাগুলির চলমান এই অবস্থার একপর্যায়ে পাকিস্তানের যুদ্ধ ঘোষণা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে কৌশলগত কারণে পাক-ভারত যুদ্ধে রূপান্তরিত করা হয়েছে বলে সঙ্গত কোনো যুক্তি আছে বলে মনে করা যায় কি?