শ্রীলংকা যে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে তা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। অর্থনীতিবিদ, উন্নয়ন গবেষক এবং নীতিনির্ধারকসহ সবাই গভীরভাবে শ্রীলংকার এই পরিস্থিতি নিয়ে ভাবছেন এবং নিজ নিজ অভিমত দিচ্ছেন। কেউ কেউ সংকট উত্তরণের পথ কী হতে পারে তা নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি শ্রীলংকার অভিজ্ঞতা থেকে বাকিদের শিক্ষণীয় কী হতে পারে তাও উপস্থাপন করতে চেষ্টা করছেন। এমন আলোচনাকে সময়োপযোগীই বলতে হয়। বেদনাদায়ক বিষয় হলো একটি নির্দিষ্ট মহল ‘কমলার সঙ্গে আপেল’-এর তুলনা করে আমাদের এই সুন্দর দক্ষিণ এশীয় বন্ধু রাষ্ট্রের দুর্দশাকে পুঁজি করে বাংলাদেশের সম্ভাবনাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় কোনো সমস্যা নেই সে দাবি আমি করব না।
কিন্তু আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির শক্তিমত্তা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ যে নেই সে কথা তো মানতেই হবে। বিশেষ করে ২০০৯ সালের পর থেকে সামষ্টিক ও ব্যষ্টিক অর্থনীতির প্রতিটি সূচকের হিসাবে বাংলাদেশ বিশ^ আর্থিক মন্দা এবং সর্বশেষ করোনাকাল পেরিয়ে সাহসের সঙ্গেই সম্ভাবনার পথে হাঁটছে। চ্যালেঞ্জ নিশ্চয় আছে। তবে সম্ভাবনার পাল্লাই ভারী। কাজেই দুটি দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও আগামীর সম্ভাবনা যে এক নয় এবং দুটি অর্থনীতির শক্তি ও দুর্বলতাগুলোর যে ভিন্নতা রয়েছে সেটি মেনে নিয়েই আলোচনা এগোতে হবে।
দক্ষিণ এশিয়ার সিঙ্গাপুর হওয়ার কথা ছিল শ্রীলংকার। প্রায় ২৬ বছর ধরে একটি মারাত্মক গৃহযুদ্ধ সত্ত্বেও অর্থনীতির উন্নতি অব্যাহত ছিল। মাথাপিছু জিডিপি ২০০৬ সালে ১,৪৩৬ মার্কিন ডলার থেকে ২০১৪ সালে ৩,৮১৯ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। তবে আয় বুঝে ব্যয় করার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে না পারার খেসারত এখন দেশটিকে দিতে হচ্ছে। পরিবারতন্ত্র ও গোষ্ঠীপ্রীতির কুপ্রভাবে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় ধস নামে। ২০০৬ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে বৈদেশিক ঋণ তিনগুণ বেড়েছে। সরকারি ঋণ জিডিপির অনুপাতে ১১৯ শতাংশে উঠে গেছে। জিডিপির অনুপাতে বৈদেশিক ঋণ এখন ৭০ শতাংশের বেশি। অলাভজনক বিরাট বিরাট প্রকল্পের (যেমন সমুদ্র ও বিমানবন্দর) ঋণের দায়ও বেশি। ঋণ পরিশোধ বাবদ সরকারের রাজস্বের ৭২% পর্যন্ত চলে যায়। এ বছরই তার ৭ বিলিয়ন ডলার ফেরত দেওয়ার কথা। এর ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে খেলাপি এড়াতে আরও বেশি রুপি মুদ্রণ করতে হয়। ফলে মূল্যস্ফীতি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এমনিতে ডাবল-ডিজিট মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত। ১২ এপ্রিল থেকে দেশটি সব বিদেশি ঋণের কিস্তি ফেরত দিতে পারবে না বলে নিজেই ঋণখেলাপি হিসেবে এক ব্যতিক্রমী ঘোষণা দিয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে লজ্জার এবং দুঃখের। এমনটি এ অঞ্চলে আগে কখনো ঘটতে দেখিনি।
২০১৮ সালে একটি সাংবিধানিক সংকট, ২০১৯ সালে গির্জা এবং বিলাসবহুল হোটেলগুলোতে ইস্টার বোমা হামলা করে শত শত মানুষকে হত্যা করা হয়। ফলে শ্রীলংকার পর্যটক উধাও। ভারী বর্ষা এবং বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগও অর্থনীতিতে মারাত্মক আঘাত করে। সর্বোপরি কোভিড-১৯ এর আকস্মিক বিস্ফোরণ শ্রীলংকার অর্থনৈতিক সংকটকে আরও গভীর করে তুলেছে। এখন দেশি এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা তলানিতে। রেটিং এজেন্সিগুলো শ্রীলংকাকে ডাউনগ্রেড করে চলেছে। নিঃসন্দেহে সরকারের অর্থনৈতিক নীতি-কৌশল বিচক্ষণ ছিল না। কোনো নির্ভরযোগ্য গবেষণা ও আগাম পর্যালোচনা (সিমুলেশন) ছাড়াই সরকার একের পর এক জনতুষ্টিবাদী অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করেছে। ফলে আন্তর্জাতিক ক্রেডিট এজেন্সিগুলো আর দেশটির আর্থিক নীতি ব্যবস্থাপনার ওপর ভরসা রাখতে পারছে না। আর এখন তো আস্থা পুরোপুরিই শেষ হয়ে গেছে।
তবে সবচেয়ে বড় সংকটের উৎপত্তি হয় শ্রীলংকার সামষ্টিক অর্থনীতির অব্যবস্থাপনার কারণে। আগেই যেমনটি বলেছি, দেশটি প্রয়োজন বিবেচনা না করে এবং বিনিয়োগের রিটার্নের পরিমাণ আমলে না নিয়েই উচ্চ সুদে দ্বিপাক্ষিক ঋণ (যার সুদ ছয় শতাংশের বেশি) গ্রহণ করেছে। এর ফলে একদিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুত কমেছে। অন্যদিকে জিডিপি অনুপাতে পাবলিক ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। সর্বশেষ রিজার্ভ অবস্থান প্রায় ১.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে নেমে এসেছে। শুরুতে শ্রীলংকা আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংকের কাছে সাহায্য চাইতে দ্বিধাবোধ করেছিল। কারণ এ সাহায্যের শর্ত হিসেবে অর্থনৈতিক পুনর্গঠন এবং উদারীকরণ সম্পর্কিত নীতি গ্রহণ করতে হতো। যার ফলে শ্রীলংকার সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশে গুরুতর স্বল্পমেয়াদি প্রভাব পড়ত। তার পরিবর্তে দেশটি সহায়তা পাওয়ার জন্য আঞ্চলিক বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর কাছে গিয়েছিল। বৈদেশিক মুদ্রার চাপ কিছুটা কমাতে ভারত ও বাংলাদেশ উভয়ই এগিয়ে এসেছে। দেশটি চীনের কাছ থেকে আরও সমর্থন চেয়েছে।
এ ছাড়া এখন আইএমএফের সাহায্য চাওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছে। যাহোক দেশটির সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি এমন একটি স্তরে অবনতি হয়েছে যা দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোর বিশাল ঘাটতির পরিপ্রেক্ষিতে জনগণের প্রতিবাদকে শান্ত করার জন্য আইএমএফের ‘তেতো ওষুধ’ কাজে নাও লাগতে পারে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে এখন বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর কিছু আলোকপাত করা যাক। একটি ধারাবাহিক রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতি অতিমারী সত্ত্বেও গত বারো থেকে তেরো বছর ধরে ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। চীন, ভিয়েতনাম এবং ভারতকে ছাড়িয়ে উদীয়মান এশিয়ায় মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশেই সবচেয়ে ভালো হয়েছে। কৃষি, রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি (আরএমজিসহ) বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান স্তম্ভ। করোনা সংকট থেকে দ্রুত গা ঝাড়া দিয়ে উঠছে বাংলাদেশ। তাই আমদানি চাহিদা খুবই বাড়ন্ত। তবে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে আগে থেকেই বিপর্যস্ত সরবরাহ চেইন আরও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জ¦ালানি তেলের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। বেড়েছে জাহাজিকরণের খরচ। তাই জানুয়ারি পর্যন্ত আমদানির মূল্য দাঁড়িয়েছে ৫০.৪৫ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের একই সময় থেকে বৃদ্ধির হার ৪৬.২১%।
ফেব্রুয়ারি ও মার্চেও এই হার ছিল আরও বাড়ন্ত। তাই বাণিজ্যে ঘাটতি বেড়ে ফেব্রুয়ারি শেষে ২২ বিলিয়ন ডলার হয়ে গেছে। চলতি হিসেবেও বড় ঘাটতি (১২ বিলিয়ন ডলার) দেখা দিয়েছে। তাই টাকার মানের ওপর চাপ পড়েছে। মাঝখানে রেমিট্যান্স বৃদ্ধির হার নেতিবাচক হয়েছিল। মার্চ থেকে তা আবার ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে। ১-৯ এপ্রিলের প্রবাসী আয় আগের বছরের ওই সময় থেকে ৭.৩% বেশি। আমার বিশ^াস পুরো এপ্রিলে এই ইতিবাচক ধারা আরও গতি পাবে। তা ছাড়া এর পর পরই আসবে ঈদুল আজহা। তাকে ঘিরেও প্রবাসী আয় বাড়বে। রপ্তানি এমনিতেই ইতিবাচক ধারায় আছে। মার্চ নাগাদ তার বৃদ্ধি ছিল ৩৩.৪১%। এ মাসে এই হার আরও বাড়বে বলে মনে হয়। আমরা যদি ডলার-টাকার বিনিময় হারটি আরেকটু নমনীয় করতে পারি তাহলে প্রবাসী আয় ও রপ্তানি দুই-ই বাড়বে।
আর আমাদের দায় শোধ নিয়ে যেভাবে ভয় দেখানো হয় তা কিন্তু সঠিক নয়। আমাদের মোট দায় জিডিপির ৩৮ শতাংশ। বৈদেশিক ঋণের দায় ১৩ শতাংশ। আমাদের এখন মোট বৈদেশিক ঋণ ৯০.৯৭ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণ ১৫.৪৬ বিলিয়ন ডলার। মোট ঋণের ১৭ শতাংশের মতো। আমাদের রিজার্ভ পরিস্থিতিও শক্তিশালী। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। তা ছাড়া কোভিড-উত্তর পুনরুদ্ধারে এডিবি, বিশ^ব্যাংক, আইএমএফসহ বিশ^ উন্নয়ন সংস্থা থেকে আমরা দীর্ঘমেয়াদি সস্তা ঋণ পেয়েছি এবং পাচ্ছি। তাই হঠাৎ করে শ্রীলংকার মতো হয়ে যাবে বাংলাদেশ এমন ধোয়া যারা তুলছেন তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে যে কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন। শ্রীলংকা যেখানে রাজস্ব আহরণ কমিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ সেখানে কিন্তু সবশেষ পনেরো শতাংশ হারে রাজস্ব আদায় করছে। এই ধারা আরও বেগবান করতে কর কাঠামোর সংস্কার ও ডিজিটাইজেশনের কোনো বিকল্প নেই।
আমাদের মেগা প্রকল্পগুলোর জন্য যে ঋণ নেওয়া হয়েছে তার সঙ্গে শ্রীলংকার পরিস্থিতির তুলনা করতে চাইছেন কেউ কেউ। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, বাংলাদেশের মাথাপিছু ঋণ এখনো মাত্রা ২৯২ মার্কিন ডলার (শ্রীলংকার ১,৬৫০ মার্কিন ডলার। তবে এটাও ঠিক যে, আমাদের সরকারি প্রকল্পের ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরা দরকার। বড় বড় প্রকল্পগুলোকে আরও বিন্যস্ত করে অগ্রাধিকার দিয়ে সাজানো উচিত। প্রত্যাশিতভাবেই আমাদের নীতিনির্ধারকরা সে পথেই হাঁটছেন। সরকারের অর্থ বিভাগের বরাতে আগামী অর্থবছরের বাজেট সম্পর্কে যে তথ্য পাওয়া গেছে তা থেকে এমনটিই আশা করা যায়। আসন্ন বাজেটের আকার ধরা হচ্ছে প্রায় ৬ লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের চেয়ে বেড়েছে ১২ শতাংশেরও বেশি।
তবে জিডিপির শতাংশ হিসেবে বাজেটের অনুপাত কিন্তু কমছে। চলতি বছরে ১৭.৫ শতাংশ থেকে আসন্ন অর্থবছরের বাজেট কমে হতে পারে জিডিপির ১৫.৪ শতাংশ। এই যে দুই শতাংশ কমে যাওয়া এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, আমাদের নীতিনির্ধারকরা বিদ্যমান পরিস্থিতির প্রতি সংবেদনশীল থেকেই সাধারণত যে হারে এক অর্থবছর থেকে অন্যটিতে বাজেটের আকার বাড়ানো হয় সে পথে হাঁটেননি। শুরু থেকেই বলে আসছি যে, আমাদের আর্থিক নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতা শ্রীলংকার চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা এবং অনেক বেশি বাস্তবমুখী। সার্বিক সামষ্টিক অর্থনৈতিক বাস্তবতার নিরিখে কিছুটা সঙ্কোচনমূলক এই বাজেট প্রস্তাবনা তা আরও একবার প্রমাণ করল। সংশ্লিষ্ট সব অংশীজন সমাজে ও রাজনীতিতে শান্তি রক্ষা করে নিজ নিজ জায়গা থেকে কাজ করলে বাংলাদেশ আরও জোরে জোরে হাঁটবে বলে আমার বিশ্বাস।
ড. আতিউর রহমান : প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর