শেষ হয়েছে দশম ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের পঞ্চম পর্বের ভোটগ্রহণ। ফলাফলও প্রকাশিত হয়ে গেছে। আরও কিছুদিন পর অনুষ্ঠিত হবে ষষ্ঠ ও শেষ পর্বের ভোট। এবারের ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচনের ফলাফল নানা দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আওয়ামী লীগের তৃতীয় মেয়াদের ক্ষমতা গ্রহণের তিন বছর পার হয়েছে। তাই এই সময় যে কোনো নির্বাচনেই ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের জয়-পরাজয় বাংলাদেশের রাজনীতিতে অবশ্যই কিছু বার্তা বহন করে।
আগে ইউপি নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার করা হতো না। প্রার্থীরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আশীর্বাদপুষ্ট হলেও নিজেদের পাওয়া প্রতীকেই নির্বাচন করতেন। রাজনৈতিক দলগুলো অনেকটাই গুরুত্বহীন ছিল। বিশেষ করে ’৯০-এর আগ পর্যন্ত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনে খুব বেশি রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাব ছিল না। ১৯৯০ সালের পর থেকে এই স্থানীয় নির্বাচনগুলোতেও রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতাচর্চার জায়গা হয়ে ওঠে। তবে বছরপাঁচেক আগে অর্থাৎ ২০১৬ সালে ইউপি নির্বাচনে দেশে প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। মূলত সেই সময় থেকেই এই নির্বাচন অনেকটাই ভিন্ন মেজাজ ধারণ করে। সেবার নির্বাচনে বিএনপিও অংশ নিয়েছিল। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, সে বছর মোট ছয় ধাপে অনুষ্ঠিত হওয়া নির্বাচনে দেশের ৪ হাজার ১০৪টি ইউপিতে ভোট হয়েছিল। এর মধ্যে সে সময়ও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ২ হাজার ৬৫২টিতে জয়লাভ করেছিল, যা শতকরা হিসাবে প্রায় ৬৫ শতাংশ। যদিও সেই নির্বাচন নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ ছিল এবং নানা ধরনের তর্ক-বিতর্ক নিয়েই শেষ হয়েছিল।
২০২১ সাল থেকে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচন এবার সবচেয়ে বড় আলোচনার বিষয় হলো স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জয়লাভ। বিশেষ করে নির্বাচনের প্রথম ধাপ থেকেই চেয়ারম্যান পদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের বিপরীতে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জয়ের সংখ্যা ছিল বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো। প্রথম ধাপের ফলাফল ঘেঁটে দেখা যায়, ২০৪টি ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ১৪৮টিতেই জয় পেয়েছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা। আর স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয় পান ৪৯টি ইউপিতে। তবে বিএনপি নির্বাচন না করলেও অন্য তিনটি বিরোধী রাজনৈতিক দল থেকে বাকি সাতজন চেয়ারম্যান পদে জয়ী হয়েছেন।
দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ৮৩৪ ইউপিতে। সেখানে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জয় পান ৪৮৬টিতে। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয় পান ৩৩০টিতে। ১৮ জন জয়ী হয়েছেন অন্যান্য রাজনৈতিক দল থেকে। ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রথম ধাপের ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের ৭৬ শতাংশ জয়লাভ করলেও দ্বিতীয় ধাপে এসে তা ঠেকেছে ৫৮ শতাংশে। তৃতীয় ধাপেও আরও আগায় স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এই পর্যায়ে ৯৯২টি ইউনিয়নের মধ্যে ৫২৫টি ইউনিয়নেই চেয়ারম্যান পদে জয় পান আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা। বিপরীতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয় পেয়েছিলেন ৪৪৬টিতে। এর বাইরে ২১ জন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রার্থী এই ধাপে চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হয়েছেন। চতুর্থ ধাপ থেকেই বিপর্যয়ের সূচনা। আর চতুর্থ ধাপের নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায়, চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা প্রায়ই স্পর্শ করেছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের।
চতুর্থ ধাপের নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায়, ৭৯৬টি ইউনিয়নের ফলে ৩৯৬টিতেই চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন। অন্যদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা চেয়ারম্যান পদে জয় পান ৩৯০টি ইউনিয়নে। আর ১০ জন বিজয়ী প্রার্থী ছিলেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের।
তবে পঞ্চম ধাপে এসে আসলেই ধাক্কা খায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। কারণ এই ধাপে এসেই জয়ের পাল্লা ভারী করে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। চেয়ারম্যান পদে এই ধাপে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের তুলনায় স্বতন্ত্র প্রার্থীরাই জয়লাভ করেছেন বেশি।
পঞ্চম ধাপে দেশের ৭০৭টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ভোট নেওয়া হয়। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী বিভিন্ন কারণে ১৫টি ইউনিয়নে ভোট বন্ধ বা স্থগিত করা হয়েছে। ভোট হওয়া ৬৯২টি ইউনিয়নের মধ্যে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থীরা জয় পেয়েছেন ৩৪১টিতে। আর স্বতন্ত্র প্রার্থীরাই বিজয়ী হয়েছেন ৩৪৬টি ইউনিয়নে।
নির্বাচন কমিশনের হিসাব অনুযায়ী ফলাফল বিশ্লেষণে যা দাঁড়ায় তা হলো প্রথম ধাপে ২৪ শতাংশ ও দ্বিতীয় ধাপে ৪০ শতাংশ চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হয়েছিলেন। তৃতীয় ধাপে গিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জয় ৪৫ শতাংশ। এর পর চতুর্থ ধাপে তারা জয় পান ৪৯ শতাংশ। পঞ্চম ধাপে এসে দেখা যায়, স্বতন্ত্র প্রার্থীরাই ৫০ শতাংশ ইউনিয়ন পরিষদে বিজয়ী হয়েছেন। শুধু তাই নয়, দু-একটি জায়গায় জামানতও হারিয়েছেন এবং ৫০ ভোটেরও কম ভোট পেয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত প্রার্থী। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ঝিনাইদহের হরিণাকু-ু উপজেলার ফলসী ইউনিয়ন পরিষদে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করা প্রার্থী নিমাই চাঁদ ম-ল মাত্র ৪২ ভোট পেয়েছেন। অন্যদিকে কাছাকাছি ঘটনাও ঘটেছে কুষ্টিয়ায়। সেখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা ভোটের দিক থেকে অনেক পেছনে আছেন, এমনকি পাঁচজন প্রার্থী মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেই আসতে পারেননি। তিনজন হারিয়েছেন জামানত। এর কারণ কী? কেন ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত প্রার্থীরা বিজয়ী হচ্ছেন না? এই নির্বাচন কী আওয়ামী লীগকে সতর্কবার্তা দিচ্ছে?
যদিও বিজয়ী এই স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পাওয়া বিদ্রোহী প্রার্থী। তবে বিএনপি ঘোষণা দিয়ে নির্বাচন বর্জন করলেও তাদের অনেক স্থানীয় নেতাই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন। জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ সমর্থিত অনেক স্থানীয় নেতাও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন।
দলের অনেকেই বলছেন, স্থানীয় নেতারা দলীয় প্রার্থী নির্বাচনে অনিয়ম করেছেন এবং অনেক ক্ষেত্রেই সঠিক প্রার্থী বাছাই করতে পারেননি। এর পাশাপাশি দলের বিদ্রোহীদের শান্ত করা কিংবা তাদের দলের মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে বিদ্রোহী প্রার্থীদের আনতে পারার ক্ষেত্রে কম ভূমিকা রেখেছেন। যার কারণে বিদ্রোহীরা জয়ী হয়েছেন।
অন্যদিকে খোদ দল থেকেও অভিযোগ রয়েছে যে, প্রতিটি জেলায় জারি থাকা দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এই নির্বাচনে প্রভাব ফেলেছে। বলা হচ্ছে, জেলার প্রভাবশালী অনেক নেতাই এই বিদ্রোহীদের সমর্থন এবং সহযোগিতা করেছেন।
তার মানে এ বিষয় স্পষ্ট যে, প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনে না থাকলেও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল আওয়ামী লীগের পরাজয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং বলা চলে বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকছে।
এখানে এ কথাটি বলে রাখা প্রয়োজন যে, একটি দল যখন দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকে তখন ক্ষমতাকে কেন্দ্র করেই নানা ধরনের উপদল এবং কোন্দল তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সম্ভবত আওয়ামী লীগ এই ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। ক্ষমতার ভাগ সবাই চাচ্ছে। সেখানে হয়তো অনেক জায়গায় উপেক্ষিত হচ্ছে দলের ত্যাগী এবং পুরনো নেতারা। যার কারণে নির্বাচন এলেই দলের অভ্যন্তরীণ ক্ষতগুলো টের পাওয়া যায় অনেকখানিই।
তাই এই নির্বাচন ক্ষমতায় থাকা দল হিসেবে আওয়ামী লীগের জন্য একদিকে অনেকটাই সংযত হওয়ার বার্তা দিচ্ছে। তবে এটি অনেকখানিই নির্ভর করবে দলের কেন্দ্রীয় নেতারা এই নির্বাচনী ফলাফলকে কতটা আমলে নিচ্ছেন তার ওপর। যদি সঠিকভাবে এটির ফয়সালা না হয় তা হলে দুই বছর পর অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনে যে এর ধারাবাহিকতা থাকবে না এমনটি এই মুহূর্তে বলা কঠিন। এটি সত্যি যে, রাজনীতিতে হিসাব-নিকাশ শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত পাল্টাতে পারে। তবে একটি স্থানীয় নির্বাচন আসলে অনেক কিছুর বার্তাই দিতে পারে। তাই আগামী নির্বাচনে জেতার জন্য অতি সাবধানে চলতে হবে আওয়ামী লীগকে। মনে রাখতে হবে, জনগণই শেষ কথা। তারাই শেষতক বিচারক।
ড. জোবাইদা নাসরীন : শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়