আওয়ামী লীগের নব গঠিত কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদে প্রভাব কমেছে সরকারের দায়িত্বে থাকা মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদের। দলটির ২১তম জাতীয় সম্মেলনের পর গঠিত কমিটিতে এমনটাই লক্ষ করা গেছে। এটিকে দল ও সরকার আলাদা করার প্রয়াস হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
আওয়ামী লীগের বিগত তিনটি কমিটি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সরকারের মন্ত্রীরা একই সাথে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদও পেয়েছিলেন। ফলে দল ও সরকার মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে- এমন সমালোচনা উঠে বিভিন্ন সময়। বিষয়টি মাথায় রেখে পর্যায়ক্রমে মন্ত্রিসভায় কেন্দ্রীয় নেতাদের আধিপত্য কমিয়ে আনা হচ্ছে।
এবারের জাতীয় সম্মেলনের আগে সরকারকে দল থেকে আলাদা করার ইঙ্গিতও দেয়া হয় দলের উচ্চপর্যায় থেকে। সদ্য ঘোষিত দলের আংশিক কমিটিতে তার প্রতিফলনও দেখা গেছে। কমিটি ঘোষণার পর নতুন কমিটির নেতারা বলছেন, এবার দল ও সরকার একাকার হবে না। দল সাংগঠনিক গতিশীলতা বাড়াতে কাজ করবে আর দেশের উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করবে সরকার।
দলের ২১তম জাতীয় সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে শনিবার ৮১ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটির ৪১ জন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতার নাম ঘোষণা করেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা। ঘোষিত এ আংশিক কমিটির মধ্যে এখন পর্যন্ত বাদ পড়েছেন গত কমিটিতে থাকা সরকারের ছয়জন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী।
বিগত কমিটিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বাদে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী মিলিয়ে ১০ জন থাকলেও এবারের কার্যনির্বাহী সংসদে এখন পর্যন্ত রাখা হয়েছে মাত্র চারজনকে। আর কমিটির বাকি তালিকায় মন্ত্রিসভার কোনো সদস্যকে রাখা হবে কি না সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
কমিটি পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত কমিটির প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক, সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা: দীপু মনি, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ, সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, এনামুল হক শামীম ও মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, অর্থ ও পরিকল্পনা সম্পাদক টিপু মুন্সী, আইন সম্পাদক শ ম রেজাউল করিম ও নারীবিষয়ক সম্পাদক ফজিলাতুন্নেসা ইন্দিরাকে মন্ত্রিসভায় স্থান দেয়া হয়েছিল।
কিন্তু তাদের মধ্যে এবারের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ড. আব্দুর রাজ্জাককে প্রেসিডিয়াম, ওবায়দুল কাদের সাধারণ সম্পাদক, ডা: দীপু মনি ও ড. হাছান মাহমুদকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে স্থান দেয়া হয়েছে। বাকি ছয়জনকে এখন পর্যন্ত কোথাও রাখা হয়নি। আগামী মঙ্গলবার পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হবে বলে গতকাল দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন। আর ওই তালিকায় মন্ত্রিসভার কোনো সদস্যকে রাখা হবে কি না সেটা গতকাল পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
আওয়ামী লীগের বিগত দু’টি কমিটি ও সরকার পর্যালোচনায় দেখা যায়, ধীরে ধীরে সরকারে কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রভাব কমিয়ে আনা হচ্ছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর ২০০৯ সালে গঠিত সরকারে কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান প্রধানমন্ত্রী বাদে ১৯ জন। তারা একই সাথে মন্ত্রীও হন আবার কেন্দ্রীয় পদেও বহাল থাকেন।
কিন্তু ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের পর গঠিত সরকারে তৎকালীন ৭১ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটির মাত্র ১১ জনকে মন্ত্রিসভায় স্থান দেয়া হয়। ওই মন্ত্রিসভায় দলের প্রায় সব হেভিওয়েট নেতা ছিটকে পড়েছিলেন। আর এবারের কেন্দ্রীয় কমিটিতে এখন পর্যন্ত মাত্র মন্ত্রিসভার চারজন সদস্যকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে রাখা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির তিনজন নেতা আলাপকালে বলেন, ‘দেশে বা দলে কোনো একটি সঙ্কট দেখা দিলেই দল ও সরকার একাকার হয়ে গেছে বলে নানা মহল থেকে অভিযোগ করা হয়। সে বিষয়টি মাথায় রেখেই এবারের কমিটি দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতারা যাতে সরকারে এবং মন্ত্রীরা যাতে দলে অতিরিক্ত ক্ষমতা দেখাতে না পারেন সে জন্যই মন্ত্রীদের কম রাখা হয়েছে।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজি জাফরউল্যাহ বলেন, ‘অনেক সময় বলতে শুনেছি দল ও সরকার মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। তাই এবারের কমিটিতে মন্ত্রীদের দলের নেতা বানানোর রীতি থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করা হয়েছে। এবারের কমিটিতে মন্ত্রীদের আধিক্য না থাকায় দল ও সরকার দুটি একে অপরের সহায়ক হবে, কিন্তু একাকার হবে না।’