সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৩২ পূর্বাহ্ন

ওমিক্রন সমাচার

শামস্ বিশ্বাস
  • আপডেট টাইম : সোমবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২১
  • ১৬১ বার

সদ্য দক্ষিণ আফ্রিকায় আবিষ্কার হওয়া সার্স-কোভ-২ (করোনা ভাইরাসের)-এর ভ্যারিয়েন্ট বা প্রজাতি ‘ওমিক্রন’ কতটা ক্ষতিকারক, কীভাবেই বা বুঝবেন ওমিক্রন সংক্রমণ ঘটেছে আপনার শরীরে, এর প্রধান উপসর্গই বা কী? এসব প্রশ্ন ক্রমেই বৃদ্ধি করছে উৎকণ্ঠা। বিস্তারিত জানাচ্ছেন- শামস্ বিশ্বাস

ওমিক্রনের লক্ষণ

দক্ষিণ আফ্রিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (সামা) প্রধান ডা. অ্যাঞ্জেলিক কোয়েটজি বলেছেন, গত ১০ দিনে ৩০ রোগীকে করোনা ভাইরাসের নতুন রূপ ওমিক্রন দ্বারা সংক্রমিত হতে দেখেছি। ওমিক্রন দ্বারা সংক্রামিত রোগীর চরম ক্লান্তি, গলাব্যথা, পেশিব্যথা ও শুকনো কাশির মতো সমস্যা রয়েছে। শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট থেকে এর লক্ষণগুলো বেশ আলাদা। সামাপ্রধান দাবি করেন, তিনি এখন পর্যন্ত যত রোগী দেখেছেন- তাদের সবার টিকা নেওয়া হয়নি। তাদের ওমিক্রনের হালকা লক্ষণ ছিল। তার মতে, ইউরোপের বিপুলসংখ্যক মানুষ করোনার এই নতুন প্রজাতি দ্বারা সংক্রামিত। এখন পর্যন্ত ওমিক্রন দ্বারা সংক্রামিত বেশিরভাগ রোগীর বয়স ৪০ বছরের কম। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ, ডেল্টা আক্রান্তদের মতো ওমিক্রন আক্রান্তদের কেসে এখন পর্যন্ত স্বাদ-গন্ধ হারিয়ে ফেলার ঘটনা ঘটেনি। এমনকি করোনা আক্রান্তের কেসে এতদিন সব থেকে চিন্তার বিষয় ছিল রক্তে অক্সিজেন লেভেল হঠাৎ নেমে যাওয়া, এই নতুন ভেরিয়েন্টের ক্ষেত্রে তাও হয়নি।

নতুন ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন কি কাজ করবে?

কোভিড ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হওয়ার পর গোটা বিশ্বই এ আবিষ্কারকে স্বাগত জানিয়েছিল। এসব ভ্যাকসিন আদৌ সংক্রমণ রুখতে পারবে কিনা, এ বিষয়েও তখন ভিত্তিহীন আশা ছিল মানুষের। ইন্ট্রামাস্কুলার ভ্যাকসিন পদ্ধতিগত ইমিউন রেসপন্স উদ্দীপ্ত করে। শ্বাসনালিতে ভাইরাসের প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করে। কিন্তু প্রাথমিক স্তরের সংক্রমণ রুখতে পারে না। ভাইরাসের সংক্রমণের হাত থেকে মুক্তি পেতে এই ভ্যাকসিন দারুণভাবে সহায়তা করে। শুধু তা নয়, মারাত্মক অসুস্থতা ও মৃত্যু পর্যন্ত রুখে দিতে পারবে এই ভ্যাকসিন। আসলে সংক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য আমাদের এক ধরনের অ্যান্টিবডি প্রয়োজন হয়। ভাইরাস দেহে প্রবেশ করার পর শ্বাসনালির মিউকাস মেমব্রেনে স্থায়ীভাবে বাস করতে শুরু করে দেয়। তখন সংক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য সেই অ্যান্টিবডিই এ ভাইরাসকে সাফাই করে বের করে দেয়। কোভিডের এই মিউকোজাল ভ্যাকসিন তৈরি হচ্ছে এবং ট্রায়ালও চালানো হচ্ছে। কিন্তু প্রমাণিত তথ্য সেভাবে পাওয়া যায়নি। এগুলো কতটা কার্যকর, সেটি এখনো ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল থেকেই জানা যেতে পারে। কার্যকারিতা ও নিরাপত্তার বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ভ্যাকসিন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো হয়। বর্তমানে অনুমোদন প্রাপ্ত যেসব ভ্যাকসিন বাজারে মিলছে, সেগুলো পরীক্ষায় পাস করেছে। এখন যেসব ভ্যাকসিন চালু রয়েছে, সেগুলো তৈরি করা হয়েছিল করোনার মূল ধরনটির চিকিৎসার জন্য। তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, নতুন ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধেও এগুলো কাজ করবে। তবে এর কার্যকারিতা হবে কম। একটি গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে, আগে যাদের কোভিড হয়েছে এবং কিছুটা ইমিউনিটি রয়েছে- ব্রাজিলিয়ান ভ্যারিয়েন্ট সম্ভবত তাদের দেহের অ্যান্টিবডিকে ঠেকিয়ে দিতে পারে। ফাইজারের ভ্যাকসিনের ওপর গবেষণাগারের প্রাথমিক তথ্য এবং রোগীদের তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, এটি নতুন ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে কাজ করে। তবে কার্যকারিতা কম।

অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ডেটা থেকে জানা যাচ্ছে, এটি ইউকে/কেন্ট ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধেও একইভাবে কার্যকর। তবে দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে এটি কম সুরক্ষা দেয়। কিছু প্রাথমিক ফল থেকে জানা যাচ্ছে, মডার্না ভ্যাকসিন দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে কার্যকর। এর ইমিউন রেসপন্স দুর্বল ও স্বল্পস্থায়ী।

ডেল্টা প্রজাতির সঙ্গে ওমিক্রনের পার্থক্য

এক বিবৃতিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, কোভিড-১৯ অতিমারীতে ক্ষতিকারক পরিবর্তনের ইঙ্গিত উপস্থাপিত প্রমাণের ভিত্তিতে। তাই বি.১.১.৫২৯-কে (ই.১.১.৫২৯ ) উদ্বেগের একটি প্রজাতি (ঠধৎরধহঃ ঙভ ঈড়হপবৎহ) হিসেবে মনোনীত করেছে। এর নাম ওমিক্রন। যদি ওমিক্রন দ্বারা কোভিডের আরেকটি বড় ঢেউ ঘটে, তা হলে পরিণতি গুরুতর হতে পারে। ডেল্টা প্রজাতির কারণে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এসেছিল। তবে নতুন এ প্রজাতিটির স্পাইক প্রোটিনে আরও মিউটেশন রয়েছে। স্পাইক প্রোটিনেই ৩০টি মিউটেশন ঘটেছে। করোনা ভাইরাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ এই স্পাইক প্রোটিন। এর সাহায্যেই মানবকোষে প্রবেশ করে ভাইরাস। তা এটিকে কিছুটা বেশি সংক্রমণযোগ্য করে তোলে। এখন পর্যন্ত মৃত্যুর ঘটনা সামনে না এলেও ওমিক্রন ডেল্টা প্রজাতির চেয়ে আরও গুরুতর কিনা, তা নিয়ে আলোচনা চলছে।

বিশেষজ্ঞদের মত

বিশেষজ্ঞদের মতে, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের থেকেও ভয়ঙ্কর ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট। বেশি সংক্রামক এবং আরও দ্রুত হারে ছড়িয়ে পড়তে চলেছে করোনার এই নয়া প্রজাতি- এমন আশঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা।

আফ্রিকায় প্রথম চিহ্নিত হয়েছে ভাইরাসের এই নতুন রূপ। তার পর হংকং ও ইজরায়েলে আফ্রিকা ফেরত পর্যটকদের শরীরে ওমিক্রনের উপস্থিতি মিলেছে। এরূপ উদ্বেগের পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে বলে ইতোমধ্যেই সব দেশকে সতর্ক করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কিন্তু এখনো ভাইরাসের নতুন রূপের ভয়াবহতা সম্পর্কে পুরোপুরি জানা সম্ভব হয়নি। জিনবিন্যাসের একাধিকবার বদল ঘটানোয় মনে করা হচ্ছে করোনার এরূপ উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। দেখে নেওয়া যাক, ওমিক্রন সম্পর্কে কী জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

# বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, আগে যারা কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন, এ রকম ব্যক্তি ফের খুব সহজেই আক্রান্ত হতে পারেন ওমিক্রনে।

# জানা যাচ্ছে, এক ব্যক্তির দেহ থেকে অন্যের দেহে কোনো ভাইরাস যত সহজে ছড়িয়ে পড়তে পারে, ওই ভাইরাস তত বেশি সংক্রামক। করোনা ভাইরাসের ডেল্টা এবং অন্যরূপের তুলনায় ওমিক্রন বেশি সংক্রামক কি না, তা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে রিয়াল টাইম রিভার্স ট্রান্সক্রিপ্টেজ পলিমারেজ চেইন রি-অ্যাকশন (আরটি-পিসিআর) পরীক্ষা এরূপকে ধরতে সক্ষম বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

# কোভিডের বিভিন্ন টিকার ওপর এ ভাইরাসের প্রভাব কতটা, তা জানার জন্য কাজ চলছে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

# করোনার নতুন রূপ ওমিক্রন আরও জটিল রোগ ঘটাবে কিনা, তা এখনো স্পষ্ট নয়। করোনার অন্যরূপে আক্রান্ত হলে যেসব উপসর্গ দেখা যায়- এর থেকে আলাদা কোনো উপসর্গ ওমিক্রন ডেকে আনছে কিনা, তা এখনো স্পষ্ট নয়।

# প্রাথমিকভাবে প্রাপ্ত তথ্য জানাচ্ছে, কোভিডে আক্রান্ত হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় হাসপাতালে ভর্তি হওয়া বেড়েছে। কিন্তু সব মিলিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তেই রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি। কেবল ওমিক্রনের জন্য এই বৃদ্ধি কিনা, তা বলার পর্যাপ্ত তথ্য এখনো নেই বলে মত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার।

ওমিক্রনে আক্রান্ত বুঝবেন কী করে?

কী কী উপসর্গ রয়েছে?

দক্ষিণ আফ্রিকার চিকিৎসকরা নতুন কোভিড ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রনের লক্ষণগুলো কী, তা প্রকাশ্যে এনেছেন। তাদের মতে, ওমিক্রনের কিছু লক্ষণ রয়েছে- যা সম্পূর্ণ ভিন্ন। তবে আক্রান্তদের মধ্যে ওমিক্রনের লক্ষণ হালকা এবং অনেক রোগী হাসপাতালে ভর্তি না হয়েই সুস্থ হয়ে উঠেছেন।

ছড়িয়ে পড়ছে ওমিক্রন

যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা সব আন্তর্জাতিক যাত্রীকে সে দেশে প্রবেশের ক্ষেত্রে ভ্রমণের আগের একদিনের মধ্যে কোভিড টেস্ট বাধ্যতামূলক করেছেন। নতুন ভ্যারিয়েন্ট মোকাবিলায় ভ্রমণের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র এই সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেছে। এর মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের ছয়টি রাজ্যে ওমিক্রনের সংক্রমণ শনাক্ত করা হয়েছে। পাশের দেশ ভারতেও কমপক্ষে ৩০ জনের শরীরে ওমিক্রন ধরা পড়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, এ পর্যন্ত বিশ্বে প্রায় ২৪টি দেশে ওমিক্রন শনাক্ত হয়েছে। নতুন ভ্যারিয়েন্ট আসার সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপের দেশগুলোতেও সংক্রমণ বেড়ে গেছে।

কঠোরভাবে কোভিডবিধি মেনে চলি

প্রসঙ্গত, ‘ওমিক্রন’ নিয়ে বাংলাদেশও যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কিঞ্চিৎ ভয়ও জাগিয়েছে এ ক্ষেত্রে। কেননা তারা জানিয়েছেন, এই প্রজাতির ক্ষেত্রে উপসর্গ নাও দেখা দিতে পারে। তাই এতটুকু শৈথিল্যকে প্রশ্রয় না দিয়ে কঠোরভাবে কোভিডবিধি মেনে চলার কথাই বলা হচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তরফে।

নতুন ভ্যারিয়েন্টের জন্য কি বুস্টার টিকা লাগবে?

ভবিষ্যতের করোনা ভ্যারিয়েন্টগুলোর জন্য টিকা তৈরি করতে ব্রিটিশ সরকার কিওরভ্যাক নামে একটি ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেছে। পাঁচ কোটি ডোজ টিকার আগাম অর্ডারও দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে ভ্যারিয়েন্টগুলোয় কী ধরনের পরিবর্তন ঘটবে, এর ওপর নির্ভর করবে বয়োবৃদ্ধ ও প্রকট শারীরিক সমস্যার শিকার ব্যক্তিদের চলতি বছরের শেষ নাগাদ এ ধরনের বুস্টার টিকার প্রয়োজন হবে কিনা।

সবার নজর এখন করোনাভাইরাসের মিউটেশনের দিকে- কোভিড ১৯-এর নতুন নতুন ধরন যেমন দ্রুত ছড়ায়, তেমনি বেশিসংখ্যায় লোক এখন এগুলোয় সংক্রমিত হচ্ছে এবং ভ্যাকসিনকে ঠেকিয়ে দেয়ার ক্ষমতাও এসব ভ্যারিয়েন্টের বেশি।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com