নিউইয়র্কে গত ১২ অক্টোবর সেন্টার ফর এনআরবি’র ‘ওয়ার্ল্ড কনফারেন্স সিরিজ-২০২২’র আওতায় ‘বিশ্ব অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা : প্রবাসীদের বিনিয়োগ এবং রেমিটেন্স প্রবাহে করণীয়’ শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেন্টার ফর এনআরবির চেয়ারপার্সন এম এস সেকিল চৌধুরীর সভাপতিত্বে সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন নিউইয়র্কে বাংলাদেশের কন্সাল জেনারেল ড. মো. মনিরুল ইসলাম।
আলোচকগণের মধ্যে ছিলেন সোনালী এক্সচেঞ্জ কোম্পানীর সিইও দেবশ্রী মিত্র, মানি ট্রান্সফারস কোম্পানী ‘সানম্যান এক্সপ্রেস’র প্রেসিডেন্ট ও সিইও মাসুদ রানা তপন, ম্যাককুয়্যার ক্যাপিটল ইনকের কর্মকর্তা আদিব মালেক চৌধুরী, স্ট্যান্ডার্ড এক্সপ্রেসের সিইও মো. মালেক, সিপিএ আনোয়ার হোসেন, সিলেটে প্রবাসী বিনিয়োগকারী ফকু চৌধুরী, বাংলাদেশী আমেরিকান পুলিশ এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা-প্রেসিডেন্ট লে. সুমন সাঈদ, কাতার থেকে আসা প্রবাসী বিনিয়োগকারী নূরল মোস্তফা, নিউইয়র্কে বাংলাদেশ সোসাইটির সাবেক কোষাধ্যক্ষ মোহাম্মদ আলী এবং শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক আহসান হাবিব।
অতিথি হিসেবে আরো বক্তব্য রাখেন ইউএস বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট লিটন আহমেদ, লেখক-কবি ইশতিয়াক রুপু, ব্যবসায়ী আজিজুর রহমান, সাংবাদিক রিমন ইসলাম, কাজী আতিকুর রহমান, শাহজাহান নজরুল, বদরুদ্দোজা সাগর, এএসএম মাইনউদ্দিন ও বিএ এক্সপ্রেস এর সিইও মোঃ আতাউর রহমান।
কন্সাল জেনারেল ড. মনিরুল ইসলাম বলেন, সকলেই প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নের চিন্তা করছেন-এতে কোন সন্দেহ নেই। রেমিটেন্সের প্রবাহ ধরে রাখতে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণের আহবান উচ্চারিত হলো তা আমি সময়ে সময়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সমীপে উপস্থাপন করে আসছি। এ ধরনের আলোচনার সুফল অবশ্যই পাওয়া যাবে। কন্সাল জেনারেল উল্লেখ করেন, হুন্ডি প্রতিরোধে জনসচেতনতা তৈরী করতে সকলকে সরব থাকতে হবে। হুন্ডির মাধ্যমে সাময়িকভাবে লাভবান হওয়া গেলেও সেই অর্থ জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখে না। এমনকি ভবিষ্যতে সেই অর্থে বাংলাদেশে কোন কিছু করা ঝুঁকিপূর্ণ। কারন সেটি কালো টাকা হিসেবে চিহ্নিত হবে।
সেকিল চৌধুরী বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ছাড়াও করোনায় গোটাবিশ্বের অর্থনীতিতে টালমাটাল অবস্থা। বাংলাদেশ তার বাইরে নয়। তবুও ডলারের মূল্যমানের যে ব্যবধান তা দূর করা সম্ভব হলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাসের গতি টেনে ধরা সম্ভব হবে। তিনি উল্লেখ করেন, সম্প্রতি লন্ডনের ৭ বিনিয়োগকারি বাংলাদেশে গিয়ে যে ধরনের পরিস্তিতির ভিকটিম হয়েছেন, তা প্রবাসে বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিংয়ের ক্ষেত্রে ও প্রবাসীদের বিনিয়োগে প্রশ্নের উদ্রেক করছে, এ ঘটনায় প্রবাসীরা আতংকিত হয়ে পড়েছেন এবং এর ফলে বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ পরিস্থিতির অবসানে সকলকে সততা ও নিষ্ঠাবান হতে হবে। তিনি প্রবাসীদের ব্যাপারে সর্বোচ্চ সহযোগিতামূলক আচরণের আহ্বান জানান।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের যে কোন ব্যাংকের পূর্ণাঙ্গ শাখা স্থাপন, প্রেরিত রেমিটেন্সের ওপর বোনাসের পরিমাণ ২.৫% থেকে বাড়িয়ে ৫% করা, বিনিয়োগ-সম্পর্কিত রেমিটেন্সের বোনাস প্রদানের ব্যবস্থা করা হলে বৈধপথে রেমিটেন্সের প্রবাহ বাড়বে বলে মন্তব্য করা হয় নিউইয়র্কের এই সেমিনারে।
সেমিনারের আলোচক লিটন আহমেদ তার লিখিত বক্তব্যে উল্লেখ করেন, করোনাকালিন রেমিটেন্স-প্রবাহের চেয়ে ভাটা পড়েছে গত কয়েক সপ্তাহে। এর কারণ হচ্ছে বৈধপথে প্রেরিত ডলারের বিনিময়ে গন্তব্যে পাওয়া যাচ্ছে ১০৬.৫০ টাকা। সাথে যোগ হয় বোনাসের আড়াই পার্সেন্ট। অর্থাৎ ১১০ টাকা। অপরদিকে হুন্ডিতে পাঠানো ডলারের দাম পাচ্ছে ১২০ টাকার মত। ফলে বৈধপথে রেমিটেন্সের প্রবাহ ক্রমান্বয়ে কমছে। এ পরিস্থিতির অবসানে কর্তৃপক্ষকে জরুরী পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা সচল রয়েছে-এটা স্বীকার করেন সকলেই। তাই বিষয়টিকে আমলে নিয়ে বোনাসের পরিমাণ বৃদ্ধির পদক্ষেপ নেয়া দরকার।
সোনালী ব্যাংকের সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রস্থ ‘সোনালী এক্সচেঞ্জে’র সিইও দেবশ্রী মিত্র ক্যাটাগরিকেলি উল্লেখ করেন, হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠিয়ে পরবর্তীতে কেউ যদি সেই অর্থে শিল্প-করখানা গড়তে চান, তাহলে সেটি বুমেরাং হবে। কারণ, বৈধপথে অর্থ বিদেশে থেকের ডক্যুমেন্ট ব্যতিত সরকারের অনুমোদন মিলবে না কখনোই। বৈধপথে টাকা পাঠালেই পরবর্তীতে সে টাকায় স্বপ্নের ভবিষ্যত রচনা করা সম্ভব হবে।
ইউএসবিসিআইয়ের পরিচালক শেখ ফরহাদ উল্লেখ করেছেন, অনেক প্রবাসী তার সন্তানদেরকে বাংলাদেশে টাকা পাঠানোর দায়িত্ব দেন। সে সময় নতুন প্রজন্মের ওরা সোনালী এক্সচেঞ্জ কিংবা অন্য কোন বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠানের অ্যাপস খুঁজে পায় না। ফলে তারা জুম অথবা অন্য কোন বিদেশী অ্যাপের ওপর ভরসা করে টাকা পাঠাচ্ছে। এ বিষয়টিকেও সংশ্লিষ্টদের নজরে রাখতে হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলবেন, অথচ সবকিছুকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখবেন-সেটি হতে পারে না।
লেখক ইশাতিয়াক রুপু বলেন, সবকিছুর উর্দ্ধে প্রিয় মাতৃভূমির স্বার্থেই আমাদেরকে হুন্ডি পরিহার করতে হবে। এই সেমিনারে অংশগ্রহণকারি সাধারণ প্রবাসীরা উল্লেখ করেছেন, হুন্ডি ব্যবসার সাথে জড়িত কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের তালিকা সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্ট ইউনিট (বিএফআইইউ)এবং সিআইডির গোচরে আছে। তারা যথাযথ কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করা সত্বেও কোন অজ্ঞাত কারণে কর্তৃপক্ষ নিরব রয়েছে। বিএফআইইউ সূত্রে আরো বলা হয়েছে যে, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অষ্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বেশ কটি দেশের প্রবাসীদের কাছ থেকে অবৈধভাবে বিকাশ, নগদসহ কয়েকটি চিহ্নিত সংস্থা টাকা লেন-দেন করছে। ডিজিটালে এই লেনদেন হওয়ায় তা কর্তৃপক্ষের গোচরে আসে না। অপরদিকে, গত এক বছরে বাংলাদেশ থেকে হুন্ডিতে পাচার হয়েছে কমপক্ষে ৭.৮ বিলিয়ন ডলার। এই অর্থ বিদেশে পাচার করে সংশ্লিস্টরা নানা স্থাপনা তৈরী, বাড়ি-গাড়ি-ব্যবসা ক্রয় করেছে। অপরদিকে ডিজিটালে প্রেরিত ডলারও বাংলাদেশে যাচ্ছে না। ঐ ডলারের বিপরীতে হুন্ডিওয়ালারা সঞ্চিত কালটাকা গন্তব্য পৌঁছাচ্ছেন। এভাবেই বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমান্বয়ে কমছে বলে বক্তারা উল্লেখ করেন।
সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এমন আলোচনার ভূমিকা অপরিসীম বলে মন্তব্য করেন মানি রেমিটেন্স প্রতিষ্ঠান ‘স্ট্যান্ডার্ড এক্সপ্রেস’র সিইও মো. মালেক ।তিনি উল্লেখ করেন, গত কয়েক বছরে সেন্টার ফর এনআরবি’র বেশ কয়েকটি সেমিনারে অংশ নিয়েছি। অনেকে অনেক কথা বলেছি। প্রবাসীদের সামগ্রিক কল্যাণের অভিপ্রায়ে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ মালাও তৈরী করা হয়েছে। কিন্তু এসব বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
অনুষ্ঠানের শুরুতে কালামে পাক থেকে তেলাওয়াত করেন ব্যবসায়ী সরদার সিরাজুল ইসলাম, রাষ্ট্রপতির বানী পাঠ করেন সানওয়ার চৌধুরী ও প্রধানমন্ত্রীর বানী পড়ে শুনান ব্যাংকার ওয়াসেফ চৌধুরী।