জয় বাংলা ধ্বনি আর ‘আমরা সবাই রাজা’ গানে নিউইয়র্ক সিটির ব্রুকলীনে বাঙালিদের এগিয়ে চলার অধ্যায়ে আরেকটি ইতিহাসের সংযোজন ঘটলো। সেটি হচ্ছে ‘লিটল বাংলাদেশ’। রবিবার চার্চ-ম্যাকডোনাল্ড ইন্টারসেকশনে বিপুল করতালি আর হর্ষধ্বনিতে এই সাইনের উম্মোচন করেন ৪ শতাধিক বছরের পুরনো নিউইয়র্ক সিটিতে সর্বপ্রথম নারী-মুসলমান ও বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কাউন্সিলওম্যান শাহানা হানিফ।
এর ৮ মাস আগে অর্থাৎ এ বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে এই সিটির জ্যামাইকায় হিলসাইড এভিনিউর বড় একটি অংশের নামকরণ করা হয়েছে ‘লিটল বাংলাদেশ’। এই সিটিতে বর্তমানে দু’লাখের বেশী বাংলাদেশি রয়েছেন। ব্রুকলীনে বাংলাদেশী অধ্যুষিত এলাকার নামকরণে অনাড়ম্বর এই অনুষ্ঠানে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার প্রবাসী ছাড়াও ছিলেন সিটির কম্পট্রোলার ব্র্যাড ল্যান্ডার, স্টেট এ্যাসেম্বলীম্যান রবার্ট ক্যারোল, নিউইয়র্কে বাংলাদেশের কন্সাল জেনারেল ড. মনিরুল ইসলাম,ডেমক্র্যাটিক পার্টির ডিস্ট্রিক্ট লিডার এটর্নী মঈন চৌধুরী, ডেমক্র্যাটিক পার্টির ন্যাশনাল কমিটির সদস্য খোরশেদ খন্দকার প্রমুখ।
লিটল বাংলাদেশ’র স্বপ্নদ্রষ্টাদের অন্যতম কাউন্সিলওম্যান শাহানার বাবা মোহাম্মদ হানিফ (যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা এবং উত্তর আমেরিকাস্থ চট্টগ্রাম সমিতির সাবেক সভাপতি) এ সময় আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন, ১৯৯৫ সালের কথা। সে সময় আমরা কজন এই এলাকায় একটি অনুষ্ঠান থেকে ‘লিটল বাংলাদেশ’ রচনার প্রত্যাশার কথা জানিয়েছিলাম। তারপর সেই স্বপ্নের পরিপূরক হিসেবে একই বছরে এ এলাকায় ‘লিটল বাংলাদেশ’ নামক একটি রেস্টুরেন্ট চালু করি। তার চলে গেছে ২৬টি বছর। আমার সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটলো আমারই কন্যা শাহানার হাত ধরে। আমি কত যে খুশী আর আনন্দিত-তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। আমি তার জন্যে গর্ববোধ করছি।
নির্বাচিত হবার ১০ মাসের মধ্যে বাংলাদেশী অধ্যুষিত এলাকাকে ‘লিটল বাংলাদেশ’-এ পরিণত করার আনন্দে অভিভূত শাহানা হানিফ বলেন, এটি আনন্দের এবং ঐতিহাসিক একটা দিন। কারণ, এই এলাকার নামকরণ হচ্ছে লিটল বাংলাদেশ। আমার পক্ষ থেকে এবং সিটি কাউন্সিলের পক্ষ থেকে কম্যুনিটির জন্য এটি একটি উপহার। আমাদের যে সংগ্রাম অনেক বছর ধরে চলছিল, এখানে মাথা উঁচু করে থাকা, গড়ে উঠা, তার বাস্তবায়ন ঘটলো। আমার পরবর্তী লক্ষ্য হচ্ছে, এই লিটল বাংলাদেশ ঘিরে আমাদের শিক্ষা, ন্যায্য মজুরি এবং গৃহায়নের যে ফাইট চলছে, তাকে শক্তিশালি করতে হবে এই নামকরণের আনন্দের মধ্য দিয়ে।
ভবিষ্যত পরিকল্পনা প্রসঙ্গে শাহানা উল্লেখ করেন, একটা লেজিসলেশন (আইন) পাশ করার ইচ্ছা আছে, তা হচ্ছে এই সিটিতে কর্মস্থলে নিরাপদে কাজ এবং অসুস্থ হলে সবেতন ছুটির বিধি রয়েছে, সেটিকে সম্প্রসারণ করতে চাই। এটি করা সম্ভব হলে আমাদের যে ডেলিভারি (অধিকাংশই কাগজপত্রহীন এবং ইলেক্ট্রিক বাইকে রেস্টুরেন্টের খাবার সরবরাহ করেন) ভাইয়েরা আছেন, যারা কনট্রাক্ট বেইজ ওয়ার্কার, ডে লেবার, তারা কর্মস্থলে অসুস্থ হলে তাদেরকে সবেতন ছুটি মিলবে। এখন কিন্তু তারা সেটি পাচ্ছেন না।
তিনি আরও বলেন, আমরা জানি যে, ডেলিভারিম্যানরা অত্যন্ত কঠোর শ্রম দিচ্ছেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গন্তব্যে খাদ্য-সামগ্রী পৌঁছাচ্ছেন। আমি সে সব কঠোর পরিশ্রমী মানুষের অধিকার নিয়ে কাজ করছি।
এই এলাকার অর্থাৎ সিটি কাউন্সিল ডিস্ট্রিক্ট-৩৯ এর সদ্য বিদায়ী কাউন্সিলম্যান থেকে সিটি কম্পট্রোলার হিসেবে বিজয়ী ব্র্যাড লেন্ডার প্রবাসীদের কর্মনিষ্ঠার প্রশংসা করে বলেন, আমি বেশ কয়েক টার্ম আপনাদের সান্নিধ্যে থেকেও এই এলাকার নামকরণ ‘লিটল বাংলাদেশ’ করতে পারিনি। আমার ছেড়ে দেয়া আসনে বিজয়ী শাহানা তা করে দেখালেন ১০ মাসের মধ্যেই। এভাবেই শাহানা দিপ্ত প্রত্যয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন আরো বড় গন্তব্যে, যার মধ্যদিয়ে বাংলাদেশীদের স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটতে থাকবে।
শুভেচ্ছা বক্তব্যে কন্সাল জেনারেল ড. মনিরুল ইসলাম বলেন, কাউন্সিলওম্যান এবং এই কাজে যারা জড়িত রয়েছেন তাদেরকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাতে চাই এজন্যে যে, তারা নিজের প্রচেষ্টায় এই যুক্তরাষ্ট্রে নিজেদের অবস্থান তৈরী করে নিয়েছেন। তারা বাংলাদেশের পরিচয় বহন করছেন। আর এভাবেই এই বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়ছে, একটি উদিয়মান দেশ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। এটি কিন্তু তারই সাক্ষ্য বহন করে। কন্সাল জেনারেল উল্লেখ করেন, আজকের দিনটি বিশেষভাবে আরো গুরুত্বপূর্ণ এজন্যে যে, আমরা বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেকার সম্পর্কের ৫০ বছর পালন করছি। এরফলে ‘লিটল বাংলাদেশ’ সাইন ফলক উম্মোচনের এই অনুষ্ঠানটি নতুন মাত্রা পেয়েছে এবং নতুন ডাইমেনশন পেয়েছে।
ড. মনিরুল ইসলাম সর্বস্তরের প্রবাসীগণকে ধন্যবাদ জানাতে গিয়ে আরো বলেন, তারা তাদের মেধা-মনন-সৃষ্টিশীলতা দিয়ে, কর্মদক্ষতা দিয়ে ভালো অবস্থান তৈরী করেছেন, সেজন্যে আমি মনে করি বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরো গভীর করার বিষয়ে আপনারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।
গভীর সন্তোষ প্রকাশ করে ডেমক্র্যাটিক পার্টির ডিস্ট্রিক্ট লিডার অ্যাটর্নি মঈন চৌধুরী বলেন, প্রবাসীদের জন্য অত্যন্ত খুশীর এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পেরে নিজেও গৌরববোধ করছি। আমরা প্রথম জেনারেশনের সদস্য হিসেবে যতটা সম্ভব চেষ্টা করছি, তবে বলতে দ্বিধা নেই যে, আমাদের সন্তানেরা অনেক ভাল করছেন বহুজাতিক এ সমাজে বাংলাদেশ আর বাঙালি কালচার উজ্জীবিত রাখতে।
চার্চ-ম্যাকডোনাল্ড এলাকাসহ ব্রুকলীনে কয়েক বছর আগেও লাখ খানেক প্রবাসী ছিলেন। এখন তা কমে হাজার পচিশেকে এসেছে। অন্যেরা পাড়ি জমিয়েছেন নিউইয়র্ক স্টেটের বাফেলো, কুইন্স ভিলেজ, ফিলাডেলফিয়া প্রভৃতি এলাকায়। যারা এখনও রয়েছেন তারা স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত এবং সকলেই সিটিজেনশিপ গ্রহণ করায় মূলধারায় কদর বেড়েছে। শাহানা হানিফের বিজয়ের মধ্যদিয়ে কম্যুনিটির গুরুত্বের পরিধি বিস্তৃত হয়েছে বলেই ‘লিটল বাংলাদেশ’ বিলটি উত্থাপনের পরই তা পাশ হয়। মার্কিন রাজনীতির সাথে প্রথম প্রজন্মের চেয়ে নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশী বংশোদ্ভ’তরা ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়েছেন এবং এই অনুষ্ঠানে তেমনি একজন শিহাব চৌধুরী বক্তব্যের সময় ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে বাঙালির বিজয়ে এই আনন্দ প্রকাশ করেন।
নতুন প্রজন্মের এই আনন্দানুভূতিকে স্বাগত জানিয়ে ডেমক্র্যাটিক পার্টির ন্যাশনাল কমিটির সদস্য এবং বাংলাদেশি আমেরিকান ডেমক্র্যাটিক ফ্রন্টের চেয়ারম্যান খোরশেদ খন্দকার বলেন, সকলকে ভোট কেন্দ্রে যেতে হবে, ব্যালট যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হবে। তবেই শাহানার হাত আরো শক্তিশালী হবে এবং অন্যরাও বিভিন্ন আসনে বিজয় ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হবেন।
নামফলক উম্মোচনের সময় বিশিষ্টজনদের মধ্যে আরো ছিলেন আবুল হাশেম, রেফায়েত চৌধুরী, কাজী নয়ন, ড. প্রদীপ কর, মাসুদুল হাসান, চন্দন দত্ত, রব মিয়া, জাহিদ মিন্টু, এ্যানি ফেরদৌস, খালেদা খানম, শাসসুদ্দিন আজাদ, ইঞ্জিনিয়ার ফারুক. কাজী আজম, ফিরোজ আহমেদ, আনোয়ার হোসেন, মোহাম্মদ হায়দার, মনির আহমেদ, আবু তাহের প্রমুখ।