প্রায় ১৪ বছর পর বিএনপি এখন মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয়। যেকোনো কর্মসূচিতে বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মী মাঠে নামছে। শুধু রাজধানী কিংবা বড় শহরগুলোতেই নয়, যেকোনো থানা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ের কর্মসূচিতেও নেতাকর্মীদের ঢল নামছে। সরকারের কোনো হুমকি বা পুলিশের লাঠিপেটাকেও কেউ ভয় পাচ্ছে না। হামলা-মামলাকেও কেউ পরোয়া করছে না। সবাই এখন সরকার পতনের আন্দোলনে নিজেকে শরিক রাখার চেষ্টা করছে। বিএনপির আহূত কর্মসূচিতে জনগণের ঢল দমাতে পুলিশ ভোলায় স্বেচ্ছাসেবক দল আবদুুর রহিম, ছাত্রদল নেতা নূরে আলম, নারায়ণগঞ্জে শাওন ও মুন্সীগঞ্জে শহিদুল ইসলাম শাওনকে গুলি করে হত্যা করেছে। সরকার ভেবেছিল, জনগণ ভয়ে আর মাঠে নামবে না। কিন্তু সরকারের এই চিন্তা বুমেরাং হয়েছে। এখন শুধু দলীয় নেতাকর্মীরাই নয়, সাধারণ মানুষও সম্পৃক্ত হচ্ছে আন্দোলন কর্মসূচিগুলোতে। লক্ষ করলে দেখা যাবে, দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপির সমাবেশে সাধারণ মানুষের উপস্থিতি নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করছে। মিছিল-সমাবেশে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততার কারণ, তারা সরকারের প্রতি বিরক্ত। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস, চাল, ডাল, তেলের দামে তারা দিশেহারা। জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহ করতে তাদের জীবন ওষ্ঠাগত। দিশেহারা জনগণের সামনে বিকল্প হলো, কে তাদের জন্য সহায়ক হবে?
২০১৪ সাল থেকে বিএনপি কোনো বেগবান আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। সরকারের হাজার রকম ব্যর্থতা ও স্বৈরাচারী আচরণের বিরুদ্ধেও জনগণকে মাঠে নামাতে পারেনি বিএনপি। হরতাল-অবরোধ দিয়ে যে আন্দোলন করেছিল তার ফল বিএনপির ঘরে না এসে উল্টো সরকারের পক্ষে গেছে। সরকারের লোকজন জ্বালাও পোড়াও করে বিএনপির ঘাড়ে দায় চাপিয়েছে। বিএনপিও জনগণের কাছে সরকারের এই কূটকৌশলকে ধরিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তবে বর্তমানে বিএনপি আন্দোলনের কৌশল পরিবর্তন করার কারণে সরকার দিশেহারা হয়ে পুলিশ ও তাদের দলীয় ক্যাডারদের লেলিয়ে দিয়ে গুলি করে বিএনপি নেতাকর্মীদের হত্যা শুরু করেছে। হামলা-মামলা করে নাজেহাল করার চেষ্টা করছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো- মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে বিরোধী নেতাকর্মীদের গুম করতে না পারায় বিএনপি নেতাকর্মীরা যেমন সাহসী হয়েছে তেমনি সরকারও চাপে পড়ে গেছে।
বিএনপি হরতাল-অবরোধের মতো হিংসাত্মক কর্মসূচিতে না গিয়ে জনসমাবেশের মাধ্যমে কর্মসূচিগুলোতে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা ও সঙ্কট নিয়ে কথা বলছে। তেল ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে সারা দেশে বিএনপি জনসমাবেশের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। জনসম্পৃক্ত এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে বিএনপি নেতাকর্মীদের হত্যা করা জনগণ ভালোভাবে নেয়নি; বরং জনগণের কাছে সরকারের অসহিষ্ণু আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এবং সরকারের স্বৈরাচারী আচরণ জনগণের কাছে আরো পরিষ্কার হয়ে গেছে।
জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি ও সরকারের স্বৈরাচারী আচরণের কারণে বিএনপির আন্দোলনে এক নতুন মাত্রা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিএনপির আন্দোলনের এই ভাষা ও কর্মসূচির কৌশলে জনগণ খুশি এবং দলের নেতাকর্মীদের কথাবার্তায় বেশ আত্মপ্রত্যয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তবে বিএনপির সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হলো- চলমান আন্দোলনের গতি এবং তৃণমূল ও সাধারণ জনগণের সমর্থন ধরে রাখতে হবে। তবে একই সাথে বিএনপিকে সতর্ক থাকতে হবে, দলের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’দের নিয়ে। দলের মধ্যে যারা নামের বাঘ, যাদের নামের ভয়ে নেতাকর্মীরা এক ঘাটে পানি খায় তাদের এখন প্রমাণ করতে হবে- তারা শুধু নামেরই বাঘ নন, কাজেরও বাঘ। তাদেরকে প্রমাণ দিতে হবে তারা দলের ভেতরে যে শক্তি প্রয়োগ করতে পারেন, মাঠের রাজনীতিতে সরকারবিরোধী আন্দোলনেও তেমন ব্যাপক প্রভাব আছে।
দলে ঘাপটি মেরে থাকা কুজনদের নিয়ে যে অনাস্থা ও অবিশ্বাস আছে তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। তারা নিজেদের সামান্য স্বার্থ প্রাপ্তির আশায় দলের বৃহৎ স্বার্থকে ধূলিসাৎ করে দিতে পারে। তাদের কাছে শাওন, রহিম, নূরে আলমের জীবনের মূল্য খুবই নগণ্য। মনে রাখতে হবে, বিএনপির যে সব কর্মী মারা গেছেন তারা দলের জন্যই জীবন দিয়েছেন। গুম, বিনাবিচারে হত্যা থেকে বাঁচার জন্য। কোনো আঁতাতের নির্বাচনে যাওয়ার জন্য বিএনপির তৃণমূলের কর্মীরা মিছিলে আসছেন না। জীবনও দিচ্ছেন না।
আওয়ামী লীগের উন্নয়ন স্লোগানে জনগণ বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। জনগণ এখন বুঝতে পারছে, আওয়ামী লীগের উন্নয়নের যে স্লোগান দিচ্ছে তা মূলত তাদের লুটপাটের স্লোগান। বিগত ১৪ বছরে আওয়ামী লীগের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীর উন্নয়ন ঘটলেও সাধারণ মানুষ আরো বেশি দারিদ্র্যের প্রান্তিক পর্যায়ে চলে গেছে। ১০ টাকা কেজি দরে চাল খাওয়ানোর প্রলোভন এখন ৬০-৭৬ টাকায় ঠেকেছে। মোদ্দা কথা হচ্ছে, আওয়ামী লীগের লুটতরাজের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফিরিস্তি দিয়ে খেটেখাওয়া মানুষের পেট ভরছে না; বরং তাদের পেট ক্ষুধার আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। জনগণ আর এখন আওয়ামী লীগের উন্নয়ন নামক ধাপ্পাবাজির গালগল্প শুনতে চায় না। জনগণ পরিবর্তন চায়। অর্থনৈতিক দুরবস্থার অবসান চায়। তারা চায় অর্থপাচার, লুটপাট বন্ধ হোক। তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের দাম কমানো হোক। চাল-ডালের জন্য টিসিবির ট্রাকের পেছনে মানবসারি ছোট হোক। সাধারণ মানুষের জীবনে নিরাপত্তা ফিরে আসুক। গুম, খুনের আতঙ্ক থেকে বাঁচতে চায়। শাসক বাহিনীর সৃষ্ট গুমোট পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে চায় সাধারণ মানুষ। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে জনগণ আর এক মুহূর্তও দেরি করতে চায় না যার কারণে তারাও বিএনপির সাথে সরকারবিরোধী আন্দোলনে এক কাতারে শামিল হচ্ছে। সাধারণ জনগণকে পাশে পাওয়াটা বিএনপির জন্য বড় ধরনের সুখবর। কারণ সাধারণ জনগণ কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে রাজপথে নেমে এলে তখন সরকার যতই স্বৈরাচারী হোক, তাকে গদি থেকে নামতেই হবে।
মাঠের আন্দোলনে বিএনপি সাধারণ জনগণের পাশাপাশি অন্য রাজনৈতিক দলগুলো থেকেও ব্যাপক সাড়া পাচ্ছে। তারাও মাঠে নামার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তুলতে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে এক সুতোয় গাঁথতে সংলাপ চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি। এই সংলাপের মাধ্যমে সবার মতামত নিয়ে একটি একক দাবিতে রাজপথে যৌথভাবে আন্দোলনের সূচনা করতে চাচ্ছে দলটি। বিএনপি ও তার শরিক দলগুলোর এক দাবি, আন্দোলন হওয়া উচিত- সরকারের পদত্যাগ ও একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনেও সুষ্ঠু নির্বাচন কোনোভাবেই আশা করা যায় না। কাজেই নির্দলীয় সরকার ও একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠন করে ২০২৩ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে আন্দোলন করলে জনগণ বিএনপির আন্দোলনে ব্যাপকভাবে সাড়া দেবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ জনগণও জানে, বর্তমান পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে হলে এই সরকারের পরিবর্তন ব্যতীত সম্ভব নয়।
তবে বিএনপিকে মনে রাখতে হবে, এই আন্দোলনে ব্যর্থ হলে তাদেরকে মূল্য দিতে হবে। তাই আন্দোলনে সফল হওয়ার জন্য সব রকম কৌশল প্রয়োগ করতে হবে। বাংলাদেশের ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে- যারা গণআন্দোলনে জয়ী হয়েছে তারা নির্বাচনেও জয়ী হয়েছে। ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনে বিজয়ীরাই ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে। ১৯৯০ সালের গণআন্দোলনে সবচেয়ে আপসহীনরাই ১৯৯১ সালে সরকার গঠন করেছে। এখন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদলের যে লক্ষ্য বিএনপি নিয়েছে, সে জন্য তাদের আগে মাঠের আন্দোলনে জয়ী হতে হবে।
সরকারপ্রধান ভারত, ব্রিটেন ও আমেরিকা ঘুরে এলেও মুখে সুখের হাসি ফুটে ওঠেনি। অর্থাৎ বহির্বিশ^ও চাচ্ছে বাংলাদেশে ২০২৩ সালের নির্বাচনে যেন ২০১৪ ও ২০১৮ সাল ফিরে না আসে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের ভোটারবিহীন এবং ভোটডাকাতির নির্বাচনকে নির্লজ্জভাবে সমর্থন দিয়ে আওয়ামী লীগকে মসনদে বসিয়ে রাখলেও পশ্চিমা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর কাছে ভারতের এই অবৈধ সমর্থন ঘৃণিত হয়েছে। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই নির্বাচনকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি যার কারণে ২০২৩ সালের নির্বাচন যাতে কোনো প্রকার প্রশ্নবিদ্ধ না হয় সে ব্যাপারে তারা অনেক আগে থেকেই সোচ্চার ভূমিকা পালন করছে। পশ্চিমা বিশ্ব চাচ্ছে একটি অংশগ্রহণমূলক অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন যেখানে জনগণের মতের প্রতিফলন ঘটবে।
আন্তর্জাতিক বিশ্বের এই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বিএনপির আন্দোলনের জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। কাজেই জনগণের দাবিকে সামনে রেখেই সরকারের স্বৈরাচারী চরিত্র ও দুর্নীতির চিত্র জনগণের সামনে ব্যাপকভাবে তুলে ধরতে হবে। সরকারের পাতা ফাঁদে যেন কেউ পা না রাখতে পারে সেদিকেও কড়া দৃষ্টি রাখতে হবে। এখানে উল্লেখ্য, মুখে মুখে ফুটুসফাটুস করলেও সরকারের মহারথীরাও বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নেতৃত্ব এবং জনপ্রিয়তাকে ভয় পায় তা দৃশ্যমান। তাদের আচরণে মনে হয়, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নাম শুনলেই তারা আঁতকে ওঠে। সরকারকে এই ভয়ের মধ্যে রেখেই বিএনপিকে মাঠের আন্দোলনে সফল হতে হবে। এটিও সত্য, আওয়ামী লীগ টিকে থাকার জন্য আজকের থেকেও বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে নির্দয়ভাবে জনগণের ওপর প্রতিশোধমূলক কাজে ব্যবহার করতে পারে। সুতরাং সব কিছুকে মোকাবেলা করেই বিএনপিকে সামনে এগিয়ে যেতে হবে এবং মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে বিজয়ী হতেই হবে। আর এটিই বিএনপির ‘পণ’ হওয়া উচিত।