গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের মোট বৈদেশিক ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৭৯ কোটি ডলার। ওই সময়ে টাকার হিসাবে ঋণ ছিল ৭ লাখ ৭৯ হাজার কোটি টাকা। ডিসেম্বরে ডলারের বিপরীতে টাকার মান ছিল ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা। গত বৃহস্পতিবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৪ টাকা ৯৫ পয়সায়। প্রায় সাত মাসে টাকার মান কমেছে ৮ টাকা ৯৫ পয়সা। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে বৈদেশিক ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা।
গত সাত মাসের ব্যবধানে শুধু টাকার অবমূল্যায়নজনিত কারণে বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে ৮১ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
এদিকে গত অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বৈদেশিক ঋণ আরও বেড়েছে। ওই সময়ে ঋণ বেড়েছে প্রায় ১ হাজার ৩৪ কোটি ডলার। এর মধ্যে সরকারি খাতে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ৭৫২ কোটি ডলার। অন্যান্য খাতে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ৯৮ কোটি ডলার। স্বল্পমেয়াদি ঋণ ৭৯ কোটি ডলার এবং বাণিজ্যিক ঋণ ১০৫ কোটি ডলার। স্বল্পমেয়াদি ও বাণিজ্যিক ঋণের প্রায় সবই নিয়েছে বেসরকারি খাত। ওই সময়ে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা হয়েছে ১৩০ কোটি ডলার।
প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে ডলারের চেয়ে টাকার হিসাবে ঋণের প্রবৃদ্ধিও বেশি হচ্ছে। ২০১৬ সালে ডলারের হিসাবে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৮ শতাংশ, টাকার হিসাবে ৮ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০১৭ সালে ডলারের হিসাবে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২২ দশমিক ৭ শতাংশ, টাকার হিসাবে ২৮ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০১৮ সালে ডলারের হিসাবে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১১ দশমিক ৬ শতাংশ, টাকার হিসাবে ১৩ দশমিক ২ শতাংশ।
২০১৯ সালে ডলারের হিসাবে ঋণ বেড়েছিল ১০ দশমিক ৪ শতাংশ, টাকার হিসাবে ১১ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০২০ সালে ডলারের হিসাবে ১৫ দশমিক ৮ শতাংশ এবং টাকার হিসাবে ১৫ দশমিক ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ওই বছর ডলারের বিপরীতে টাকার মান শক্তিশালী হয়েছিল বলে টাকার হিসাবে ঋণ প্রবৃদ্ধি কম হয়েছে, ডলারের হিসাবে বেশি বেড়েছে।
২০২১ সালে ডলারের হিসাবে ঋণ বেড়েছে ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ, টাকার হিসাবে বেড়েছে ২৫ দশমিক ৯ শতাংশ। গত সাত মাসে টাকার মান আরও কমার কারণে এ হিসাবে ঋণের প্রবৃদ্ধি আরও বেশি হয়েছে। ডলারের দাম যত বাড়বে বৈদেশিক ঋণের অঙ্কও তত বাড়বে।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল না থাকলে বৈদেশিক ঋণ সব সময়ই ঝুঁকিপূর্ণ। টাকার মান কমে গেলে ঋণের অঙ্ক বেড়ে যাবে। ডলারের দাম বাড়ার কারণে ঋণ শোধের সময় যে হারে ডলারের দাম বেড়েছে ওই হারে বাড়তি ঋণ শোধ করতে হবে। তিনি বলেন, দেশে স্বল্পমেয়াদি ঋণ বেশি বেড়েছে। এটাও ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ স্বল্পমেয়াদি ঋণ একসঙ্গে বেশি অঙ্কে পরিশোধ করতে হবে, যা রিজার্ভের ওপর বেশি চাপ তৈরি করবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের মোট ঋণের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ৭ হাজার ২৭১ কোটি ডলার। যা মোট ঋণের ৮০ শতাংশ। স্বল্পমেয়াদি ঋণ ১ হাজার ৮০৯ কোটি ডলার। যা মোট ঋণের ১০ শতাংশ। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে ঋণ বেড়েছে ১ হাজার ৭৮৫ কোটি ডলার। বৃদ্ধির হার সাড়ে ২৪ শতাংশ। ওই সময়ে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বেড়েছে ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ এবং স্বল্পমেয়াদি ঋণ বেড়েছে ৬৪ দশমকি ৫ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, স্বল্পমেয়াদি ঋণ বেশি হারে বাড়ায় এটি পরিশোধের ক্ষেত্রে ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। এর আগে কখনোই এত বেশি হারে স্বল্পমেয়াদি ঋণ বাড়েনি। ইতোমধ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণ খেলাপিও হতে শুরু করেছে। যার দায় আপাতত গ্যারান্টিদাতা ব্যাংকের ওপর পড়ছে। একটি পর্যায়ে ব্যাংক তা পরিশোধ করতে না পারলে তা রাষ্ট্রের ওপর বর্তাবে।
মোট ঋণের মধ্যে সরকারি খাতে ৬৭৭১ কোটি ডলার বা ৭৪ দশমিক ৬ শতাংশ। গত এক বছরে সরকারি খাতে ঋণ বেড়েছে ৯৫৩ কোটি ডলার। বৃদ্ধির হার ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ। সরকারের গ্যারান্টিতে ঋণ ৬৭২ কোটি ডলার।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বেসরকারি খাতে ঋণ ২৩০৮ কোটি ডলার। যা মোট ঋণের সাড়ে ২৫ শতাংশ। গত এক বছরে বেসরকারি খাতে ঋণ বেড়েছে ৮৩২ কোটি ডলার। বৃদ্ধির হার সাড়ে ৫৬ শতাংশ। এক বছরের এত বেশি হারে বেসরকারি ঋণ আগে কখনোই বাড়েনি। এর মধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিয়েছে ৫৮৬ কোটি ডলার, ট্রেড ক্রেডিট খাতে ১৬ কোটি ডলার, বেসরকারি ব্যাংক নিয়েছে ১৭২ কোটি ডলার। অন্যান্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ঋণ নিয়েছে। বেসরকারি খাতে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ একেবারেই কম। স্বল্পমেয়াদি ঋণ অনেক বেশি। যে কারণে স্বল্পমেয়াদি ঋণ পরিশোধে বেসরকারি খাতকে বেগ পেতে হচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৬ সালে মোট বৈদেশিক ঋণ ছিল ৪ হাজার ১৬৯ কোটি ডলার। ২০১৭ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫ হাজার ১১৫ কোটি ডলার। এটি ২০১৮ সালে ৫ হাজার ৭০৭ কোটি ডলার, ২০১৯ সালে ৬ হাজার ৩০০ কোটি ডলার, ২০২০ সালে ৭ হাজার ২৯৪ কোটি ডলার এবং ২০২১ সালে ৯ হাজার ৭৯ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। গত ছয় বছরের ব্যবধানে বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি।