বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা ক্রমাগত খারাপ হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণের কারণে তাকে রক্ত দিতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে জীবন সংকটে ‘শর্তযুক্ত’ হলেও উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশ নিতে চায় তার পরিবার। তবে গতকাল বুধবার পর্যন্ত সরকারের অনুমতি মেলেনি।
দলের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, যে প্রক্রিয়ায় এখন চিকিৎসা চলছে, তাতে রক্ত দিয়ে খালেদা জিয়াকে বেশি দিন সুস্থ রাখা সম্ভব নয়। এমনটি চিকিৎসকরাও মনে করছেন। কেন খালেদা জিয়ার বারবার রক্তক্ষরণ হচ্ছে, তা নির্ণয় করতে গত রাতে এন্ডোস্কপি করা হয়েছে। এমন অবস্থার মধ্যে মঙ্গলবার রাত থেকে নানা গুজব রটছে। তার শারীরিক অবস্থার বিষয়টি দিনভর নানাভাবে আলোচনায় এসেছে। দলের নেতাকর্মীদের অনেকে ছুটে গেছেন এভারকেয়ার হাসপাতালে।
খালেদা জিয়ার ছোট বোন সেলিমা ইসলাম গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, তার বোনের শারীরিক অবস্থা খুবই নাজুক। তাকে দ্রুত বিদেশ নেওয়ার প্রয়োজন। সরকারের কাছে কয়েকবার আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু এখনো অনুমতি দেয়নি।
এদিকে পরিস্থিতি বিবেচেনায় খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে উন্নত চিকিৎসার দাবিতে আট দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। কর্মসূচির অংশ হিসেবে বুধবার সারাদেশে জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে দলের নেতারা। খালেদা জিয়াকে বিদেশ পাঠাতে সমঝোতার পথ খোলা রেখে কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
দলের নীতিনির্ধারকরা জানিয়েছেন, খালেদা জিয়ার চিকিৎসার বিষয়টি দেখভাল করছে পরিবার। সম্প্রতি খালেদা জিয়াকে তার ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার বিদেশ নেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন জানিয়েছেন বলে জানা গেছে। চিকিৎসকরা উন্নত চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জার্মানি নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তবে এ মুহূর্তে শর্ত দিয়ে হলেও উন্নত যে কোনো দেশে তাকে নিতে রাজি পরিবার।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের এক জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, বিএনপি এখনো পর্যন্ত কঠোর কর্মসূচি দেয়নি। বেগম জিয়ার উন্নত চিকিৎসার ব্যাপারে জনমত সৃষ্টি ও বিদেশিদের দৃষ্টিগোচর করতে বিক্ষোভ, অনশন ও স্মারকলিপি পেশের মতো ‘নিরীহ’ কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে। কারণ চিকিৎসার বিষয়টি নিয়ে দল রাজনীতি করতে চায় না। সরকারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে তাকে বিদেশ পাঠাতে চায় দল।
অবশ্য এ ব্যাপারে কেউ মুখ খুলতে রাজি হননি। একাধিক নেতা ও খালেদা জিয়ার পরিবারের নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন মাধ্যমে আলোচনা চলছে। তবে আশাব্যঞ্জক কোনো খবর নেই। পরিস্থিতি বিবেচনায় তাকে আপাতত উন্নত চিকিৎসা আছে, এমন যে কোনো দেশে তাকে নেওয়ার ব্যাপারেও সরকারের উচ্চপর্যায়ে জানানো হয়েছে।
খালেদা জিয়ার সর্বশেষ শারীরিক অবস্থা পর্যালোচনার জন্য বুধবার বিকালে বোর্ডের আট সদস্যের সঙ্গে আরও অন্তত ৫ চিকিৎসক যুক্ত হয়ে বৈঠক করেছেন। চিকিৎসকরা মনে করছেন, রক্তক্ষরণের জন্য শুধু লিভার নয়, অন্য কারণও থাকতে পারে। তাই এন্ডোস্কপি করার সিদ্ধান্ত নেন তারা।
জানা গেছে, গত ১৩ ও ১৭ নভেম্বর খালেদা জিয়ার রক্তক্ষরণ হয়। মঙ্গলবার বিকাল থেকে আবারও রক্তক্ষরণ শুরু হয়। এর ফলে তার মৃত্যুঝুঁকি বেড়েছে। প্রাথমিকভাবে চিকিৎসকদের ধারণা খালেদা জিয়া লিভারের জটিল রোগে আক্রান্ত। তাই তার ট্রান্সজাগুলার ইন্ট্রাহেপাটিক পোর্টোসিসটেমিক সান্ট করতে হবে। এ জন্য চিকিৎসকরা তাকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা জার্মানি নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। চিকিৎসকরা মনে করছেন খালেদা জিয়ার অন্য কোনো জটিল সমস্যাও থাকতে পারে।
এভারকেয়ার হাসপাতালে গিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনকে দেখে এসে গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, তার রক্তবমি হচ্ছে। শরীরের বিভিন্ন অংশে রক্তক্ষরণে তার অবস্থা সঙ্কটাপন্ন। যে কোনো মুহূর্তে যে কোনো ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
গতকাল রাতে বিএনপির একটি সূত্র জানিয়েছে, তখন পর্যন্ত তার রক্তপাত বন্ধ হয়নি। হিমোগ্লোবিন ঠিক রাখতে রক্ত দিতে হচ্ছে। কিছু খেতে পারছেন না। খেলেই বমি হচ্ছে। শরীর খুবই দুর্বল। এখনো তিনি সিসিইউতে চিকিৎসাধীন।
একটি সূত্র জানিয়েছে, তার রক্তে ইনফেকশনের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। তার গলার দিকে সেন্ট্রাল ভেনাস ক্যাথেটার লাইন লাগানো আছে, যা চিকিৎসকের ভাষায় বলা হয় ‘সিভি লাইন’। রোগীর বহুবিধ রোগ থাকলে এটি সংযুক্ত করা হয়। সিভি লাইনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় রক্তনালিকে সংযুক্ত করা হয়। এর তিন-চারটি চ্যানেল রয়েছে। যার দ্বারা একসঙ্গে সব ধরনের ওষুধ খাওয়ানো সম্ভব হয়।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নয়া পল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বলেন, সরকার চায় না খালেদা জিয়া বেঁচে থাকুক। তার অবস্থা খুবই ক্রিটিক্যাল। তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘আমি গতকালও আপনাদের বলেছি- উনি এখন ওই অবস্থাতেই আছেন। স্টিল ভেরি ক্রিটিক্যাল। চিকিৎসকরা মনিটরিং করছেন। তাদের পক্ষে যেটি সম্ভব সেই চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এখন যে অবস্থায় আছেন, তাকে সরকার এ মুহূর্তেই বিদেশে চিকিৎসার জন্য পাঠাতে পারেন। সব ক্ষমতা সরকারের।’
বিএনপি চেয়ারপারসনকে মুক্তি দিয়ে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার সুযোগ দিতে সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়ে গতকাল ২৫৮২ সাংবাদিক যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন। জাতীয়তাবাদী দল সমর্থিত ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি কাদের গনি চৌধুরীর স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেন।