বছরখানেক আগেও আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে (কলমানি মার্কেট) সুদহার ছিল দুই শতাংশের নিচে। টাকার চাহিদা কম থাকায় প্রতিটি ব্যাংকের হাতেই উদ্বৃত্ত অর্থ ছিল; কিন্তু আমানত-প্রবাহ কমে যাওয়ার পাশাপাশি ডলারের বিপরীতে টাকা উত্তোলন করায় বাজারে নগদ টাকার প্রবাহে টান পড়েছে। দৈনন্দিন ব্যয় মেটাতে তাই সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলো নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে কলমানি মার্কেটের ওপর। এ সুযোগটি কাজে লাগাচ্ছে বাড়তি অর্থ হাতে থাকা ব্যাংকগুলো। তারা প্রতিনিয়তই সুদহার বাড়িয়ে দিচ্ছে। এক বছর আগেও যেখানে কলমানি মার্কেটের সুদহার ছিল ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ, এখন তা বেড়ে হয়েছে ৪ দশমিক ৪২ শতাংশ। যেখানে ব্যাংক রেট রয়েছে ৪ শতাংশ। এ হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে কলমানি মার্কেটে সুদহার বেড়েছে ১২৬ দশমিক ২৬ শতাংশ। কলমানি মার্কেটের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া ব্যাংকগুলো অনেকটাই এখন চাপে পড়ে গেছে। তহবিল ব্যবস্থাপনায় অনেকেই এখন হিমশিম খাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিশেষ তহবিল সহায়তা দেয়া না হলে অনেকেরই সঙ্কট আরো ঘনীভূত হবে বলে ব্যাংকাররা জানান।
কলমানি মার্কেট হলো কোনো ব্যাংকে নগদ টাকার সঙ্কট দেখা দিলে অন্য ব্যাংক থেকে ধার নেয়া- এভাবে নিজেদের মধ্যে নগদ টাকার লেনদেনকেই কলমানি মার্কেট বলে। চাহিদার ভিত্তিতে কলমানি মার্কেটে সুদহার ওঠানামা করে। অর্থাৎ টাকার চাহিদা বেশি আর সে তুলনায় সরবরাহ কম থাকলে কলমানি মার্কেটে সুদহার বেড়ে যায়। আবার সরবরাহ বেশি থাকলে ও চাহিদা কম থাকলে সুদহার কমে যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত বছরের ১৭ নভেম্বর কলমানি মার্কেটের সুদহার ছিল ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ। গত ৩০ জুনে তা সামান্য বেড়ে হয় ২ দশমিক ২৩ শতাংশ। ৩১ অক্টোবর তা সামান্য বেড়ে হয় ২ দশমিক ৩৩ শতাংশ। কিন্তু গত ১৭ নভেম্বর তা এক লাফে দ্বিগুণ বেড়ে হয় ৪ দশমিক ৪২ শতাংশ। এক বছরের ব্যবধানে কলমানি মার্কেটে সুদহার বেড়েছে ১৪৪ দশমিক ২৬ শতাংশ।
একটি ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপক গতকাল শনিবার নয়া দিগন্তকে জানান, কলমানি মার্কেটের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ায় তহবিল ব্যবস্থাপনায় তারা চাপে পড়ে গেছেন। কারণ কলমানি মার্কেট থেকে ধার নেয়া হয় এক দিনের জন্য। সাধারণত সঙ্কট মেটাতে এ ধার নেয়া হয়। কিন্তু নগদ টাকার প্রবাহ কমে যাওয়ায় অনেকেই এখন এ মার্কেটের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। কলমানি মার্কেট থেকে আগের দিন ধার নিয়ে পরের দিন পরিশোধ করতে হয়। আর প্রতিনিয়তই সুদহার বেড়ে যাওয়ায় তাদের তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে।
জানা গেছে, করোনার প্রেক্ষাপটে ব্যাংকাররা অনেকটা দেখে শুনে ভালো গ্রাহকের মধ্যে ঋণ বিতরণ করেন। এতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ৯ শতাংশের নিচে চলে যায়। প্রায় প্রতিটি ব্যাংকের হাতেই বিনিয়োগযোগ্য উদ্বৃত্ত অর্থ ছিল। এ অর্থ বসিয়ে না রেখে বেশির ভাগ ব্যাংকই স্বল্প সুদে সরকারের ঋণের জোগান দেয়। নিয়ম অনুযায়ী কোনো ব্যাংকের অর্থসঙ্কট দেখা দিলে তাদের হাতে থাকা সরকারি ট্রেজারি বন্ড কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে বন্ধক রেখে টাকা ধার নেয়, যা ব্যাংকিং ভাষায় রেপো বলে। এর বাইরেও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিশেষ অর্থ সহযোগিতার আওতায় (স্পেশাল লিকুইডিটি সাপোর্ট-এসএলএস) ব্যাংকগুলোকে নগদ টাকার জোগান দেয়া হয়। মূলত মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর আপৎকালীন চাহিদা মেটাতে এ দু’টি ব্যবস্থায় নগদ টাকার জোগান দেয়া হয়। এর বাইরে আমানতের বিপরীতে বাধ্যতামূলক নগদ জমার হার (সিআরআর) কমিয়ে বাজারে টাকার প্রবাহ বাড়ানো হয়।
একজন তহবিল ব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, চলমান অবস্থায় এ তিন অবস্থার একটিতেও বাংলাদেশ ব্যাংক যাচ্ছে না। বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করে নগদ টাকা উত্তোলন করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিসংখ্যান মতে, গত আগস্ট থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে ১০ দিনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করেছে ১৬৩ কোটি ২০ লাখ, যা টাকার অঙ্কে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। একই সাথে বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের মাধ্যমেও টাকা তুলে নিচ্ছে। বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে রেপো বা বিশেষ তারল্য সহায়তা চালু করা হচ্ছে না। এর ফলে নগদ অর্থের সঙ্কটে থাকা ব্যাংকগুলো ক্রমান্বয়ে কলমানি মার্কেটের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। অপর দিকে সুদহার বেড়ে যাওয়ায় তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, রাতারাতি আমানত প্রবাহ বাড়ানো সম্ভব নয়, আবার ব্যাংকের হাতে থাকা এসএলআর উদ্বৃত্ত ট্রেজারি বন্ডও বিনিময় করা যাচ্ছে না। সবমিলে ব্যাংকগুলো কঠিন সঙ্কটে পড়তে যাচ্ছে। পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্যই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এগিয়ে আসা প্রয়োজন বলে তারা মনে করেন।