সময়টা ১৮৮৪। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে বরিশাল হয়ে খুলনা পর্যন্ত যাত্রীবাহী প্যাডেল স্টিমার চালু করে ব্রিটিশ মালিকানাধীন কোম্পানি ইন্ডিয়ান জেনারেল নেভিগেশন (আইজিএন)। বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যার পাড় থেকে পদ্মা-মেঘনা হয়ে কীর্তনখোলা পর্যন্ত সেটিই ছিল নৌপথে তৎকালীন বরিশালের প্রথম ইঞ্জিনচালিত নৌযান।
প্রায় ১শ বছর পর ১৯৬০ সালের দিকে আইজিএন’র পাশাপাশি এই পথে লঞ্চ নামান বেসরকারি মালিকরা। শুরুতে কাঠের তৈরি দেড়তলা সাইজের ছোট লঞ্চ যেত বরিশাল থেকে ঢাকায়। ১৯৬৫ সালে প্রথম নামে দোতলা লঞ্চ। এমএল মারী, এমএল শাহরুন্নেসা, এমএল ইলিয়টগঞ্জসহ কয়েকটি দোতলা লঞ্চ চলতে শুরু করে এই রুটে। দোতলা হলেও এগুলোও ছিল কাঠের তৈরি।
স্বাধীনতার পর কাঠের বডিকে হটিয়ে জায়গা দখল করতে শুরু করে স্টিলবডির লঞ্চ। এরপরের ইতিহাস মোটামুটি সবার জানা। ঐতিহ্যের সঙ্গে বিলাসিতা মিলিয়ে ঢাকা-বরিশালের লঞ্চ হয়ে ওঠে ঈর্ষণীয় সার্ভিস। লাল-নীল আলোয় ঝলমল দানবাকৃতির লঞ্চগুলো যখন পাড়ি দেয় পদ্মা-মেঘনায়; তখন চাঁদের আলো আর নদীর ঢেউ মিলিয়ে সৃষ্টি হয় অপার্থিব সৌন্দর্যের। কেবল প্রয়োজনেই নয়, লঞ্চের এই আয়েশি যাত্রা উপভোগ করতে দেশ-বিদেশের বহু পর্যটক চলাচল করে এই রুটে।
তবে সেই যাত্রায় এখন কেবলই বিষাদের সুর। মাঝে কোরবানির ঈদ ঘিরে কদিন যাত্রী মিললেও এরপর থেকে অনেকটা যাত্রীশূন্য অবস্থায় চলতে হচ্ছে লঞ্চগুলোকে। স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর থেকে সৃষ্টি হয়েছে এই পরিস্থিতির। সড়কপথে মাত্র ৩ ঘণ্টায় ঢাকা যাওয়ার সুযোগ তৈরি হওয়ায় লঞ্চের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে অনেকেই। এখন শুধু ডেকই নয়, কেবিন পর্যন্ত খালি নিয়ে চলতে হচ্ছে লঞ্চগুলোকে। এই অবস্থায় আর কতদিন চলতে পারবে লঞ্চ সেটিই এখন ভাবনার বিষয়।
দিন-রাত মিলিয়ে ঢাকা-বরিশাল রুটে চলাচল করত ২৫টি লঞ্চ। এর মধ্যে ক্যাটামেরিন ওয়াটার বাস টাইপের গ্রিনলাইন ও অ্যাডভেঞ্চার-৫ এবং এমভি রাজারহাট সি চলত দিনের বেলা। বাকি ২২টি লঞ্চের যাতায়াত কেবলই রাতে। যাত্রী সংকটের কারণে অ্যাডভেঞ্চার আর রাজারহাট সির চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে বহু আগে। সর্বশেষ গত সপ্তাহে ওয়াটার বাস সার্ভিস বন্ধের ঘোষণা দেয় গ্রিনলাইন। দিবা সার্ভিসের মতো এখন পর্যন্ত বন্ধের ঘোষণা না দিলেও যাত্রী সংকটে অনেকটাই ধুঁকে ধুঁকে চলছে রাত্রীকালীন লঞ্চগুলো।
সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে কীর্তনখোলা তীরের যে লঞ্চঘাটে শুরু হতো দিনের ব্যস্ততা আর অগণিত মানুষের ভিড়-সেখানেই এখন যেন খাঁ খাঁ শূন্যতা। কলম্যানের গগনবিদারি চিৎকার আর লঞ্চগুলোর চোখ ধাঁধানো আলোকসজ্জা ফিকে হয়ে যাচ্ছে যাত্রী শূন্যতায়। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে কয়েকটি লঞ্চের কর্মচারীরা জানান, ‘ঢাকা-বরিশাল রাউন্ড ট্রিপে একটি লঞ্চের জ্বালানি দরকার পড়ে প্রায় ৬ লাখ টাকার।
এর সঙ্গে আনুষঙ্গিক মিলিয়ে মোট খরচ হয় সাড়ে ৬ লাখ। হিসাব অনুযায়ী কেবল কেবিন পূর্ণ থাকলে একটি লঞ্চ রাউন্ড ট্রিপে ৬ লাখ টাকা আয় করতে পারে। এরপর ডেকে হাজারখানেক করে যাত্রী হলেও মোটামুটি ৫ লাখ টাকা লাভ থাকে মালিকের। কিন্তু গত ২৬ জুন পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর ডেক যেমন শূন্যই থাকছে, তেমনি কেবিনগুলোও পূর্ণ হচ্ছে না। মাঝে ঈদের আগে-পরে কদিন যাত্রী হলেও এরপর থেকে আবার সেই অবস্থা।
ঢাকা-বরিশাল রুটে চলাচলকারী কীর্তনখোলা লঞ্চের মালিক মঞ্জুরুল আলম ফেরদৌস বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালু হবে, লঞ্চের যাত্রী কমবে-এটা ধারণা করেছিলাম। কিন্তু এভাবে যে লঞ্চ যাত্রীশূন্য হবে-সেটা দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি। বর্তমান যে পরিস্থিতি তাতে প্রতি রাউন্ড ট্রিপে ২ থেকে ৩ লাখ টাকা লোকসান দিতে হচ্ছে। টানা লোকসান দিয়ে আর যাই হোক লঞ্চ চালানো যাবে না।’
সুন্দরবন নেভিগেশনের পরিচালক আকতার হোসেন আকেজ বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর একদিকে যেমন যাত্রী কমেছে পাশাপাশি এটাও ঠিক যে, ঢাকা-বরিশাল রুটে বর্তমানে প্রয়োজনের তুলনায় লঞ্চের সংখ্যা অনেক বেশি। কেবল এখনই যে যাত্রী কম হচ্ছে তা নয়, যাত্রীর তুলনায় লঞ্চ বেশি হওয়ায় বছরখানেক ধরে এই রুটে মিলছে না আশানুরূপ যাত্রী। পদ্মা সেতু চালুর পর অনেক মানুষ এখন সড়কপথে ঢাকা যাওয়ায় সেই সংকট আরও তীব্র হয়েছে। লঞ্চ কমিয়ে কিংবা রোটেশন করার পাশাপাশি যাত্রীসেবা বৃদ্ধিসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে এই সংকট হয়তো থাকবে না।’
বরিশাল নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব ডা. মিজানুর রহমান বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালু হলে লঞ্চের যাত্রী কমবে এটা অনেক আগে থেকেই বলে আসছি। লঞ্চ মালিকদের উচিত ছিল আরও আগে থেকে এই সংকট মোকাবিলার প্রস্তুত নেওয়া। মানুষ এখন কম সময় এবং কম খরচে গন্তব্যে পৌঁছতে চায়। ১৯৭৪ সালে বরিশাল-ঢাকা নৌরুটে চলত সি ট্রাক সার্ভিস। ৩ ইঞ্জিনের সি ট্রাক মাত্র ৪ ঘণ্টায় পৌঁছত গন্তব্যে। সময়ের ব্যবধানে লঞ্চগুলো আয়েশি বিলাসী হলেও ’৭৪-র তুলনায় কমেছে তাদের গতি। এই রুটে যখন বে ক্রুজ চলত, তারাও তো ৪ ঘণ্টায় ঢাকা যেত। সড়কপথে সময় কম লাগলেও পদে পদে রয়েছে দুর্ঘটনার শঙ্কা। লঞ্চ মালিকদেরও নতুন করে ভাবতে হবে। গতি বাড়িয়ে কম সময়ে মানুষকে পৌঁছে দিতে হবে ঢাকায়। আজ থেকে ৪৮ বছর আগে যেটা সম্ভব ছিল সেটা এখন কেন নয়? সেই সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে ভাড়া কমানোর পাশাপাশি মান বাড়াতে হবে যাত্রীসেবার। সে রকমটা করতে পারলে নৌপথেও দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা চলতে পারবে লঞ্চ।’
লঞ্চের গতি বাড়ানো কিংবা সেবার মান বৃদ্ধি প্রশ্নে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেওয়া না হলেও এরই মধ্যে অবশ্য ভাড়া কমিয়েছে ঢাকা-বরিশাল রুটের সিংহভাগ লঞ্চ। ৩ তলাবিশিষ্ট লঞ্চে ডেকের ভাড়া ৩৫০ থেকে কমিয়ে করা হয়েছে ২০০ টাকা। ৪ তলা লঞ্চগুলোর ক্ষেত্রেও ১০০ টাকা ভাড়া কম নেওয়া হচ্ছে। একইভাবে কমেছে ভিআইপি, বিজনেস ক্লাস, কেবিন এবং সোফার ভাড়া।
এফবিসিসিআইর পরিচালক ও নিজাম শিপিং লাইন্সের মালিক নিজামউদ্দিন বলেন, ‘টিকে থাকতে সব রকম ব্যবস্থাই নিচ্ছি আমরা। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে লঞ্চশিল্প। সব সেক্টর প্রণোদনা পেলেও আমরা পাইনি। প্রতিটি মালিকের কোটি কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ রয়েছে। লঞ্চ না চললে এই ঋণ পরিশোধ হবে কী করে? এখন ভাবছি রোটেশন চালুর কথা। সব লঞ্চ না চালিয়ে কিছু লঞ্চ বসিয়ে রাখা। এটা হলে মালিকরা লোকসানের হাত থেকে বাঁচবে।’
কেন্দ্রীয় লঞ্চ মালিক সমিতির সহসভাপতি ও সুন্দরবন নেভিগেশনের মালিক সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর ৫-৬ মাস এভাবেই যাবে। এটা তো আমরা শুরু থেকেই বলে এসেছি। আমার অভিজ্ঞতা বলে ঢাকা-বরিশাল রুটের লঞ্চ কখনোই গুরুত্ব হারাবে না। কিছু যাত্রী কমবে ঠিক। কিন্তু লঞ্চ বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থা হবে না। ২-৩টা মাস অপেক্ষা করুন, দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে। নতুন বউ (পদ্মা সেতু) দেখার আগ্রহ ফুরোলেই বেশিরভাগই আবার ফিরবে লঞ্চে।