রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৩১ পূর্বাহ্ন

জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : রবিবার, ৩ জুলাই, ২০২২
  • ১১৪ বার

১৯২৬ সালে মুসলিম সাহিত্য সমাজ কর্তৃক প্রকাশিত ‘শিখা’ পত্রিকার প্রতিটি সংখ্যার উপরে লেখা থাকত ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব’ কথাটি। এই পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল হোসেন। এ পত্রিকার সাথে যুক্ত ছিলেন কাজী আবদুল ওদুদ, কাজী মোতাহার হোসেন, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতো ব্যক্তিত্ব। একে বলা হতো ঢাকার যুক্তিবাদী আন্দোলন। এটি বাঙালি মুসলিম সমাজে নতুন যুগের হাওয়া বইয়ে দিতে চেয়েছিল। তাদের আদর্শ ছিল ১৯ শতকের নবজাগরণ, ইউরোপের নবজাগরণ, কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে তুরস্কের নবজাগরণ।

যেকোনো পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন জ্ঞান সাধনা ও বুদ্ধির সম্প্রসারণ। যে জাতি জ্ঞানকে সীমাবদ্ধ করে রাখার চেষ্টা করেছে সেই জাতিরই পতন হয়েছে। দার্শনিক সক্রেটিসের মূল দর্শন ছিল,‘Virtue is knowledge.’ অর্থাৎ সৎ গুণই জ্ঞান। তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষের মধ্যে যেসব গুণাবলি তৈরি হয় তা জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করেই হয়। তিনি আরো বিশ্বাস করতেন যে, মানুষ যা ইচ্ছা করে তা বোঝার জন্য জ্ঞানীয় শক্তি দ্বারা পরিচালিত হয়, যখন আবেগের ভ‚মিকা হ্রাস করে। জ্ঞান ব্যতীত একটি সুন্দর সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব নয়। এখন প্রশ্ন হলো, আমাদের বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থায় জ্ঞান চর্চার জায়গা কতটা স্বাধীন এবং জ্ঞানীর কদরই বা কতটা?

শফিক রেহমান সম্পাদিত ‘রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমান’ শীর্ষক বইয়ের সূচনাতেই লেখা আছে, ‘জিয়া তার প্রায় ছয় বছরের শাসনকালে তার সরকারে বহু মতাদর্শের বহু জ্ঞানী ও গুণী ব্যক্তিদের নিয়ে এসেছিলেন। বলা যায়, একধরনের টেকনোক্র্যাট সরকার তিনি চালু করেছিলেন, যেমনটা আছে যুক্তরাষ্ট্রে।’ প্রফেসর ড. তালুকদার মনিরুজ্জামান তার Bangladesh Revolution and its aftermath গ্রন্থে তিনি বলেছেন, বিভিন্ন সেক্টরের দক্ষ লোকদের উপদেষ্টা ও মন্ত্রিপরিষদের সদস্য বানিয়ে রাষ্ট্রের উন্নয়নকে অগ্রগামী করার চেষ্টা করেছিলেন।’ যার কারণেই জিয়াউর রহমানের শাসন আমলে কৃষি থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি সেক্টরেই অসম্ভবনীয় উন্নয়ন সংঘটিত হয়েছিল।

রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সেক্টরভিত্তিক জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়োগ মুঘল বাদশাহরাও দিতেন। যেমন মুঘল সম্রাট আকবরের রাজ দরবারে বুদ্ধি পরামর্শ দেয়ার জন্য ৯ জন পরামর্শদাতা ছিলেন যাদের নবরত্ন বলা হতো। নিজ নিজ ক্ষেত্রে তারা ছিলেন অসামান্য জ্ঞানী, শ্রেষ্ঠ ও অতুলনীয়। তার দরবারে নবরত্ন যারা ছিলেন তারা হলেন, সভাকবি আবুল ফজল, প্রতিরক্ষামন্ত্রী আব্দুল রহিম খান, প্রধানমন্ত্রী বীরবল, গায়ক ফৈজি, ধর্মবিষয়ক উপদেষ্টা ফকির আজিওদ্দিন, সেনাপতি মানসিংহ, গৃহমন্ত্রী মোল্লা দোপেঁয়াজা, সংস্কৃতিমন্ত্রী তানসেন এবং অর্থমন্ত্রী টোডরমল।

আমরা ইতিহাস পাঠে জানতে পারি, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র, সম্রাট বিক্রমাদিত্যের দরবারেও নবরত্ন ছিলেন যারা জ্ঞান-গরিমায় ছিলেন এক ও অনন্য। নবরত্নদের যিনি যে কাজে পারদর্শী তাকে সেই কাজেরই দায়িত্ব দেয়া হতো। এই জন্য তাদের চিন্তাচেতনা প্রসূত কাজের দৃষ্টান্ত এখনো সামনে আনা হয়।

রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে জ্ঞানী লোকের বিকল্প নেই। ‘জ্ঞানই শক্তি, জ্ঞানই সুপার পাওয়ার’ এই সত্যটি আমাদের তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর নেতারা উপলদ্ধি করতে না পারলেও উন্নত রাষ্ট্রগুলো জ্ঞানীদের খুঁজে খুঁজে বের করে রাষ্ট্রের উন্নয়নে কাজে লাগায়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য আমাদের দেশে কেউ যদি জ্ঞান চর্চা করেছে তো সেই বেটার জীবন জিন্দিগি শেষ। এই দেশে জ্ঞান চর্চার পরিবর্তে তোষামোদি আর নগদায়নকে খুব বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়। সে জন্য আমাদের দেশে সরকার প্রধান থেকে শুরু করে হৃষ্টপুষ্ট ব্যক্তিদের পাশে মোসাহেব ব্যতীত আর কাউকেই ভিড়তে দেয়া হয় না।

জ্ঞানীর কদর জ্ঞানীরাই দিতে জানেন। উদাহরণ হিসেবে বিশ্ব বিখ্যাত দার্শনিক এরিস্টটলের ছাত্র আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট এবং দার্শনিক ডায়োজিনিসের কথা বলতে পারি। আলেকজান্ডার দার্শনিক ডায়োজিনিসের কথা শুনে ঠিক করলেন তার সাথে দেখা করবেন। ডায়োজিনিস যেখানে থাকতেন সেখানে গিয়ে দেখলেন ডায়োজিনিসের আবাস হলো পরিত্যক্ত বিশাল একটি টব বা মদের ভাড়, তিনি সামান্য কাপড় পরে আছেন, দেখতে পাগল ধরনের। ডায়োজেনিসের সামনে গিয়ে আলেকজান্ডার বললেন, ‘আমি আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট। ’

ডায়োজেনিস বললেন, ‘আমি ডায়োজেনিস দ্য সিনিক।’ আলেকজান্ডার বললেন, ‘আপনি কি আমাকে ভয় পাচ্ছেন না?’ ডায়োজেনিস বললেন, ‘কেন? তোমাকে ভয় পেতে হবে কেন? তুমি ভালো না খারাপ?’ আলেকজান্ডার বললেন, ‘অবশ্যই ভালো।’ ডায়োজেনিস বললেন, ‘তো ভালো জিনিসকে কেউ ভয় পায়? সম্রাট আলেকজান্ডার তার কী উপকার করতে পারেন এরূপ প্রশ্ন করলে তিনি ব্যঙ্গসহকারে বলেছিলেন, আপনি দয়া করে আমার সূর্যের আলোটুকু আড়াল না করে সরে দাঁড়াতে পারেন। তিনি আলেকজান্ডারকে বুঝাতে চাইলেন, ক্ষমতার ছায়া যেন জ্ঞানের আলোকে আড়াল করতে না পারে।

এই কটু কথা শুনেও ডায়োজেনিসের সাথে প্রথম আলাপেই মুগ্ধ হয়ে গেলেন আলেকজান্ডার এবং তিনি তার সঙ্গীদের বললেন, ‘আমি যদি আলেকজান্ডার না হতাম, তবে ডায়োজেনিস হতে চাইতাম!’

ডায়োজেনিস সবসময় যেভাবে পছন্দ করতেন, সেভাবেই চলতেন। কথা বলার অধিকার প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘বাকস্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা মানুষের সবচেয়ে সেরা সম্পদ। একবার উনাকে বাজারে হ্যারিকেন হাতে হাজির হতে দেখে, কী করছেন জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছিলেন, ‘তিনি আসলে মানুষ খুঁজছেন’। হ্যারিকেন দিয়ে সৎ মানুষ খোঁজার প্রচেষ্টায় লোকজন যথেষ্ট অপমানিত হওয়ায় তিনি বলেছিলেন, ‘গ্রিসের কোথায় তিনি সৎ আর ভালো মানুষ খুঁজে পাবেন, কেউ কি বলতে পারবে’?

বর্তমান সময়ে, যেখানে মানুষ কেবল যশ খ্যাতি এবং ঐশ্বর্যের পেছনে নিরন্তর ছুটে চলেছে, যেখানে মানুষের বিলাসিতার চাদরে মোড়ে থাকার প্রবণতা বেড়েছে; সেখানে ডায়োজেনিস দ্য সিনিক হতে পারেন আমাদের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তার প্রজ্ঞার এমন সুচারু ব্যবহার এবং নির্মোহ জীবনযাপন থেকে শিক্ষা নেয়া যেতেই পারে।

জ্ঞানের কাজ হচ্ছে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করা। ক্ষমতা, লোভ-লালসা, আর ভয়ের রক্ত-চক্ষুকে পরোয়া না করে একটি নির্মোহ রাষ্ট্র কিংবা সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করাই হচ্ছে জ্ঞানের কাজ। সক্রেটিসের রাষ্ট্র কাঠামোতে রাষ্ট্রের প্রধানকে অবশ্যই দার্শনিক হতে হবে। যিনি হবেন সত্য এবং সুন্দরের পূজারি, উত্তম চরিত্রের অধিকারী, লোভ-লালসা যাকে স্পর্শ করবে না।

আমাদের নবী হজরত মুহাম্মদ সা: ঘোষণা করেছেন, ‘আমি শিক্ষকরূপে প্রেরিত হয়েছি। যাতে মানবজাতিকে উত্তম চরিত্রের শিক্ষা প্রদান করতে পারি’ (তিরমিযী)। শিক্ষা তথা জ্ঞান অর্জনের ব্যাপারে হজরত মুহাম্মদ সা: বলেছেন, ‘জ্ঞান অর্জন করা প্রতিটি মুসলমান নর-নারীর ওপর ফরজ’ (বায়হাকি : ১৬১৪)। এমনকি হেরা গুহায় ধ্যানরত নবী সা:-এর কাছে হজরত জিব্রাইল (আ:) সর্বপ্রথম যে আসমানি পয়গাম নিয়ে এসেছিলেন তা ছিল- ‘পড় তোমার প্রভুর নামে’। কেননা পড়া ব্যতীত কোনো জাতির সুপ্ত মেধার বিকাশ ঘটতে পারে না, পৌঁছাতে পারে না উৎকর্ষতার চরম সোপানে। এ মর্মে পবিত্র কুরআনুল কারিমে বর্ণিত হয়েছে, ‘যারা জানে আর যারা জানে না, তারা কি সমান হতে পারে’? (সূরা জুমার : ৩৯:৯) জ্ঞান অন্বেষণের পথকে নবী সা: জান্নাতের পথ বলে ঘোষণা করেন। নবী করীম সা: বলেন ‘আসমান ও জমিনে অবস্থানকারী সবাই এমনকি গভীর পানির মাছও জ্ঞান অন্বেষণকারীর জন্য দোয়া করে’ (মেশকাত)।

জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব সম্পর্কে হজরত আলী (রা:) বলেছেন, ‘বুদ্ধিমত্তার (জ্ঞানের) চেয়ে মূল্যবান সম্পদ আর নেই এবং মূর্খতার চেয়ে বড় দারিদ্র্য আর নেই। ভদ্র্রতার চেয়ে বড় উত্তরাধিকার আর নেই এবং পরামর্শের চেয়ে বড় সাহায্যকারী আর নেই।’ জ্ঞানী লোকদের আল্লাহ তায়ালা উচ্চমর্যাদা দান করবেন। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমানদার এবং যাদের জ্ঞান দান করা হয়েছে আল্লাহ তাদের সুউচ্চ মর্যাদা দান করবেন’ (সূরা মুজাদালাহ, আয়াত-১১)।

সুতরাং রাষ্ট্র, সমাজ-সংসারে সুখ ও সমৃদ্ধি ঘটানোর জন্য জ্ঞান এক অপরিহার্য বিষয়। রাষ্ট্র ও সংগঠন পরিচালনার পরিকল্পনা তৈরির জন্য প্রয়োজন জ্ঞান ও বুদ্ধির সম্প্রসারণ। জ্ঞানকে সীমাবদ্ধ করে কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। কিন্তু এখন যারা এক ব্যক্তির শাসন বা একনায়কতান্ত্রিক শাসন কিংবা মূর্খের শাসন পছন্দ করেন স্বাভাবিক অর্থে তারা জ্ঞানীকে ভয় পান; কারণ জ্ঞানীকে আটকে রাখতে পারলেই তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করা সহজ হয়ে যায়। সত্যিকার অর্থে রাষ্ট্র ও সংগঠনকে মানবিক করার জন্য কৌশল নির্ধারণে জ্ঞানীদের জায়গা দেয়া উচিত। তবেই আমরা একটি সভ্য ও সুন্দর সমাজের অংশীদার হতে পারব।

harun-980@gmail.com

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com