ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যে প্রয়াগরাজ, সাহারানপুর ও কানপুরে গত কয়েক দিনে বেশ কিছু বাড়ি-ঘর বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দিয়েছে পৌর কর্তৃপক্ষ। তাদের মতে এগুলো অবৈধভাবে নির্মিত। কিন্তু স্থানীয় লোকজন, বিরোধী রাজনৈতিক নেতা ও মানবাধিকার কর্মীরা বলেন, মুসলিমদের টার্গেট করেই এ অভিযান চালানো হচ্ছে।
সবশেষ ঘটনা ঘটেছে রোববার প্রয়াগরাজ শহরে, যার আগেকার নাম ছিল এলাহাবাদ। এ শহরেরই করেলি এলাকায় ওয়েলফেয়ার পার্টির একজন নেতা জাভেদ মোহাম্মদের বাড়ি ভেঙে দেয়া হয়।
বলা হয়, গত শুক্রবার এ শহরে জুমার নামাজের পর যে বিক্ষোভ হয় তিনি ছিলেন তার প্রধান পরিকল্পনাকারী। সম্প্রতি মহানবী সা:-কে নিয়ে বিজেপি মুখপাত্র নূপুর শর্মা যে বিতর্কিত মন্তব্য করেন তার প্রতিবাদেই ওই বিক্ষোভ হয়েছিল।
এর আগে শুক্র ও শনিবার সাহারানপুর ও কানপুরেও কয়েকজন মুসলিমের বাড়ি ভেঙে দেয়া হয় বুলডোজার দিয়ে।
তারও আগে মধ্যপ্রদেশ রাজ্যে অন্তত ৪৫টি মুসলিম বাড়িঘর একইভাবে বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেয়া হয়।
পুলিশ ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বলছে, এসব বাড়ি অবৈধভাবে নির্মিত। কিন্তু স্থানীয় লোকেরা বলছেন, দাঙ্গায় উস্কানির অভিযোগের নাম করে বিজেপি-নেতৃত্বাধীন প্রশাসন আসলে মুসলিমদের ঘরবাড়ি ভাঙছে।
ভারতে ক্ষমতাসীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপির সাবেক মুখপাত্র নূপর শর্মা একটি টিভি চ্যানেলে মহানবীকে সা: নিয়ে যে বিতর্কিত মন্তব্য করেছিলেন, তার প্রতিবাদ জানাতে ভারতের মুসলিমরা সে দেশের নানা স্থানে গত কিছুদিন ধরে বিক্ষোভ করছেন।
এর মধ্যে বিশেষ করে প্রয়াগরাজ এবং সাহারানপুরে জুমার নামাজের পর বের করা বিক্ষোভ থেকে মুসলিমদের ওপর সহিংসতার সূত্রপাত হয়। এর পর উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের আটটি জেলা থেকে তিন শতাধিক লোককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
পুলিশ অভিযোগ করে জানায়, প্রয়াগরাজের বাসিন্দা মোহাম্মদ জাভেদ আহমদ হলেন এই সহিংসতার প্রধান পরিকল্পনাকারী।
বার্তা সংস্থা এএনআই এক টুইট বার্তায় জানায়, প্রয়াগরাজ ডেভেলপমেন্ট অথরিটি জাভেদ মোহাম্মদের বাড়ি ভেঙে ফেলা হবে বলে একটি নোটিশ দেয়। রোববার সকাল ১১টার মধ্যে তাকে বাড়িটি খালি করে দিতে নির্দেশ দেয়া হয়। কারণ হিসেবে বলা হয়, বাড়িটি অবৈধভাবে নির্মিত।
এর পর রোববারই বুলডোজার এসে বাড়িটি ভেঙে দেয়।
এর আগে শনিবার কানপুর শহরে মোহাম্মদ ইশতিয়াক নামে এক ব্যক্তির নতুন তৈরি করা বাড়িটি ভেঙে দেয়া হয়। বলা হয়, তিনি কানপুরের বিক্ষোভের প্রধান অভিযুক্ত জাফর হায়াত হাশমির ঘনিষ্ঠজন।
পুলিশের একজন কর্মকর্তা আনন্দ প্রকাশ তিওয়ারি বলেন, নিয়ম-নীতি অনুসরণ করেই ভবনটি ভেঙে দেয়া হয়েছে এবং ভূমিদস্যুদের অবৈধভাবে নির্মিত বাড়ি-ঘরের বিরুদ্ধে তারা পদক্ষেপ নিয়েছেন।
এছাড়া সাহারানপুর শহরেও শুক্রবারের বিক্ষোভের পর মোট ৬৪ জনকে গ্রেফতার তরে পুলিশ। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে দু‘জন মোজাম্মেল ও আবদুল বাকিরের বাড়িও ভেঙে দিয়েছে সাহারানপুরের পৌর-কর্তৃপক্ষ। পুলিশ দাবি করছে, এসব বাড়ি অবৈধভাবে নির্মিত।
একইভাবে বাড়ি ভাঙা হয় দিল্লির জাহাঙ্গীরপুরীতেও।
এর পরেই সেখানে পৌর-কর্তৃপক্ষ তাদের ভাষায় অবৈধ বাড়ি-ঘর ভাঙার কর্মসূচি শুরু করে।
ওই এলাকার পৌর-কর্তৃপক্ষ নিয়ন্ত্রণ করে ভারতের ক্ষমতাসীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপি। তাদের কথা, ওই এলাকায় অবৈধ ঘর-বাড়ি ভেঙে ফেলার জন্যই এই অভিযান।
কিন্তু সেখানকার মুসলমানরা বলেন, বিশেষভাবে তাদের বাড়ি-ঘরকে লক্ষ্য করেই ভাঙচুরের এই অভিযান চালানো হয়েছে।
জাহাঙ্গীরপুরীর বাসিন্দারা অভিযোগ করেন, উচ্ছেদ অভিযান সম্পর্কে তাদের কোনো নোটিশ দেয়া হয়নি। এই অভিযান থামানোর জন্য ভারতের সুপ্রিম কোর্ট একটি অন্তর্বর্তী আদেশ জারি করার পরেও এক ঘণ্টা সময় ধরে উচ্ছেদ অভিযান চলে।
দিল্লিতে মুসলিমদের ওপর সহিংসতার পর জাহাঙ্গীরপুরীতে চলে উচ্ছেদ অভিযান। কিন্তু মুসলমানরা বলেন, শুধু তাদের ঘর-বাড়ি টার্গেট করা হয়েছে।
মে মাসে দিল্লির শাহীনবাগ এলাকায়, যেখানে ২০১৯-২০ সালে নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়, সেখানেও অবৈধ দখলদারি উচ্ছেদের জন্য বুলডোজার পাঠানো হয়েছিল। তবে স্থানীয় বাসিন্দা ও বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক কর্মীদের প্রতিবাদের মুখে বুলডোজার ফিরে যায়।
একই প্যাটার্ন, যার শুরু মধ্যপ্রদেশে। দিল্লি ও উত্তরপ্রদেশে যা ঘটছে তার সাথে মধ্যপ্রদেশে এপ্রিল মাসে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীর অনেক মিল রয়েছে। মধ্যপ্রদেশেও ক্ষমতায় রয়েছে বিজেপি।
ভারতে যেখানে যেখানে এরকম অভিযান হয়েছে সেখানকার পুলিশ বা কর্তৃপক্ষ মোটামুটি একই ধরনের ব্যাখ্যা দিয়ে থাকে।
পুলিশ বলছে, এটা হচ্ছে সরকারি জমি দখল করে অবৈধভাবে নির্মিত বাড়িঘর-দোকানপাট বা স্থাপনা উচ্ছেদের অভিযান। কর্তৃপক্ষ বলে থাকে যে, কোনো নির্দিষ্ট ধর্মীয় সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে এসব অভিযান পরিচালিত হচ্ছে না।
কিন্তু প্রশাসনের কিছু ব্যক্তি ও বিজেপির নেতাদের কথাবার্তায় ভিন্ন ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
মধ্যপ্রদেশে রামনবমীর দাঙ্গার সময় রাজ্য সরকার সরাসরি মুসলিমদের এজন্য দোষারোপ করে। রাজ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নরোত্তম মিশ্র তখন একটি টিভি চ্যানেলকে বলেছিলেন যে, মুসলিমরা যদি এরকম আক্রমণ চালায় তাহলে তারা ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করতে পারেন না।
যেসব বাড়ি থেকে পাথর ছোড়া হয়েছে সেই বাড়িগুলোকেই পাথরের টুকরায় পরিণত করার কথাও বলেন তিনি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কোনো অপরাধের অভিযোগের শাস্তি হিসেবে এভাবে বাড়ি-ঘর ভেঙে দেয়াটা কোনোভাবেই বৈধ হতে পারে না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাহুল ভার্মা বলেন, এখানে আইনকে একটা আবরণ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব বাড়ি যদি অবৈধই হবে তাহলে তো তা বিক্ষোভের আগেও ছিল। আপনি এভাবে প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ নিতে পারেন না কারণ তা যথাযথ প্রক্রিয়ার বরখেলাপ।
তিনি আরো বলেন, রাষ্ট্র এখানে প্রতিশোধপরায়ণ মানসিকতা দেখাচ্ছে।
সূত্র : বিবিসি