বাংলাদেশে বৈদেশিক ঋণের ঝুঁকি ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান সরকারের গ্যারান্টির বিপরীতে অনমনীয় ঋণ (হার্ডটাম লোন) নেয়ায় এই ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়; বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা, ইউরোপকেন্দ্রিক ঋণ জটিলতা ও পরিবর্তনশীল ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নমনীয় ঋণের উৎসও সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে।
ফলে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের নিট প্রবাহ কমেছে দুই দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। উল্লেখ্য, বর্তমানে দেশে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। চলতি অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধেই ব্যয় হবে ১৫ হাজার ৭২৫ কোটি টাকা।
ইআরডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘২০১৪-১৫ হতে ২০১৮-১৯ পর্যন্ত মোট পাঁচ অর্থবছরে অর্জিত বৈদেশিক সহায়তার প্রতিশ্রুতির পরিমাণ ছিল ৫৪ দশমিক ৬৮ মার্কিন ডলার। যা গড়ে প্রতি অর্থবছরে ১০ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। একই সময়ে বৈদেশিক সহায়তা ছাড়করণের পরিমাণ ছিল ২৩ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের বিপরীতে সরকার ১৫৬ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীদের পরিশোধ করেছে। যার মধ্যে আসল ১১৭ কোটি ৮৩ লাখ ডলার এবং সুদ ৩৮ কোটি ৬৭ লাখ ডলার।
ইআরডি বলছে, স্বাধীনতার পর থেকে এ যাবৎ বাংলাদেশ যথাসময়ে ঋণ পরিশোধ করতে সক্ষম হয়েছে। এমনকি ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে কিস্তি পুনঃতফসিলকরণের জন্য বাংলাদেশকে কখনও আবেদন করার প্রয়োজন হয়নি।
ইআরডির প্রতিবেদনে অনমনীয় ঋণ কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে উল্লেখ করে বলা হয়েছে,‘ কঠিন শর্তের ঋণের ঝুঁকি প্রশমনের জন্য ইন্টারন্যাশনাল বেস্ট প্র্যাকটিসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রক্রিয়ায় ঋণের নমনীয়তা পরীক্ষা ও অনুমোদনের জন্য ১৯৮০ সালে গঠিত হার্ড টার্ম লোন কমিটি বাতিল করে অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনমনীয় ঋণবিষয়ক স্থায়ী কমিটি গঠন করা হয়।
যে সব বৈদেশিক ঋণের গ্র্যান্ট (অনুদান) অ্যালিমেন্ট ৩৫ ভাগের কম সেসব বৈদেশিক ঋণ এ কমিটিতে পরীক্ষা ও অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করতে হয়। এ কমিটি অনমনীয় ঋণ গ্রহণের প্রস্তাবগুলো যাচাই-বাছাই করে অনুমোদন দিয়ে থাকে। ২০১৯ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত মোট ৪০টি অনমনীয় ঋণ গ্রহণের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে কমিটি।
এ দিকে সরকারের ঋণ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। সুদসহ দেনা পরিশোধের পরও বাজেট বাস্তবায়নে প্রতিবছর সার্বিকভাবে সরকারের এই ঋণ বাড়ছে। বিগত চার অর্থবছরে সরকারের ঋণ প্রায় দেড় গুণ বেড়েছে এবং আগামী পাঁচ বছরে তা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সরকারের সার্বিক ঋণ ছিল ৫ লাখ ৪৫ হাজার ৫২০ কোটি টাকা।
এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণ ছিল ৩ লাখ ২১ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ২৩ হাজার ৮৯০ কোটি টাকা। চলতি ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে এই ঋণ বেড়ে দাঁড়াবে ৮ লাখ ৮০ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণ ৫ লাখ ৫২ হাজার ৩১০ কোটি টাকা ও বৈদেশিক ঋণ ৩ লাখ ২৮ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা।
দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ধরলে অর্থবছরে দেশের জনগণের মাথাপিছু ঋণ গিয়ে ঠেকবে ৪৬ হাজার ২৭৯ টাকায়। অর্থমন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় না হওয়া ও সুষ্ঠু ঋণ ব্যবস্থাপনার অভাবে প্রতিবছর সরকারের ঋণ বেড়েই চলেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে দায়দেনা পরিশোধের ক্ষেত্রে দেশের আর্থিক খাত ও সরকার বড় ধরনের চাপে পড়বে।
তবে অর্থ বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেছেন, সরকারের ঋণের পরিমাণ জিডিপির ৪০ শতাংশ পর্যন্ত উদ্বেগজনক নয়। চলতি অর্থবছর শেষে সরকারের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে জিডিপির ২৯ দশমিক ০২ শতাংশ। অন্য দিকে জিডিপির তুলনায় বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ১৪ শতাংশ যা কোনো অবস্থায় ঝুঁকিপূর্ণ নয়।