রাজধানীতে মাত্রাতিরক্ত শব্দদূষণে দিন দিন মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। এর প্রভাবে চলতি বছরে প্রায় অর্ধেক মানুষের শ্রবণশক্তি কমবে। এরই মধ্যে শুধু ট্রাফিক পুলিশের প্রায় ১২ শতাংশের শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক, অনিদ্রা ও ফুসফুসে ক্যান্সারসহ মারাত্মক সব রোগে আক্রান্তের ঝুঁকি বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে মাত্রাতিরিক্ত শব্দে এই বছরে অর্ধেক লোক শ্রবণশক্তি হারাবে। এ ছাড়া হৃদস্পন্দনে পরিবর্তন, হৃৎপিণ্ড ও মস্তিষ্কে অক্সিজেন কমে যাওয়ার জটিলতায় পড়তে হবে। এর বাইরেও শ্বাসকষ্ট, মাথা ঘোরা, বমি বমি ভাব, দিক ভুলে যাওয়া, দেহের নিয়ন্ত্রণ হারানো এবং মানসিক অসুস্থতাসহ বিভিন্ন ধরনের রোগ সৃষ্টি হতে পারে।
পরিবেশবিদরা বলছেন, ৩০টি কঠিন রোগের মধ্যে ১২টি পরিবেশদূষণের ফলেই হয়। তাদের মতে, বায়ুদূষণের পর বর্তমানে ঢাকার শব্দদূষণ এবং এর ভয়াবহতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর প্রভাবে সাময়িকভাবে বা স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন নগরবাসী। সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে শিশু, ছাত্রছাত্রী, হাসপাতালের রোগী, ট্রাফিক পুলিশ, পথচারী ও গাড়ির চালকরা। এ ছাড়া কানের অসুস্থতায় ভুগছেন এমন মানুষের সংখ্যা রাজধানীতে অসংখ্য।
অন্য দিকে চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শব্দদূষণের কারণে রক্তচাপ বৃদ্ধি, হৃদস্পন্দনে পরিবর্তন, হৃৎপিণ্ড ও মস্তিষ্কে অক্সিজেন কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ জন্য শ্বাসকষ্ট, মাথা ঘোরা, বমি বমি ভাব, দিক ভুলে যাওয়া, দেহের নিয়ন্ত্রণ হারানো এবং মানসিক অসুস্থাসহ বিভিন্ন ধরনের রোগ সৃষ্টি হতে পারে। তাদের মতে, গবেষণায় দেখা গেছে, যানবাহনের নিয়ন্ত্রণহীন শব্দে স্ট্রোকের ঝুঁকিও বাড়তে পারে। এ ছাড়া সব ধরনের স্ট্রোকের ক্ষেত্রে ৮ শতাংশ এবং ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের ক্ষেত্রে ১৯ শতাংশের জন্য দায়ী যানবাহনের অতিরিক্ত শব্দ। এ ছাড়া শব্দের কারণে চাপ তৈরি হয় এবং তা ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। এর ফলে রক্তচাপ ও হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়।
বাপার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম মোল্লা জানান, উচ্চশব্দের প্রধান উৎস যানবাহনের অহেতুক হর্ন, ভবন নির্মাণের সামগ্রী, মাইক আর ইট গুঁড়া করার যন্ত্র। এ ছাড়া গায়ে হলুদ, বিয়ে, জন্মদিন, নববর্ষ ইত্যাদি সামাজিক অনুষ্ঠানে অতি উচ্চমাত্রার শব্দ সৃষ্টিকারী সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহার করা হয়। এতে প্রতিবেশীদের রাতের ঘুম হয় না, হৃদরোগীদের হৃৎকম্পন বেড়ে যায়, শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় মারাত্মক ক্ষতি হয়। এতে মানুষের কাজের ক্ষমতা কমছে। গর্ভবতী মা ও শিশুদের ওপর উচ্চশব্দের প্রভাব আরো মারাত্মক।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, দীর্ঘক্ষণ ৬০ ডেসিবল শব্দে মানুষের শ্রবণশক্তি সাময়িক নষ্ট হতে পারে। আর ১০০ ডেসিবল শব্দে চিরতরে হারাতে পারে শ্রবণশক্তি। অথচ রাজধানীতে শব্দের মাত্রা উঠছে ১০৭ ডেসিবল পর্যন্ত। সংস্থাটি প্রতিটি মানুষের দৈনন্দিন বিভিন্ন মাত্রার শব্দের মধ্যে অবস্থানের মানদণ্ড নির্ধারণ করেছে। তাদের এই মানদণ্ড অনুযায়ী একজন মানুষ যথাক্রমে ৯০ ডেসিবল শব্দের মধ্যে আড়াই ঘণ্টা, ১০০ ডেসিবল শব্দের মধ্যে ১৫ মিনিট, ১১০ ডেসিবল শব্দের মধ্যে ৩০ সেকেন্ড, ১২০ ডেসিবল শব্দের মধ্যে ৯ সেকেন্ড এবং ১৩০ ডেসিবল শব্দের মধ্যে এক সেকেন্ডের কম সময় অবস্থান করতে পারেন।
যদিও শব্দদূষণ বিধিমালা, ২০০৬ সালে এলাকাভেদে শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যেখানে রাতদিন ভেদে সর্বনিম্ন ৪০ ডেসিবল, সর্বোচ্চ ৭৫ ডেসিবল শব্দ অনুমোদিত রয়েছে। এই নীতিমালায় ঢাকাকে পাঁচ এলাকায় ভাগ করে প্রতিটি এলাকার জন্য শব্দের সর্বোচ্চ মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। দিনরাতের জন্য নির্ধারিত সর্বোচ্চ মাত্রার শব্দ হচ্ছে নীরব এলাকায় ৪৫ ও ৩৫ ডেসিবল, আবাসিক এলাকায় ৫০ ও ৪০ ডেসিবল, মিশ্র এলাকায় ৬০ ও ৫০ ডেসিবল, বাণিজ্যিক এলাকায় ৭০ ও ৬০ ডেসিবল ও শিল্প এলাকায় ৭৫ ও ৭০ ডেসিবল।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জরিপে সায়েদাবাদ বাসটার্মিনাল এলাকায় শব্দের মাত্রা পাওয়া গেছে ১০২ ডেসিবেল। একইভাবে মতিঝিলে ৯৩, বাংলামোটরে ৯২, সদরঘাটে ৮৮, ফার্মগেটে ৯৩, শাহবাগে ৮৬, মহাখালীতে ৯৪, ধানমন্ডিতে ১০১, তেজগাঁও শিল্প এলাকায় শব্দের মাত্রা পাওয়া গেছে ৯৫ ডেসিবল।
পরিবেশ অধিদফতর এবং ওয়ার্ক ফর বেটার (ডবিøউবিবি) পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, রাজধানীর কোনো পাবলিক স্থানের শব্দের মানমাত্রা ৬০ ডেসিবলের নিচে নেই। স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগও সম্প্রতি রাজধানীর কিছু এলাকায় শব্দদূষণের ওপর জরিপ চালিয়েছে। এতে দেখা যায়- খোদ নীরব এলাকায় শব্দের মাত্রা ৭৫ থেকে ৯৭ ডেসিবল। অথচ নীতিমালা অনুযায়ী ওসব স্থানে থাকার কথা রয়েছে ৩৫ থেকে ৪৫ ডেসিবল। আবাসিক এলাকায় শব্দদূষণের মাত্রা রয়েছে সহনীয় মাত্রার চেয়ে দুই গুণ বেশি। অপর দিকে বাণিজ্যিক এলাকায় দিনের বেলায় শব্দের মাত্রা মানমাত্রার চেয়ে দেড় গুণ বেশি।
স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান জানান, উচ্চমাত্রার শব্দের মধ্যে একনাগাড়ে বসবাস করতে করতে মানুষের মেজাজ ও স্বভাব খিটখিটে হয়ে পড়ছে। এ নিয়ে অনেকসময় পারিবারিক বিপর্যয় নেমে আসছে। সহনীয় মাত্রার অতিরিক্ত শব্দ যদি মানুষ দিনের পর দিন শুনতে বাধ্য হয়ে পড়ে তাহলে সেই শব্দের দূষণও অন্যান্য পরিবেশদূষণের মতো মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে।
বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন ট্রাফিক পুলিশের ১১ দশমিক ৮ শতাংশ সদস্যের শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রতিবেদনের বিষয়ে চলতি মাসে সংবাদ সম্মেলনে শব্দদূষণের বিষয়ে বেশ কিছু তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে বাপা। গবেষণা জরিপে রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকার ১১০ জন ট্রাফিক পুলিশ সদস্য অংশ নেন। এলাকাগুলো হলো- ধানমন্ডি, সায়েন্সল্যাব, মহাখালী, যাত্রাবাড়ী, শাহবাগ ও মতিঝিল। ২০১৮ সালের ১ আগস্ট থেকে ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ জরিপ চালানো হয়।
জরিপ থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, শব্দদূষণে ১১ দশমিক ৮ শতাংশ ট্রাফিক পুলিশের শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ ট্রাফিক পুলিশ জানায়, সাধারণভাবে মোবাইলে কথা শুনতে তাদের অসুবিধা হয়। ১৯ দশমিক ১ ভাগ ট্রাফিক পুলিশ জানায়, ঘরের অন্য সদস্যদের তুলনায় বেশি ভলিউম দিয়ে তাদের টিভি দেখতে হয়। আর ৩৩ দশমিক ৯ ভাগ ট্রাফিক পুলিশ জানায়, অন্যরা উচ্চৈঃস্বরে কথা না বললে তাদের কথা শুনতে কষ্ট হয়। এ দিকে ৮ দশমিক ২ ভাগ ট্রাফিক পুলিশ জানায়, কয়েক ঘণ্টা দায়িত্ব পালনের পর তারা ঘূর্ণিরোগ, মাথা ভন ভন করা, বমি বমি ভাব ও ক্লান্তির সমস্যায় ভোগেন। জরিপে বলা হয়, শব্দদূষণের কারণে আগামী প্রজন্ম মানসিক ও শারীরিকভাবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শ্রবণশক্তি হ্রাস, বধিরতা, হৃদরোগ, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা বিঘ্ন হওয়াসহ নানা রকম সমস্যা দেখা যায়। স্বল্পমেয়াদি শব্দদূষণ মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। দীর্ঘমেয়াদি শব্দদূষণ শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত করে। শ্রবণশক্তি হ্রাসের ফলে বিরক্তি, নেতিবাচকতা, রাগ, ক্লান্তি, চাপা উত্তেজনা, মানসিক চাপ, বিষণ্ণতা, সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিহার, ব্যক্তিগত ঝুঁকি বাড়ায় এবং স্মৃতিশক্তি ও নতুন কিছু শেখার ক্ষমতা হ্রাস পায়।
শব্দদূষণে ক্ষতি প্রসঙ্গে ইব্রাহিম মেডিক্যাল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিনের অধ্যাপক এম আবু সাঈদ জানান, গর্ভাবস্থা থেকেই উচ্চৈঃশব্দ শিশুর ক্ষতি করে। শিশুর নার্ভ সিস্টেম বিকাশে বাধা পায়। তা ছাড়া উচ্চৈঃশব্দে শিশু বড় হতে থাকলে মানসিক বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর অকুপেশনাল সেফটি অ্যান্ড হেলথ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ৮৫ ডেসিবল শব্দের সর্বোচ্চ অনুমোদনীয় স্থিতিকাল (প্রতিদিন) ৮ ঘণ্টা। ১০০ ডেসিবল শব্দের সর্বোচ্চ অনুমোদনীয় স্থিতিকাল (প্রতিদিন) ১৫ মিনিট। ১২০ ডেসিবল শব্দের সর্বোচ্চ অনুমোদনীয় স্থিতিকাল (প্রতিদিন) ৯ সেকেন্ড। ১২০ ডেসিবল শব্দ সম্পূর্ণ বধিরতা সৃষ্টি করতে পারে। শব্দদূষণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা।