সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বিষাদ ইত্যাদি মানবজাতির বিশেষ গুণ এবং তাদের জীবনের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কশীল। এ হিসেবে মহানবী সা: যেহেতু মানুষ ছিলেন তার মধ্যেও এসব গুণ বিদ্যমান ছিল।
হাসি-কান্না আল্লাহর সৃষ্টি : ব্যক্তির সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ ও বিষাদের মধ্যে কারো কোনো দখল নেই। বরং স্রষ্টার ইচ্ছায়ই সে হাসে, কাঁদে। জীবনে সুখ আসে, দুঃখ আসে, আনন্দ ও বিষাদ আসে। মানুষ ইচ্ছা করে কখনো তা অর্জন করতে পারে না। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আর তিনি হাসান ও কাঁদান এবং তিনিই মারেন ও বাঁচান’ (সূরা আল নমল : ৪৩-৪৪)। হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বিষাদ ইত্যাদি আসে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে। তিনিই কারণ সৃষ্টি করেন এবং তিনিই কারণাদিকে ক্রিয়াশক্তি দান করেন। তিনি ইচ্ছা করলে মুহূর্তের মধ্যে ক্রন্দনকারীর মুখে হাসি ফোটাতে পারেন এবং সুখীকে-দুঃখী করতে পারেন।
মুমিন দুনিয়ায় বেশি কাঁদে, কম হাসে : মুমিন দুনিয়ায় অধিক পরিমাণে কাঁদে ও কম হাসে। মহানবী সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করে, সে জাহান্নামে যাবে না, যে পর্যন্ত না দোহন করা দুধ পুনর্বার স্তনে ফিরে আসে।’ অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে- ‘আল্লাহ তায়ালা দু’টি চক্ষুর ওপর জাহান্নামের অগ্নি হারাম করেছেন- ১. যে আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করে ও ২. সে ইসলামী সীমান্তের হিফাজতে রাত্রিকালে জাগ্রত থাকে’ (বায়হাকি, হাকেম)। মহানবী সা: আরো বলেছেন, ‘যে সম্প্রদায়ে আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দকারী রয়েছে, আল্লাহ তায়ালা তার কারণে সেই সম্প্রদায়কে অগ্নি থেকে মুক্তি দেবেন’ (রুহুল মাআনি)।
হাসির প্রকারভেদ : যে কর্মের মাধ্যমে ব্যক্তি তার আনন্দ প্রকাশ করে থাকে তাকে হাসি বলে। হাসি তিন প্রকার- ১. কাহকা বা অট্টহাসি : যে হাসির আওয়াজ দূর থেকে শোনা যায়; ২. সাধারণ হাসি : যে হাসিতে আওয়াজ আছে, তবে দূর থেকে আওয়াজ শোনা যায় না; ৩. তাবাসসুম বা মুচকি হাসি : যে ধরনের হাসিতে কোনো আওয়াজ নেই। সর্বোত্তম হাসি হলো মুচকি হাসি। অট্টহাসি দেয়া মাকরুহ।
মহানবী সা:-এর হাসি : মহানবী সা: মুচকি হাসি হাসতেন, অট্টহাসি কখনো হাসতেন না। হজরত জাবের রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, মহানবী সা: বেশির ভাগ সময় মৃদু হাসি হাসতেন। জাবের রা: বলেন, আমি যখন তাঁর দর্শন লাভ করতাম কখনো মনে হতো যেন তিনি চোখে সুরমা লাগিয়ে রেখেছেন। অথচ তিনি সুরমা লাগাননি’ (শামায়েলে তিরমিজি-২১৭/১)। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে হারেস বর্ণনা করেন, ‘আমি মহানবী সা:-এর চেয়ে বেশি মৃদু হাসতে আর কাউকে দেখিনি’ (শামায়েলে তিরমিজি-২১৮/২)। হজরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রা: বলেন, ‘মহানবী সা: আমার ইসলাম গ্রহণের পর থেকে কখনো আমাকে তাঁর মজলিসে প্রবেশ করতে বাধা দেননি। আর যখনই আমাকে দেখতেন তখনই হাসতেন’ (শামায়েলে তিরমিজি-২২১/৫)। মহানবী সা: বলেন, ‘আমি ওই ব্যক্তি সম্পর্কে অবগত আছি- যে সবশেষে জাহান্নাম থেকে বের হবে। এ ব্যক্তি হামাগুড়ি দিয়ে জাহান্নাম থেকে বের হবে। কেননা, জাহান্নামের কঠিন শাস্তি ভোগ করার দরুন সোজা হয়ে চলতে পারবে না। তাকে জান্নাতে প্রবেশ করার আদেশ দেয়া হবে। জান্নাতে গিয়ে সে দেখবে, সবাই নিজ নিজ স্থান দখল করে বসে আছে। সেখান থেকে ফিরে এসে জায়গা না থাকার কথা আল্লাহ তায়ালাকে জানাবে। আল্লাহ তায়ালা বলবেন, ‘দুনিয়ার ঘরবাড়ির কথা স্মরণ আছে কি? সে বলবে হ্যাঁ, হে প্রভু! তখন বলা হবে, তোমার মনে যা চায় তুমি তার আকাক্সক্ষা করো। সে যা ইচ্ছা আকাক্সক্ষা করবে। অতঃপর ঘোষণা করা হবে, তুমি যা কিছুর আকাক্সক্ষা করেছ সেগুলো এবং তার সাথে দুনিয়ার ১০গুণ বড় জান্নাত তোমাকে দেয়া হলো। সে বলবে, হে আল্লাহ! আপনি শাহানশাহ হয়ে আমার সাথে ঠাট্টা করছেন? সেখানে তো বিন্দুমাত্র জায়গাও নেই অথচ আপনি দুনিয়ার ১০গুণ বড় জান্নাত আমাকে দান করছেন?’ হাদিস বর্ণনাকারী হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: বলেন, মহানবী সা: যখন ওই ব্যক্তির উক্তি উচ্চারণ করছিলেন তখন দেখতে পেলাম মহানবী সা: হেসে ছিলেন এবং তাঁর দন্ত মোবারক প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছে’ (শামায়েলে তিরমিজি)।
মহানবী সা:-এর কান্না : নবী-রাসূলগণ বিভিন্ন কারণে ক্রন্দন করেছেন। যেমন- হজরত দাউদ আ: কেঁদেছেন দুঃখে, হজরত ইবরাহিম আ: কেঁদেছেন আগ্রহে, মহানবী সা: কেঁদেছেন প্রেম ও ভালোবাসায় বিভোর হয়ে তবে তারা হাউমাউ করে জোরে আওয়াজ করে ও বিলাপ করে কাঁদেননি। অন্যদেরও এরূপ কাঁদতে নিষেধ করেছেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে শিখখির রা: বলেন, ‘আমি মহানবী সা:-এর খেদমতে উপস্থিত হলাম। তখন তিনি নামাজরত ছিলেন। তাঁর বক্ষদেশ থেকে জ্বলন্ত উনানে পানি ভরা পাত্র থেকে যেরূপ আওয়াজ আসে সেরূপ আওয়াজ আসছিল’ (শামায়েলে তিরমিজি-৩০৭/১)। মহানবী সা: একদা হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা:-কে বলেন, ‘হে আবদুল্লাহ তুমি আমাকে কুরআন পড়ে শোনাও।’ আবদুল্লাহ বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে, আর আমি আপনাকে কুরআন পড়ে শোনাব।
মহানবী সা: বলেন, ‘আমার মন চায় অন্যের জবান থেকে কুরআন পড়া শুনি’। অতঃপর আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: যখন তিলাওয়াত করতে করতে সূরা নিসার আয়াত ফা কাইফা ইজা জি’না মিন কুল্লি উম্মাতিম বি শাহি দিন ওয়া জি’না বিকা আলা হাওলায়ে শাহিদা পর্যন্ত পৌঁছেন তখন তিনি কাঁদতে থাকেন (শামায়েলে তিরমিজি, হাদিস নং-৩০৮/২)। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা: বর্ণনা করেন- একদা মহানবী সা:-এর জীবদ্দশায় সূর্যগ্রহণ হয়। মহানবী সা: মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়া শুরু করেন। এ নামাজে এত দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকেন যে, মনে হয়েছে যেন আর রুকুতে যাবেন না। অতঃপর রুকুতে যান। রুকুতে গিয়ে এত দীর্ঘ সময় রুকু করেন যে, মনে হয়েছে যেন রুকু থেকে আর দাঁড়াবেন না। তারপর রুকু থেকে উঠে কাওমায় (রুকু থেকে উঠে) এত দীর্ঘ করলেন মনে হয়েছে যেন আর সিজদা করবেন না। সিজদায় গিয়ে এত দেরি করলেন, মনে হয়েছে যেন সিজদা থেকে মাথা উঠাবেন না। অনুরূপভাবে সিজদা থেকে উঠে দুই সিজদার মাঝে এত দীর্র্ঘ সময় বসে থাকেন যে, মনে হচ্ছিল আর সিজদা করবেন না। এভাবে দ্বিতীয় রাকাতও দীর্ঘ সময় আদায় করেন এবং কাঁদতে থাকেন (শামায়েলে তিরমিজি-৩০৯/৩)।
উচ্চ আওয়াজে কাঁদতে নিষেধাজ্ঞা : মহানবী সা:-এর কোনো এক কন্যা মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হলে তিনি তাকে স্ত্রীর ক্রোড়ে উঠিয়ে নিজের সামনে রাখেন। তখন মহানবী সা:-এর সামনেই তার মৃত্যু হয়। মহানবী সা: দাসি উম্মে আইমান তখন উচ্চস্বরে কাঁদতে থাকেন। মহানবী সা: তাকে বললেন, ‘তুমি আল্লাহর নবীর সামনে এভাবে উচ্চস্বরে কাঁদছ! উম্মে আইমান বললেন, হে রাসূল সা:! আপনাকেও তো কাঁদতে দেখছি। মহানবী সা: বললেন, এটি ওই নিষিদ্ধ কান্না নয়, এটি আল্লাহর রহমত’ (শামায়েলে তিরমিজি-৩১০/৫)।
আপনজনদের জন্য ক্রন্দন : উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা রা: বলেন, হজরত উসমান ইবনে মাযউন রা:-এর মৃত্যুর পর মহানবী সা: তার ললাটে চুম্বন করেন। তখন মহানবী সা:-এর চোখ থেকে অশ্রু ঝরছিল (শামায়েলে তিরমিজি-৩১১/৫)। হজরত আনাস রা: বর্ণনা করেন, মহানবী সা:-এর কন্যা উম্মে কুলসুম ইন্তেকাল করার পর, তার কবরের পাশে বসেছিলেন, তখন তাঁর চোখ মোবারক থেকে অশ্রু ঝরছিল। মহানবী সা: বলেন, ‘এমন ব্যক্তি কে আছে যে অদ্য রাত্রে স্ত্রী সহবাস করেনি। হজরত আবু তালহা রা: বললেন, আমি। মহানবী সা: তাকে কবরে অবতরণ করতে বললেন। অতঃপর তিনি কবরে অবতরণ করেন (শামায়েলে তিরমিজি-৩১২/৬)।
লেখক : প্রধান ফকিহ,আল-জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী