লিবিয়া থেকে অবৈধ পথে ইতালি যাওয়ার সময় ভূ-মধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে নরসিংদীসহ বিভিন্ন জেলার ৩১ জন যুবকের নিখোঁজ হওয়ার খরব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। নিখোঁজের প্রায় দেড় মাস পর এ খবর পেয়ে শোকের মাতম চলছে নিখোঁজদের পরিবারে।
লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশ থেকে লিবিয়া যাওয়া বাংলাদেশী যুবকদের প্রায় দেড় মাস ধরে নিখোঁজ থাকার পর তাদেরই সহযাত্রী একজনের কাছ থেকে পাওয়া গেল সেই খবর। তবে তা ছিলো তাদের মৃত্যুর খবর।
একই পথের যাত্রী প্রাণে বেঁচে যাওয়া ইউসুফ মৃধার দাবি, ৩৭ জনের মধ্য আমরা ৬ জন বেঁচে আছি। তবে চোখের সামনে উল্টে যাওয়া বোটে ধরে রাখা ইতালিগামী সহযাত্রী একের পর এক অনেকেই ভূ-মধ্যসাগরের পানিতে তলিয়ে গেছে বলে নিশ্চিত করেন প্রাণে বেঁচে যাওয়া ইউসুফ মৃধা (আমি ইউসুফ বলছি)।
নিখোঁজ ইতালিযাত্রী যুবকরা হলেন – নরসিংদী রায়পুরা উপজেলার এস এম তারুণ্য নাহিদ (২৮), পিতা- ওসমান গনি, গ্রাম- দক্ষিণ মির্জানগর পূর্বপাড়া, শাওন মিয়া (২২), পিতা- কবির মিয়া, গ্রাম- হাইরমারা, ইমরান ভূইয়া (২১), পিতা- আব্দুল করিম ভূইয়া, গ্রাম- আগানগর, নাদিম সরকার (২২), পিতা সোবহান সরকার, গ্রাম- ডৌকারচর, আল-আমিন ফরাজী (৩৩), পিতা- বাচ্চু ফরাজী, গ্রাম- ডৌকারচর, আশিষ সূত্রধর (২২), পিতা- অনিল সূত্রধর, গ্রাম- হাসনাবাদ বাজার, সেলিম মিয়া (৩৪), পিতা- এয়াকুব আলী, গ্রাম- দড়ি হাইরমারা, সবুজ মিয়া (৩৮), গ্রাম- বালুয়াকান্দি; বেলাবো উপজেলার সল্লাবাদ ইউনিয়নের ইব্রাহীমপুর গ্রামের ইউনুছ মিয়ার ছেলে সালাউদ্দিন (৩৫), একই গ্রামের হাবিবুর রহমানের ছেলে শরিফুল ইসলাম (২৪), নারায়ণপুর ইউনিয়নের দুলালকান্দি গ্রামের নূরুল ইসলামের ছেলে মতিউর রহমান (৩২) এবং ফরিদপুর জেলার নগরকান্দা উপজেলার বাবুর কাইচাইল গ্রামের মাজেদ মিয়ার ছেলে হোসেন নাজমুল ইসলাম (১৯), একই গ্রামের ফারুক মাতুব্বরের ছেলে মইন মিয়া ফয়সাল (১৮); পিরোজপুর জেলার খানাকুনিয়ারি গ্রামের মজিবুর রহমান শেখের ছেলে রুহুল আমিনসহ (২৩) নিখোঁজ ইতালিগামীদের পরিবারে শোকের মাতম চলছে। আবার কেউ কেউ এখনও সন্তানরা ফিরে আসার স্বপ্ন দেখছেন।
নিখোঁজ পরিবারের তথ্য ও অভিযোগের সূত্রে জানা গেছে, বিগত ২৭ জানুয়ারি লিবিয়া সময় রাত ৮টায় লিবিয়া থেকে ইতালির উদ্দেশ্যে ইঞ্জিনচালিত প্লাস্টিক নৌকায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে দালালরা ৩৭ জন অভিবাসীকে নৌকায় তোলে। এ সময় অতিরিক্ত বোঝায় নৌকায় উঠেনি রায়পুরা উপজেলার করিমগঞ্জ গ্রামের আউয়াল মোল্লার ছেলে ওয়াকিল মোল্লা, নয়নসহ ৩ জন। তারা ফিরে যায় ঘোম ঘরে এবং তাদের চোখের সামনে ৩৭ জন ইতালি অভিবাসীকে নিয়ে নৌকা ছেড়ে দেয়।
এর পর থেকেই পরিবারের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে ইতালি যাওয়ার স্বপ্নবাজ বাংলাদেশী ৩১ যুবকের। দালাল চক্র নিখোঁজদের ফিরে আসার আশ্বাস দিয়ে চুক্তিবদ্ধ টাকা পেতে অভিবাসীদের চাপ দিতে থাকেন।
কিন্তু দেড় মাস পর নৌকাডুবিতে প্রাণে বেঁচে যাওয়া ইউসুফসহ ৬ জনের তথ্যমতে, মাল্টা সাগরে এসে নৌকাডুবির এক লোমর্হষক ঘটে। ঘটনাস্থলে অচেতন ৬ জনকে লিবিয়ার কোস্টগার্ড উদ্ধার করে খামছা-খামছিন জেলে প্রেরণ করে। নিখোঁজরা বেঁচে আছে কিনা বা আর ফিরে আসবে কিনা সে বিষয়ে তারা সন্দিহান।
মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে যাওয়া ইউসুফ জানান, বোটটিতে যাত্রী ধারণ ক্ষমতা ছিল ২৪-২৫ জনের, সেখানে ৩৭ জনকে তুলে দেয়া হয়। ২৬ হাত লম্বা বোট দেয়ার কথা থাকলেও দেয়া হয় ১২ হাত লম্বা বোট। লাইফ সাপোর্ট জ্যাকেট দেয়া হয়নি। বোটে ২টি ইঞ্জিন দেয়ার কথা থাকলেও ইঞ্জিন ছিল ১টি। নাবিক ছিলেন মিসরীয়।
তিনি জানান, ভোর ৩টার দিকে মাল্টার কাছাকাছি পৌঁছলে আচমকা এক ঢেউয়ের ধাক্কায় বোট উল্টে গেলে আমরা বাঁচার চেষ্টা করি। প্লাস্টিক গ্যালনসহ নানা উপকরণ ধরে বাঁচতে ছুটাছুটি করি। এমন সময় একটু দূরে নৌকাটি পানির উপরে ভেসে উঠে। আর এই বোটের দুই পাশে আমরা ২০ জন বোট ধরে ভাসতে থাকি। লবণাক্ত পানি পান করে মুখ দিয়ে অনেকের রক্ত বের হতে থাকে। প্রায় ১৩ ঘণ্টা সাগরের বরফ পানিতে ২৮ তারিখ বিকেলে শেষ পর্যন্ত আমরা মাত্র ৭ জন ভাসমান নৌকার উল্টো পিঠে ধরে নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকি।
রাত পেরিয়ে দিন আসে, শেষ বিকেলে অনেক দূরে একটি টহল কোস্টগার্ড বোট যাচ্ছিল। এমন সময় তাদের দেখতে পেয়ে একজন লাল গেঞ্জি উঁচিয়ে ধরি। তখন তারা দেখতে পায়। আমাদের উদ্ধার করে ডাঙ্গায় ওঠার পর ৭ জন থেকে ১ জনের মৃত্যু হয়। আমাদের চিকিৎসা দিয়ে জেলে রাখা হয়। ৩ দিনের মাথায় দালালকে ফোন দিলে সে আর আসেনি। তারপর অন্য এক জেলখানায় আমাদের স্থানান্তর করা হয়। সেখান থেকে ৩ ফেব্রুয়ারি ৬ জনের মধ্য থেকে ২ জনকে দেশে ফেরত পাঠায় এবং ৪ জনকে পরবর্তি ফ্লাইটে পাঠাবে।
প্রাণে বেঁচে যাওয়া ৬ জনের মধ্যে হাসনাবাদ গ্রামের খোরশেদ মৃধার ছেলে ইউসুফ মৃধা, নিলক্ষা গ্রামের ১ জন, বেলাবো উপজেলার ১ জন, বি-বাড়িয়ার ১ জন এবং মাদারীপুর জেলার ২ জন।
দালাল চক্রের মূলহোতা নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার আমিরগঞ্জ ইউনিয়নের আগানগর গ্রামের পরিমল সূত্রধরের ছেলে লিবিয়া প্রবাসী মনির চন্দ্র শীল। তার রয়েছে বাংলাদেশে অসংখ্য স্থানীয় ছেচকে দালাল। মনির চন্দ্র শীল হাসনাবাদ বাজারের হারুন প্লাজায় সেলুন ব্যবসায়ী ছিলেন ও বিকাশে টাকা লেনদেনের ঘটনায় র্যাব-১১ তাকে আটক করে। মামলা হওয়ার পর তিনি লিবিয়া অবস্থান করেন। রায়পুরার মনির চন্দ্র শীল, ফরিদপুরের লিবিয়ায় অবস্থানরত দালাল রাসেল, শাহিন, ইলিয়াসের মাধ্যমে এ অঞ্চলের মানবপাচার হয়ে থাকে।
শাওন মিয়ার পিতা কবির মিয়া বলেন, ২৭ নভেম্বর আমার ছেলে শাওনকে লিবিয়া পাঠানো হয় স্থানীয় লিবিয়া প্রবাসী মাহবুব পাঠানের মাধ্যমে। সেখানে সে ভালো চাকরি করবে এমনটাই প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু দালালচক্রের অতি প্ররোচনায় মনির দালালের সাথে ফোনের মাধ্যমে চার লাখ টাকা চুক্তি হয়। চুক্তির চার লাখের মধ্যে ৩ লাখ টাকা তার মেসেজে পাঠানো এনসিসি ব্যাংক মহিপাল শাখায় গত ২০ ডিসেম্বর ২০২১ তারিখে রহিমা সুলতানা পপি নামের হিসাব নাম্বারে পাঠানো হয়। পরে আরো টাকা পাঠানোর কথা বলে। আর আমার ছোট ছেলেকে যারা প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশ পাঠিয়েছে তাদের বিচার চাই। আমি এর সুষ্ঠু বিচার চাই। আমার মতো আর কোনো পিতামাতার যেন বুক খালি না হয়।
সেলিমের বড় ভাই রতন মিয়া জানান, সেলিমের ২টি মাছুম সন্তান রয়েছে। দালালের খপ্পরে পড়ে জীবন দিতে হলো তাকে।
নাদিম সরকারের পিতা সোবহান সরকার বলেন, সাড়ে ৮ লাখ টাকা এবং সন্তানকে হরালাম। আমি অবৈধ পথে মানব পাচারকারী দালালচক্রের বিচার চাই।
এ ব্যাপারে ডৌকারচর ইউপি চেয়ারম্যান মাসুদ ফরাজী বলেন, বিষয়টি দুঃখজনক। অবৈধ পথে বিদেশ যাওয়ার চেয়ে না খেয়ে থাকা অনেক ভালো। কেউ যেন এভাবে অবৈধভাবে বিদেশ না যায় সকলকে সর্তক থাকার আহ্বান করছি।
তবে দালাল চক্র ওই নিখোঁজ যুবকরা বেঁচে আছে বলে এলাকায় প্রচার চালাচ্ছে।
এদিকে ইতালিগামী ওই যুবকদের মৃত্যুর খবরে তাদের পরিবার-স্বজনসহ এলাকায় শোকের মাতম চলছে। অপরাধী দালাল চক্রের অবৈধভাবে মানবপাচারের বিরুদ্ধে মামলা করবেন বলে জানিয়েছেন অনেকে।