বছরজুড়েই পার্বত্য এলাকায় ছিল খুন-জখম, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায় আর চাঁদাবাজিসহ নানা আতঙ্ক। পাহাড়ের বিবদমান সশস্ত্র গ্রুপগুলো খুনের নেশায় মত্ত ছিল। সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের হাতে হতাহত হয়েছেন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, পুলিশ ও সেনাসদস্য।
২০১৯ সালটা বেশ আতঙ্কেই কেটেছে পাহাড়ের শান্তিপ্রিয় মানুষের। শুরুটা ছিল ১৮ মার্চ। ওই দিন সন্ধ্যায় উপজেলা নির্বাচনের ভোট গণনা শেষে বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক বাঘাইহাট থেকে দীঘিনালা ফেরার পথে ৯ কিলোমিটার নামক স্থানে ব্রাশ ফায়ারে নিহত হন একজন সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারসহ আটজন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। আহত হন আরো ১৬ জন।
পার্বত্য শান্তিচুক্তির পর গত ২২ বছরে এমন ঘটনা দেখেনি পাহাড়ের মানুষ। সরকারি তদন্ত কমিটি এ ঘটনার জন্য শান্তিচুক্তির পক্ষের জেএসএসকে দায়ী করেছে। সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা গত বছর সেনাবাহিনীর উপরও আক্রমণ করেছে। ১৯ সালের ১৮ আগস্ট রাজস্থলীর পোয়াতু পাড়ায় সেনাবাহিনীর টহল টিমের ওপর সন্ত্রাসীরা গুলি চালায়। এতে সৈনিক মো: নাসিম নিহত হন।
২৬ আগস্ট খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় সেনাবাহিনীর টহল টিমের ওপর আবারো হামলা চালায় পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা। ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপের সদস্যরা এই হামলা চালায় বলে জানা যায়। সেখানে পাল্টা গুলিতে নিহত হয় তিন সন্ত্রাসী। ঘটনাস্থল থেকে বেশ কিছু অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। নিহতরা হলো- ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপের বুজেন্দ্র চাকমা, জ্যোতি চাকমা ও রশিল চাকমা।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে নিহত হয়েছে বেশ কয়েকজন সশস্ত্র সন্ত্রাসীও। জেএসএসের চিফ কালেক্টর জ্ঞান শঙ্কর বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। পরবর্তীতে সশস্ত্র গ্রুপটির নিযুক্ত চিফ কালেক্টর বিক্রম চাকমাও গত ১ ডিসেম্বর নিহত হন। গত ১৫ মার্চ ইউপিডিএফের প্রসীত গ্রুপের চিফ কালেক্টর তারাবন চাকমা পানছড়িতে নিহত হন। ৪ ডিসেম্বর ইউপিডিএফের প্রসীত গ্রুপের সহকারী পরিচালক সুবাহু চাকমা ওরফে গিরিও নিহত হন। গত ৯ এপ্রিল অপহৃত হন ইউপিডিএফের কেন্দ্রীয় সংগঠক মাইকেল চাকমা। এ ছাড়া আগ্নেয়াস্ত্রসহ গ্রেফতারও হয়েছেন অনেকে।
এ ছাড়া পাহাড়ে চাঁদাবাজিও নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। চাঁদা না দিয়ে এখানে কিছুই সম্ভব নয়। চাষাবাদ করতে, ব্যবসা করতে, গাড়ি চালাতে-সর্বত্রই চাঁদা দিতে হচ্ছে। পাহাড়ের সশস্ত্র গ্রুপগুলোর সদস্যরা প্রত্যক্ষভাবে এই চাঁদাবাজির সাথে জড়িত। কেউ চাঁদা দিতে না চাইলে তাকে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়। বাধ্য হয়ে পাহাড়ের মানুষরা চাঁদা দিয়ে আসছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পাহাড়ে চারটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ রয়েছে। এর প্রতিটি গ্রুপই চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছে। তাদের হাতে রয়েছে আধুনিক অস্ত্র ও গোলাবারুদ। গত দুই বছরে যেসব আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়েছে তার প্রায় সবই অত্যাধুনিক। ২০১৮ সালে এসব সশস্ত্র গ্রুপগুলোর অনেক শীর্ষ নেতা হামলা-পাল্টা হামলায় নিহত হয়েছেন। শান্তিচুক্তির পর ১৯৯৭ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সশস্ত্র গ্রুপগুলো অভ্যন্তরীণ কোন্দলেই লিপ্ত ছিল।
দীর্ঘকাল পরে ২০১৯ সালে তারা পুনরায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর আক্রমণ শুরু করে, যা পুরো পাহাড়ে ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়।